নূরজাহান নীরা
গ্রীষ্মের তাপদাহে ধরা যখন উত্তপ্ত, গরমে মানুষ দিশেহারা ঠিক সে সময়ে ধরাকে রাঙিয়ে মানুষের মনকে পুলকিত করতে প্রকৃতির মাঝে হেসে ওঠে হিজলফুল। রূপসী বাংলার রূপ ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে এই হিজল গাছ। নদীমাতৃক এই দেশের ভাটির কোল জুড়ে হিজলের বাস। হাওড়, বাওড়, বিল, নদী বা নিচু জলাভূমিতে ভালো জন্মায় হিজল। তাইতো নদীপাড়ের মানুষের জীবনের সাথে গেঁথে আছে এই হিজলফুল। শুধু নদীপাড়ের মানুষই না, এমন কোনো মানুষ নেই যে হিজলের নাম শেনেনি। ঘনসবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে থাকে দীর্ঘ পুষ্পদন্ড। দূর থেকে মনে হয় সুবিন্যস্ত কারুকাজে ঝুলে আছে ফুলের বেণী। সেই বেণীতে রেশমের মতো কোমল ফুলগুলো ফুটে আছে অপার সৌন্দর্যে লাল গোলাপী ও কমলা রঙের হিজলফুল। এই গাছ জলাভূমিতে ভালো জন্মায় এমনকি পানির নিচে কয়েকমাস বেঁচে থাকতে পারে। হাওড়, বাওড়, বিল, বা নদীপাড়ে জন্মানোর কারণে ঐ এলাকার মাটি ক্ষয়রোধেও হিজলের অবদান অনেক। মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করতে হিজলের ডাল ব্যবহৃত হয়। যদিও আগের মতো হিজল এখন চোখে পড়ে না। তবে বৃক্ষপ্রেমী যারা তারা উঁচু অঞ্চলেও হিজল লাগিয়ে থাকেন। গ্রীষ্মের তাপ উপেক্ষা করে একটু চোখ জুড়িয়ে নিতে চান হিজলের রূপে। রাতে ফোটে আর সকালেই ঝরে যায় এই ফুল। একটা সময় এই হিজলফুলে মানুষের মন আটকে থাকত। পানি ছুঁই ছুঁই করা ফুটন্ত হিজলের হাসিতে চোখ আটকে যেতো পথিকের। মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যায় পুরো এলাকা। সকালে স্থির পানিতে ভেসে থাকত সেই ফুলের বিছানা। পথের উপর লাল গোলাপী রেশমী কোমল বিছানায় চোখ জুড়িয়ে যায়।
হিজলফুল হাতে নিলে কোমল স্পর্শ পাওয়া যায়। খুব ঘনপাতার ঝোপাল এই বৃক্ষ। উচ্চতায় ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চারদিকে ছড়ানো ডালপালা। পাতাগুলো বেটে আকারের। কচিপাতা হালকা লালচে সবুজ আর পরিপূর্ণ পাতার রং কালচে সবুজ এবং যথেষ্ট পুরু। হিজলের বাকল ধূসর বর্ণের এবং পুরু। বহুবর্ষজীবী এই গাছের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়ায় হলেও বাংলাদেশ, ভারত, মালেশিয়াসহ এশিয়া মহাদেশর অনেক অঞ্চলেই জন্মায়। বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাসে ফুল ফোটে। পুষ্প মঞ্জুরী এক থেকে দেড়ফুট লম্বা হয়। দীর্ঘ মঞ্জুরীতে ছোট ছোট লাল গোলাপী রেশমের মতো সুক্ষ ও কোমল ফুল ফোটে। ফুল শেষে ঝুলন্ত পুষ্পদন্ডে আসে ফল। ফল পরিপক্ব হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে যেখানে, সেখান থেকে চারা হয়। কাদাপানি সহনীয় হওয়ায় বীজও দীর্ঘদিন পানিতে ভালো থাকে। নদীর স্রোতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে চারা গজাতে পারে। সৌন্দর্য আর মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হিজল গাছের আছে কিছু ওষুধি গুণ। গবেষণা মতে, হিজলগাছের বাকল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায়। এ ছাড়া হিজলের বাকল ও ফল বিরোচক এবং ডায়রিয়া ও নাকের ক্ষতে উপকারী। রূপসী বাংলার সৌন্দর্যের প্রতীক এই হিজল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম --Barringtonia acutangula। এর সংস্কৃত নাম নিচুল। এ ছাড়া জলন্ত, নদীক্রান্ত এসব নামেও হিজলগাছ পরিচিত।