জুবাইর আল হাদী

‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে!’ ছোট্ট এই পাখিটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল বহু রূপকথা, ছড়া ও গান। টুনটুনি পাখির সরব উপস্থিতি ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার তৎপরতা, চঞ্চলতা আর কিচিরমিচির শব্দে মুখর থাকত আমাদের আঙিনা, পুকুরপাড় কিংবা শাকসবজির মাচা।”

কিন্তু আজ যেন টুনটুনি কেবল গল্পেই রয়ে গেছে। চোখে পড়ে না আগের মতো, তাদের বাসা কিংবা কাণ্ড-কারখানাও আজ কল্পনার মতো শোনায়।

টুনটুনি পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Orthotommus sutorius, ইংরেজিতে পরিচিত tailorbird নামে। এরা এক বিশেষ কারণে খ্যাতি পেয়েছে-পাতা সেলাই করে বাসা বানানোর কৌশলে! গাছের পাতার কিনারা ঠোঁট দিয়ে সুঁচ-সুতোয় যেন সেলাই করে তৈরি করে নিখুঁত বাসা। এই নির্মাণশৈলী এতটাই নিখুঁত যে, এদের ‘দরজি পাখি’ নামেও ডাকা হয়।

টুনটুনি সাধারণত ১২-১৩ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর শরীর ছোট, পাতলা ও চটপটে। মাথা ও ডানায় জলপাই রঙের আভা, লেজ খাড়া এবং শেষ প্রান্তে থাকে গাঢ় দাগ। বুক ও পেটের অংশ হয় সাদাটে। এই নিরীহ দর্শন পাখিটি যতটা শান্ত মনে হয়, প্রকৃতিতে সে কিন্তু অত্যন্ত তৎপর, সচল ও সাহসী। বাংলাদেশে টুনটুনির তিনটি প্রধান প্রজাতি দেখা যায়-পাতি টুনটুনি, পাহাড়ি টুনটুনি এবং কালো গলা টুনটুনি। দেশের বিভিন্ন গাছগাছালি যেমন ডুমুর, কাঁঠাল, শীতলপাটি, লাউ বা কুমড়োর মাচায় এদের বাসা বাঁধার প্রবণতা বেশি। টুনটুনির বাসা প্রকৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন।

টুনটুনির খাবার তালিকায় আছে পোকামাকড়, শুঁয়োপোকা, গাছের পাতার কীট, কেঁচো ও মৌমাছি। ফুলের রস থেকেও এরা কখনো কখনো খাদ্য সংগ্রহ করে। ধান বা গমের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে এরা কৃষিকাজেও পরোক্ষভাবে উপকার করে থাকে।

টুনটুনিরা আজ হুমকির মুখে। বনাঞ্চল উজাড়, ঝোঁপঝাড় নিঃশেষ, নদী-নালার অস্তিত্ব সংকটে তাদের বাসা বাঁধার উপযুক্ত পরিবেশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, নির্বিচার বৃক্ষচ্ছেদন ও পাখির আবাসস্থলে মানুষের অনুপ্রবেশের কারণে এরা আজ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে।

এই ছোট পাখিটির বিলুপ্তি যেন শুধুই একটি প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং এটি প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার এক সতর্ক সংকেত। তাই আমাদের উচিত, -এদের আবাস টিকিয়ে রাখা, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা।