ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ
চোখের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে যারা অন্যগুণীকে বিকশিত করার মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করেন তাঁদের অন্যতম খন্দকার আবদুল মোমেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মাঠে দক্ষ চাষীর মতো নীরবে নিভৃত্বে একান্ত আন্তরিকতায় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পেশাগতভাবে শিক্ষকতা রক্তের নদীতে ছিলো শিল্প-সাহিত্যের ঢেউ। সারাজীবন এ পথে কাটিয়ে ১৩ জুন ২০২৫ শুক্রবার দিবাগত রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। শনিবার বাদ জোহর রাজধানীর শ্যামলীর বাদশা ফয়সাল ইনস্টিটিউট জামে মসজিদে মরহুমের জানাজা শেষে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
খন্দকার আবদুল মোমেন একজন বহুমাতৃক গুণের মানুষ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। অধ্যাপনা ছিলো পেশা। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। তবে কর্মসূত্রে পুরোজীবন কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। সবশেষে তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুদিন নিজগৃহে নিরিবিলি অবসর ও অসুস্থ জীবন পার করেছেন।
১৯৪৭ সালের ২৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন খন্দকার আবদুল মোমেন। ব্রিটিশের গোলামি থেকে তখন সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান তৈরি হয়েছে। জন্মেছেন সেই সময়ে উত্তরবাংলার বৃহত্তর রংপুরে। বৃহত্তর রংপুরে এখন পাঁচটি জেলা। তারই একটি গাইবান্ধা। সেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের সীচা গ্রামে জন্ম তাঁর। গাইবান্ধা মডেল হাইস্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে মেট্রিকুলেশন এবং গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি। বাংলা সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেছেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। ১৯৭৬ সালে বাংলা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
শিক্ষকতা পেশার প্রতি আন্তরিক টান ছিলো খন্দকার আবদুল মোমেনের। তাইতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স শেষ করেই রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রিও অর্জন করেন ১৯৭৮ সালে। প্রাইমারি স্কুল থেকেই শিক্ষকতা শুরু। তারপর হাইস্কুলে। এরপরে ঢাকার তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় অধ্যাপনা করেছেন জীবনের মৌলিক সময়। অবসরে যাবার পূর্ব থেকেই দীর্ঘদিন দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনে অধ্যাপনা করেন এবং কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সেইসাথে পার্ট টাইম ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে বাংলা বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। সেইসাথে নর্দান ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী ইউনির্ভাসিটি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সুতরাং প্রাইমারি, হাইস্কুল থেকে মাদরাসার উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত- সর্বত্রই তিনি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
স্কুল জীবন থেকেই সৃজনশীলতার প্রতি ঝোঁকপ্রবণ ছিলেন খন্দকার আবদুল মোমেন। গাঁও-গেরামের সবুজ-শান্ত প্রকৃতি তাঁকে মানবিক মূল্যবোধের মানুষে পরিণত করেছে। শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনকে সুন্দরের পথে এগিয়ে নেবার স্বপ্নটা তাঁকে তখন থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। লেখালেখি শুরু করেছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই। স্কুল ও কলেজ বার্ষিকীতে লেখা ছাপা হতো। গাইবান্ধা থেকে প্রকাশিত মাসিক তিস্তা প্রত্রিকাতেও লিখতেন। তবে লেখালেখির সংখ্যা তুলনামূলক খুব বেশি ছিলো না। তাঁর বেশি ঝোঁক ছিলো সম্পাদনার দিকে। ছাত্রজীবন থেকেই সম্পাদনায় যুক্ত। বিভিন্ন সংকলন, সাময়িকী সম্পাদনা পরিষদে কাজ করেছেন দীর্ঘসময়। সবশেষে তিনি সম্পাদনার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন প্রেক্ষণ এর সম্পাদক হিসেবে।
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রেক্ষণ একটি উল্লেখযোগ্য নাম। খন্দকার আবদুল মোমেন ১৯৯৩ সাল থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে এই পত্রিকাটি সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। ‘প্রেক্ষণ ফররুখ স্মরণ’ হিসেবে ১৯৯৪ সালের ১১ মার্চ প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। কবি ফররুখ আহমদের প্রেক্ষণ নামক কবিতার শিরোনাম থেকেই নামটি পছন্দ করেছেন তিনি। সম্পাদক হিসেবে সফল ভূমিকা পালনের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি এই প্রেক্ষণেই।
