তাজ ইসলাম
মৃত্যু ধেয়ে আসছে কবিদের দিকে। মৃত্যু তো সবার দিকেই ধেয়ে আসে। কবিদের দিকে আলাদা আসার কোন বিশেষত্ব কী? নিজে কবিতা চর্চা করি। কবিদের সাথে পরিচয়, সম্পর্ক অন্যদের তুলনায় বেশি। চেনা অচেনা কবির মৃত্যু হৃদয়কে স্পর্শ করে, আবেগ তাড়িত করে।
পরপর দুইজন প্রিয় পরিচিত কবির মৃত্যু সংবাদ মনে ভাঙচুর ও হাহাকারের ঢেউ ওঠেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে চলে গেলেন দু জন কবি। কাছাকাছি বয়সের। গত ১৬ জুলাই মারা গেলেন নব্বই দশকের অন্যতম কবি মহিবুর রহিম। মহিবুর রহিম যে রাতে মারা গেলেন সে রাতে আমি একটু আগেভাগেই ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিলাম। হাতে মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকেই চোখে পড়ল মহিবুর রহিমের মৃত্যু সংবাদ। কিছুই ভাবতে পারিনি। অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। দ্রুত আরও কয়েকজনের ওয়ালে গেলাম। সত্যই কবি আর নাই। কত তরতাজা মানুষ। মুহূর্তেই স্মৃতি!
এক মাস যাবৎ একটা কাজ করছি। প্রতিদিন এখানে সময় দিতে গিয়ে একটু চাপ অনুভব করি। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ঢুকি। মহিবুর রহিম মারা যাওয়ার পরপরই একটি দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক ফোন করেন কবিকে নিয়ে একটি গদ্য দিতে। হাতের কাছে অনেক কাজ জমা। সব রেখে সারাদিনে মহিবুর রহিমের উপর একটা গদ্য দাঁড় করিয়ে বিকেলে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্ত পরে আর তা ছাপা হল না। পরের সপ্তাহের অপেক্ষায় ছিলাম। পরের সপ্তাহেও যথারীতি ফেইল। যেহেতু লেখা চেয়ে নিয়েছেন তাই আমি আর অন্য কোথাও দিইনি। তারপর ভিন্ন আরেকটি লেখা লিখে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দিলাম। এসব বলার অর্থ লেখা ছাপল কি ছাপল না এর জন্য না। এসব লেখায় হৃদয়ের কান্নাগুলো রোপন করা হয়। কবির সাথে কবির সম্পর্ক, কবির প্রতি অন্যদের অবহেলা, কবি জীবনের যাতনা ও অনুভবের কথা বলা হয়ে থাকে। একজন কবির জন্য অন্য কবির বেদনা ফোরাত প্রকাশ করা হয় এসব লেখায়।
হায় আল্লাহ! এক শোক সইতে সইতেই আরও এক শোক সংবাদ দোয়ারে হাজির। এক মাসের ফরমায়েশি লেখালেখি আজ সমাপ্ত করলাম। একটু হালকা লাগছিল শরীর। চেম্বার রেখে চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে আবার আসলাম। ফেসবুকে যাইনি অনেকক্ষণ। নিজের আসনে বসেই মোবাইল হাতে নিলাম। ফেসবুকে প্রবেশ করতেই বিলাপ হয়ে ভেসে উঠল শাহিদ উল ইসলামের মৃত্যু সংবাদ। শাহিদ উল ইসলাম আমার বয়সী। তিনি মারা গেছেন। প্রথম পোস্টের পর আরও কয়েকজনের ওয়ালে গিয়ে নিশ্চিত হলাম মৃত্যুর চিল ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে আরও এক কবিকে। শাহিদ উল ইসলাম আমাকেই খুব ভালবাসতো নাকি অন্য কবিদেরও ভালোবসতো তা জানা হয়নি। তবে আমার সাথে মাঝে মাঝেই কথা হত। শেষ বই প্রকাশ হলে আমাকে কপি দিলেন। আলোচনা করার জন্য সে কি তাগাদা। করে দিলাম। তারপর কত কথা! একদিন চলে এলেন আমার এখানে। সেদিনই জানতে পারি তার সংসার জীবনের না জানস আরেক অধ্যায়। বিবাহিত জীবনে এক সন্তানের জনক তিনি। কিন্ত তিনি ছিলেন একাকীত্ব জীবনের ব্যথাতুর সৈনিক। আমার সাথে একান্ত কথায় কবিকে পুরোপুরি সুস্থ মনে হয়নি। মানসিকভাবে সুস্থতার মাঝে সামান্য অসংলগ্ন। একটু এবনরমাল। সাহিত্য জীবন নিয়ে অভিমান চলে আসছিল। প্রায়ই ফোনে কথা হত। শেষ দিকে তার সাথে কথা হত কবিতা বা সাহিত্যের চেয়ে ব্যবসায়িক কথাবার্তা বেশি। তিনি শেষ সময়ে ফার্মেসী বা ঔষধ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। কোন বিষয়ে আটকে গেলেই ফোন করতেন। একটু লাজুক লাজুক ভাব থাকত। দুয়েক দিন এমন হবার পর স্বাভাবিক হয়েছিলেন। একটু কোথাও সমস্যা হলেই তিনি কল করতেন। আমি আমার সীমিত জ্ঞানে পরামর্শ দিতাম।
আজ হুট করে শাহিদ উল ইসলাম চলে গেলেন। তার সাথে সর্বশেষ সাহিত্য আড্ডা সম্ভবত লালকুঠি দরবার শরীফেই দিয়েছিলাম। লালকুঠি তার স্মৃতিকাতর জায়গা। বহু বছর এখানে তিনি ছিলেন। কবিধ্বনি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কবিধ্বনির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কবি আল মাহমুদ এসেছিলেন। এই স্মৃতি তার চেহারাকে উজ্জ্বল করে ফেলত।
কবি শাহিদ উল ইসলাম! এত তাড়াতাড়ি স্মৃতি হয়ে যাবেন ভাবতেই পারছি না। মৃত্যুটাও তার কেমন যেন ঘোর লাগা। অসুস্থ হলেন। শ্বাসকষ্ট অনুভব করে নিজেই অটোরিকশা ডেকে শফিপুর থানা হাসপাতালে গেলেন। ওখান থেকে চিকিৎসক অক্সিজেন লাগিয়ে দ্রুত কুমুদিনী হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। যেতে যেতেই চলে গেলেন চিরতরে। দুঃখ ভরা হৃদয় যেন অভিমানী বালকের মতো ছেড়ে গেলেন এই পৃথিবী। কয়েকজনকে ফোনে খবর জানালাম। রেদওয়ানুল হককে কল করে কথা বলতে বলতেই নিজের কথা মনে হল। মহিবুর রহিম চলে গেলেন। শাহিদ উল ইসলাম চলে গেলেন। তাদের মৃত্যু আমার মৃত্যুকেও স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল। মনে হল আমারও যেন ফুরিয়ে আসছে সময়। আমি আর কথা বলতে পারলাম না। বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম। আয় মাবুদ! কবিদের জন্য জান্নাতে কবিতা পাঠের আয়োজন মঞ্জুর করো। শাহিদ উল ইসলাম আর কোন দিন ফোন করে বলবেন না কবি.....!
আল্লাহ আপনাকে, মহিবুর রহিমকে জান্নাতবাসী করুন।