সাকী মাহবুব

বাংলাদেশের ঋতুচক্রে গ্রীষ্মকাল একটি প্রখর অথচ রঙিন ঋতু। প্রচন্ড রোদ, ঘাম ঝরানো দিন আর মাঝে মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি এ সবের মাঝেও প্রকৃতি যেন রঙে রঙে ভরে ওঠে। আর সেই রঙের মিছিলে মূল নায়ক হলো গ্রীষ্মের ফুল। এই ফুলগুলো শুধু প্রাকৃতিক নয়, মানুষের মনকেও রাঙিয়ে তোলে।

কৃষ্ণচূড়া: গ্রীষ্ম মানেই যেন কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুনে জ্বলে ওঠা শহরের রাস্তা, গ্রামের প্রান্তর। বিশাল ডালপালার নিচে ঝুলে থাকা অগণিত ফুল প্রকৃতিকে করে তোলে চমৎকার এক ক্যানভাস। কৃষ্ণচূড়া গাছ একটি বড়, প্রস্ফুটিত,পর্ণমোচী উদ্ভিদ। গাছটি আকর্ষণীয় এবং হালকা সুগন্ধযুক্ত। এর সৌন্দর্য অপরুপ। কৃষ্ণচূড়া গাছ এক একটি প্রায় ১৫-২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বাতাসের দোলায় এর ফুল ঝরে পড়ে। এই ফুলের পাপড়িগুলো চারটি পাপড়ির সমষ্টি দিয়ে গঠিত। আর এই পাপড়ি গুলো একেকটি ৫ থেকে ৮মিটার লম্বা হয়। পত্রহীন ডালপালা জুড়ে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া দূর থেকে স্বাগত জানায় পথিককে। আমাদের দেশে দুই ধরনের কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে দেখা যায়। একটি আগুনের মতো উজ্জ্বল লাল, অন্যটি হলদেটে। তবে লাল কৃষ্ণচূড়ার প্রাচুর্যতাই বেশি চোখে পড়ে। লাল হলদেটে রঙের কৃষ্ণচূড়া বর্তমানে বেশ বিরল।

জারুল: নরম বেগুনি রঙের জারুল ফুল গ্রীষ্মের আরেক বিস্ময়। বড় পাপড়িওয়ালা এই ফুল শহরের মাঝেও যেন একটুকরো বনানী এনে দেয়। বিদ্যালয়, অফিসের চত্বর, রাস্তাঘাটজায়গা মতো বেছে নিয়ে জারুল ছড়ায় তার নরম সৌন্দর্য। একেকটি জারুল গাছ ২০থেকে ৩০মিটার উঁচু হয়। আর ফুল ৪-৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। প্রতিটি ফুলের ছয়টি করে পাপড়ি থাকে। গ্রীষ্মের শুরুতেই ডালে ডালে বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুল ফোটে এবং বর্ষা পর্যন্ত দেখা যায় এই ফুল। পথের শোভা বাড়াতে জারুলের জুড়ি নেই। জারুল কাঠ অত্যন্ত মূল্যবান। লালচে রঙের কাঠ শক্ত ধরনের হয়। ভিজলেও নষ্ট হয় না। ভেষজ গুণও চমৎকার।

কাঞ্চন: হালকা গোলাপি বা সাদা রঙের কাঞ্চন ফুল শুধুই চোখে নয়, মনেও প্রশান্তি আনে। ঘ্রাণে আছে হালকা মাধুর্য, আর পাপড়ির মধ্যে আছে নিখুঁত ভারসাম্য। পাহাড়ি অঞ্চলের ফুল হলেও এখন এটি শহরের বাগানেও জায়গা করে নিচ্ছে। আমাদের দেশে প্রধানত তিন ধরনের কাঞ্চন দেখা যায়। রক্তকাঞ্চন, দেবকাঞ্চন ও শ্বেতকাঞ্চন। প্রত্যেকটি ফুলই চোখ জুড়িয়ে যায়।