প্রেক্ষণের প্রতিটি সংখ্যাতেই পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। চোখের আড়ালে আবডালে এবং ক্রমশ অগোচরে চলে যাওয়া আমাদের শেকড়সন্ধানী মনীষীগণকে নতুনভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রেক্ষণ অনন্য। প্রচলিত ছোটকাগজের ধারণা থেকে খানিকটা সামনের দিকে পা বাড়িয়ে প্রেক্ষণকে তাঁর সম্পাদিত ৪১টি সংখ্যার প্রত্যেকটিকে এক একটি মাইলস্টোন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। প্রেক্ষণের প্রতিটি সংখ্যাই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরিখে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
খন্দকার আবদুল মোমেন নিজেকে সম্পাদনায় যতোটা বিস্তৃত করেছেন লিখনীতে ততোটা মেলে ধরেন নি। খুব কম লিখেছেন তিনি। তবুও তাঁর প্রবন্ধ সংকলন প্রকৃষ্ট বন্ধন একটি অনন্য কাজ বলে গণ্য করা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্য পরিষদ ঢাকা ২০০৫ সালে প্রকাশ করে গ্রন্থটি। ১৬৭ পৃষ্টা টেক্সট সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় অত্যন্ত বিশ্লেষণভিত্তিক আলোচনা করেছেন। এছড়াও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদসহ বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্য মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বলা চলে সম্পাদনার বাইরে এটি তাঁর অনন্য একটি কাজ।
খন্দকার আবদুল মোমেন মাঝে মধ্যে কবিতাও লিখতেন। মহাপ্রভুর ছায়াতলে তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। ২০১৫ সালে ঢাকার ‘বইকারিগর’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এ গ্রন্থটি। তিনফর্মার কাব্যগ্রন্থটিতে ২১ টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতায় মাটি, মানুষ. স্বদেশ এবং মহান প্রভুর প্রেমের এক উচ্ছ্বলা ঢেউ খেলা করে। বাংলাদেশে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবি উল্লেখ করেন- বাংলাদেশী মানুষ!/ বড়ই সহজ সরল অল্পে তুষ্ট আবার / অল্পেই অসন্তুষ্ট; স্বভাবে তার ঝড়ের বৈশিষ্ট্য।’ গ্রন্থের কবিতাগুলো বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যকেই ধারণ করেছে।
কবিতার বই হলেও শুরুতে গ্রন্থকারের অভিব্যক্তি শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংকলিত করা হয়েছে। কবিতা বিষয়ক এ প্রবন্ধটি বেশ গবেষণালব্ধ। সেখানে কবি খন্দকার আবদুল মোমেন উল্লেখ করেন, ‘মানুষের কথা যখন উপমা-উৎপ্রেক্ষায়, অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, রূপক-প্রতীকে সাজিয়ে গুছিয়ে ছন্দ ও সঙ্গীতে মনোরম করে তোলা হয় তখনি তা হয়ে ওঠে কবিতা।’
‘মহাপ্রভুর ছায়াতলে’ কাব্যগ্রন্থের মূল্যায়নে কবি আল মাহমুদ উল্লেখ করেন, ‘খন্দকার মোমেনকে আমি প্রাবন্ধিক হিসেবেই জানি। কিন্তু তিনিও কবিতা চর্চা করেন তা জেনে পুলকিত বোধ করছি। তিনি যা করেন তা আন্তরিকতার সাথেই করেন। তাই তার সকল কর্ম আগ্রহ নিয়ে লক্ষ রাখি। পাঠ করে থাকি।’ তিনি আরো বলেন- ‘কবিতাগুলো শুনে আমি অনুধাবন করলাম খন্দকার মোমেন প্রকৃত প্রতিভার অধিকারী। তার লেখায় প্রভুর ও মানুষের জন্য গভীর ভালোবাসা ও প্রেমের প্রকাশ আছে।’
পরিশেষে বলা যায়, খন্দকার আবদুল মোমেন একজন সাহিত্যসাধক, নিবিষ্ট সম্পাদক এবং আপদমস্তক বিশুদ্ধ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ খাদেম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সম্পাদক এবং সংগঠক। বাংলা সাহিত্য পরিষদের মতো একটি বড় প্রতিষ্ঠানের যেমন দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের একজন যোগ্য সংগঠক হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ রেখে গেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে যেমন তিনি সফল হয়েছেন তেমনি সফল হয়েছেন সম্পাদনাতেও। সেইসাথে সফলতার চমক দেখিয়েছেন তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষায়। বর্তমান সমাজের শিল্পসাধকদের মধ্যে খুব কম ব্যক্তিই আছেন যারা পারিবারিক জীবনে এতোটা সফল হয়েছেন।
শিক্ষকতা পেশার মতো স্বল্প আয়ের সংসারে তিনি পাঁচ সন্তানকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উৎরে নিয়েছেন। খন্দকার আসাদ আবদুল্লাহ গালিব, খন্দকার হাসান আবদুল্লাহ সাকিব, খন্দকার আমান আবদুল্লাহ নাজিব, খন্দকার আজিজ আবদুল্লাহ নাবিল, খন্দকার নওশিন তাবাসসুম নাওমী। ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের জীবনসঙ্গীরাও যোগ্যতার মাপকাঠিতে সফল। সেই কৃতিত্বের ভাগিদার হিসেবে তাঁর মিসেস নাজমুন নাহার মোমেন শিক্ষকতা পেশায় সংম্পৃক্ত থেকেও একান্তভাবে সংসারধর্মে সামিল রয়েছেন। চাকরিসূত্রে সন্তানদের অবস্থান ভিন্ন হলেও একই ছাদের নিচে কলকাকলিতে মুখরিত থাকে পুরো বাড়ি। তাঁদের সংসার সবসময় মৌ মৌ করে সুবাসিত ফুলের সুঘ্রাণে। সেই বাগান থেকে তিনি বিদায় নিলেন মানবিকতার সুবাস ছড়াতে ছড়াতে।