মো: জাহেদুর রহমান চৌধুরী
জীবনে চলার পথে কখনো কখনো কিছু ভালো মানুষের দেখা মেলে ভাগ্যক্রমে। অনেক গুণে গুণান্বিত। বিশেষ গুণে ভূষিত। মানবীয়গুণ, সামাজিকগুণ, ধর্মীয়গুণ, পিতৃ-মাতৃসুলভ গুণ, ভ্রাতৃ সুলভ-গুণ, বন্ধুসুলভ গুণ ইত্যাদি। আচার-আচরণ চলন বলন দেখে এসব মানুষের জন্য মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কিছু শব্দ। সেই শব্দগুলো আদর্শ মানুষ, পন্ডিত মানুষ, বিজ্ঞ মানুষ, চমৎকার মানুষ, অসাধারণ মানুষ ইত্যাদি। আর এই শব্দগুলো আসে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে। কবি মুকুল চৌধুরী সাহেবকে যতবার দেখেছি, যতবার তার কথা শুনেছি, শুনেছি তার বক্তব্য ও আবৃত্তি, ততবার আমার মুখে বেরিয়ে এসেছে আপনা আপনি তিনি একজন ভালো মানুষ। তাঁর আখলাক, তার স্বভাব, তার আচরণ এর সবটা জুড়েই ফুটে উঠেছিল একজন ভালো মানুষের চরিত্র। কবি মুকুল চৌধুরী আমার একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য সংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন অভিভাবক। আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর কল্যাণ ব্রতের কবি আফজাল চৌধুরীর একজন যোগ্য উত্তরসূরি। তিনি আফজাল চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম নিয়ে দিন রাত নিরলস প্রচেষ্টা করেছেন। তাইতো কবি মুকুল চৌধুরীকে ভালোবেসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করে তৃপ্ত হওয়া যায়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধার আকর্ষণ কেন হয়? যে মানুষকে ভালোবাসতে পারে, ভুল ধরিয়ে দিতে পারে এবং গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারে। এ গুণগুলো কবি মুকুল চৌধুরীর ভিতরে পুরো মাত্রায় ছিল। একজন নিরহঙ্কার, প্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন তিনি। কবি মুকুল চৌধুরীকে এতো ভালো লাগতো যে মনে হতো সবসময় যদি উনার পাশে থাকতে পারতাম তাহলে অনেক কিছু জানা যেত। কিন্তু কেন এমন মনে হতো? বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি। কেন এমন হয়? মানুষ যখন খুব সহজ সরল হয় আর আসলেই যদি সে মানুষটি হয় নিরঅহংকার, প্রচার বিমুখ, তখনই মনে হয় এমনটি ঘটে। সত্যি কথা বলতে কি, কথাগুলো যখন লিখছি তখন আমার কেন জানি বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদি। আর সবচেয়ে সত্যি কথাটি হচ্ছে কবি মুকুল চৌধুরী (মঞ্জরুল করিম চৌধুরী) আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তিনি ২২ এপ্রিল দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবি মুকুল চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ২২ আগস্ট সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার ইউনিয়নের খালোপার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন শ্রমনিষ্ঠ কবি ও লেখক। গত শতকের সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে লিখে গেছেন নিরলসভাবে। কবিতার পাশাপাশি গদ্য সাহিত্যেও তিনি শক্তিমান ঝরঝরে বুদ্ধিদীপ্ত। প্রবন্ধ গবেষণা এবং কিশোর-রচনা ও সম্পাদনায় তার রয়েছে স্বচ্ছন্দ ও স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ বিচরণ।
মুকুল চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৯টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ নয়টি, প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ নয়টি, কিশোর গ্রন্থ পাঁচটি, সম্পাদিত গ্রন্থ ছয়টি। তার প্রথম কবিতার বই ‘অস্পষ্ট বন্দর’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। মুকুল চৌধুরী তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরুপ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার (২০২১), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০৬), সাহিত্য পুরস্কার বাংলাদেশ সংস্কৃতি সংসদ ঢাকা (১৯৯৭), জালালাবাদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১২), ডা. এ. রসুল সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), ইংল্যান্ডের বুক অব দি ইয়ার এচিভমেন্ট এওয়ার্ড (১৯৯৬) -তে ভূষিত হন। মুকুল চৌধুরীর লাশ ২৩ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১২টায় নব্বই বছরের প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আনা হয়। এখানে দোয়া পরিচালনা করেন ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির উপ-পরিচালক মাওলানা শাহ মো. নজরুল ইসলাম। পরে বাদ জোহর নয়াসড়ক জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে মানিকপীর রহ: গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে মুকুল চৌধুরী স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান। পৃথিবীতে মানুষ আসে অল্প ক’দিনের জন্য। দীর্ঘ একটা জীবন কেউ পায় কেউ পায় না। জগত সংসারে মানুষ কেন আসে, কি তার কাজ, পৃথিবীর জীবনটাই কি শেষ? না এ জীবনের পর আরেকটি জীবন রয়েছে, মানুষ ভালো যত কাজ করবে তার বিনিময় সেই পরকালে পাবে। দোয়া করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন কবি মুকুল চৌধুরীকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।