পলাশ: পলাশ মূলত বসন্তের ফুল হলেও তার উজ্জ্বল রঙ গ্রীষ্মের প্রারম্ভেও দেখা যায়। “রক্তলাল” নামে খ্যাত এই ফুলটির মধ্যে রয়েছে জীবনের তেজ, স্বাধীনতার বার্তা। প্রকৃতির ক্যানভাসে এটি যেন প্রথম আঁচড়। পলাশ মাঝারি ধরনের গাছ। গোড়া ফাটা ফাটা হলেও শাখা প্রশাখা বেশ মসৃণ। ডাল মোটাসোটা হয় না। গাছ ২০থেকে ৩০ ফুট উঁচু হয়। একটি মূল বৃন্তে তিনটি পাতা। পাতা মাঝারি ধরনের বড় এবং শিরাযুক্ত। ফলের আকার ছোট শিমের মতো। এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়, অবনত ডাটার সঙ্গে লেগে থাকে। পলাশ গাছের ছাল, পাতা, ফুল, বীজ ও গাছের আঠা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পলাশের নেশা তীব্র।

হিমচাঁপা: গ্রীষ্মের জনপ্রিয় ও অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর একটি ফুলের নাম হিমচাঁপা। হিমচাঁপা ছোট বৃক্ষ প্রকৃতির। বহুবর্ষজীবী ও চির সবুজ। পাতা দেখতে কিছুটা কাঁঠাল পাতার মতো। এর উদ্ভিদতাত্তিক নাম ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা। হিমচাঁপার আদি নিবাস যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ট্রেক্সাসে। এশিয়ার প্রায় সব দেশেই হিমচাঁপা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশে একে এতো বেশি সহজে চোখে পড়ে না। গাছটি ৬ থেকে ১০মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। বসন্তের শেষ দিকে গাছে ফুলের কলি আসে আর গ্রীষ্মের শুরু থেকে গাছের শাখায় শাখায় ফুলের দেখা মেলে। হিমচাঁপার ফুলের সুবাস বেশ মিষ্টি।

জিনিয়া : জিনিয়া শীত আর গ্রীষ্মে দুই সময়েই দেখা যায় এই ফুল। তবে বর্তমানে জিনিয়াকে গ্রীষ্মের ফুল হিসেবেই জানা যায়। বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে বাগানেও অনায়াসে এই ফুলের স্নিগ্ধতা পেতে পারো তুমি।

কনকচূড়া : উঁচু গাছ গুলো ভালো করে দেখলে হঠাৎ মনে হবে যেন সবুজ গালিচার বুকে সহস্র মোমবাতি জ্বালিয়েছে কেউ। তার আলো চোখে শান্তি দিচ্ছে। বলছিলাম কনকচূড়া ফুলের কথা। কনকচূড়া ফুলের রং উজ্জ্বল কমলা আর সোনালির মিশেল। দূর থেকে দেখলে হলুদ মনে হয়। পাতা গাঢ় সবুজ। ফলের রং তামাটে। কনকচূড়া গাছ ২০মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চারপাশে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে তা বেড়ে ওঠে। পাতা যৌগিক হয়। শীতের শেষ ভাগে এই গাছের পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন কচি পাতা আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছ। ফুলের পাপড়ি সংখ্যা ৫টি। ফুল ফোটে শাখার ডগার লম্বা মন্জুরিতে। প্রচুর পরিমাণ ফুল হয়।

গ্রীষ্ম আমাদের কাছে শুধু রোদের ঋতু নয়, ফুলেরও ঋতু। এসব ফুল আমাদের জানান দেয়তাপের মাঝেও শোভা, ক্লান্তির মাঝেও সৌন্দর্য, আর একঘেয়েমির মাঝেও সৃষ্টির আনন্দ লুকিয়ে থাকে। গ্রীষ্মের ফুল তাই প্রকৃতির এক প্রাণবন্ত কবিতা, শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম।