এম.ডি জিয়াবুল

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁচলে লুকিয়ে আছে এক অপার্থিব শিখর মারাইংতং পাহাড়। এটি আলীকদম উপজেলার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক জীবন্ত মহাকাব্য। মারমা ভাষায় “মারাইংতং” অর্থ অসীম সৌন্দর্যের পাহাড়-যেন নামের মধ্যেই নিহিত এর সত্তা।

প্রায় ষোলো শতাধিক ফুট উচ্চতার এ পাহাড় নিছক ভৌগোলিক গৌরব নয়; বরং এটি এক মহিমান্বিত উপাখ্যান। এর শিখরে দাঁড়িয়ে মনে হয়-মানুষ আর আকাশের মধ্যে আর কোনো ব্যবধান নেই, চারপাশ যেন অনন্ত বিস্ময়ে ভরে ওঠে। ভোরের প্রথম প্রহরে যখন সূর্যের সোনালি কিরণ পাহাড়ের আঁচলে মিশে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে দিগন্তবিস্তৃত অরুণাভ উৎসব। আবার গোধূলি লগ্নে অস্তরাগের লালিমায় পাহাড় যেন জ্বলজ্বল করতে থাকে রক্তিম প্রদীপের মতো।

মারাইংতং-এর রূপ ঋতুপরিক্রমায় নিত্যনতুন আবহে ভিন্ন আখ্যান রচনা করে। বর্ষাকালে মেঘ এসে আলিঙ্গন করে এ শিখরকে; বৃষ্টির ঝরঝরে ছন্দে পাহাড়ের বুকে গড়িয়ে চলে অজস্র ঝরনা। মনে হয়, পাহাড় যেন স্নিগ্ধ জলের বীণায় বাজাচ্ছে অরণ্যের সিম্ফনি। আর শীতে নেমে আসে স্বচ্ছ কুয়াশার ধূসর চাদর তখন পাহাড়ের রূপান্তর ঘটে এক রহস্যময় মায়াজগতে। শীতল হাওয়ার পরশে প্রকৃতি হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ অথচ অনিন্দ্যসুন্দর।

শুধু প্রকৃতি নয়, পাহাড়কে ঘিরে আছে মানুষের সহজ-সরল জীবনধারা। মারমা, মুরং, চাকমা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁচে আছে প্রকৃতির সঙ্গী হয়ে। তাদের মুখের হাসি, আন্তরিক আতিথেয়তা এবং নিসর্গঘন গান পাহাড়কে দিয়েছে মানবিক আবেশ। এখানে প্রকৃতি ও মানুষ মিলে রচনা করেছে এক সুরেলা ঐক্য, যেখানে বনের নীরবতা ও মানুষের প্রাণময়তা একাকার হয়ে যায়। কবিসুলভ দৃষ্টিতে দেখলে, মারাইংতং পাহাড় প্রকৃতির এক বিশাল অলঙ্কার। এটি মহাকাব্যের মতো যেখানে শিখর হলো উপমা, অরণ্য হলো রূপক, আর মেঘের খেলা হলো অনন্ত উপসংহার। মানুষ যখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সে বুঝতে পারে-প্রকৃতির অমোঘ মহিমার সামনে মানুষের সব অহংকার ক্ষুদ্র হয়ে যায়। অতএব, মারাইংতং পাহাড় কেবল এক পাহাড় নয়, এটি প্রকৃতির এক কাব্যিক প্রলেপ, এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। এর উঁচু-নিচু পথ, মেঘছোঁয়া চূড়া আর অন্তর্লীন নীরবতা আমাদের শেখায় বিনয়, সৌন্দর্য আর অনন্ত ধ্যানের পাঠ। এটি বাংলার সবুজ হৃদয়ে খোদিত এক মহাকাব্যিক প্রতীক, যা যুগে যুগে মানুষকে টেনে নেবে তার রহস্যময় মাধুর্যে।