পথিক মোস্তফা

কবি নয়ন আহমেদ একজন আপদমস্তক ঈমানদার কবি। তিনি সম্পূর্ণই মহান আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল কবি। সংশয়বাদীদের দলে তিনি নন। তাঁর কবিতার প্রতিটি বর্ণ-বয়নে লেগে থাকে অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ। তিনি খ্যাতির উর্ধ্বে থেকে কবিতার চাষাবাদ করেন। গোধূলির আবির আর প্রভাতের আলো মেখে বেড়ে ওঠে কবির কবিতার শরীর। সবকিছুর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান স্রষ্টার নিবিড় অস্তিত্ব। কবি নিজে এবং তাঁর লেখনি সম্পূর্ণই গড়ে ওঠে পবিত্রতম শব্দের ইট-কাঠে। তাঁর কবিতায় আছে মানব-মানবীর জাগতিক প্রেম, সাংসারিক জীবনের দুঃখ-বিরহ-ভালোবাসা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাবলিল বিবরণ, আর প্রভুর প্রেমের অনির্বচনীয় আধুনিক বয়ান। কবির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি খুব নিপুণ হাতে সাধারণ দৃষ্টির বাইরে গিয়েও দেখা বস্তুর মাঝে অদেখা স্রষ্টার অস্তিত্ব ফুটিয়ে তোলেন কী নিখুঁত কারুসৌকর্যে! এজন্য কবির এক অনন্য জগত তৈরি হচ্ছে। তাইতো বিরুদ্ধবাদীরাও কবির কবিতায় ধর্মের ব্যবহারকে কোনোক্রমে খাটো করার সাহস দেখান না। এক্ষেত্রে তিনি এক কুশলী কারিগর। কবির কবিতার বিষয়াঙ্গিক সম্পর্কে নিজেই বলেন-

‘আমার মনে আছেÑ প্রথম মানব-মানবীর কথা। পৃথিবী চাষবাসের কথাÑপৃথিবীর ইতিহাসের কথা, সভ্যতার কথা। আমি নূহের সাথে ছিলাম তাঁর নৌকোয়, ঈসার সাথে ছিলাম, নবি মুহাম্মদের সা. সাথে ছিলাম এবং সর্বত্র থাকি আমিÑ আমি ভবিষ্যতেও থাকবো। আমি কবিতায় সভ্যতা-সংস্কৃতির এ দিকটাকে তুলে আনি, ফুল ও ফসলের ঘ্রাণ আনি, নারীর প্রেম আনি, সূর্যের সাথে উঠি আমি তাই আলো আনি- মার্কস-লেনিন সেখানে ডুবে যায়, তাদের অসারত্ব পাঠ করি প্রিয় কোনো গ্রন্থের মতো- অনন্তলোক আরো বেশি ভালোবাসি বলে মাটি থেকে একটা উঁচু মই সেখানে স্থাপন করি। এ কাজটাই করতে চাই কবিতায়।’১

একজন কবি তার রঙিন রাজ্যে গড়ে তোলেন সোনালি শব্দের বাগান। চিত্তাকর্ষক শব্দ আর বাক্যের মোহনিয়তায় পাঠককে টেনে আনার আর ধরে রাখার দায় কবির নয়; এটা কেবল কেতাবি বাক্য। আসলে কবি-সাহিত্যিক পাঠককে আকর্ষিত করার কৌশল নেন বটে। আর সে টান তৈরি করতে গিয়ে কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক হয়তো মনে করেন, অশ্লীল ভালোগারিজমে কাব্য বা গদ্য শরীর ভরে দিলে সমকালীন পাঠক তো তালি বাজাবেন; আর মরে গেলে পৃথিবীর মানুষেরা কে কী বিচার-বিশ্লেষণ করলো সাহিত্যের, কবিতার তাতে কি-ই বা আসে যায়। এমনটি সর্বৈব যে সঠিক তা নয়। তবে বেশির ভাগ কবি-সাহিত্যিকেইতো আজকাল দেখি, ধর্ম নিয়ে বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে গাত্রদাহ হতে কিংবা কুরুচিকর শব্দের ইঙ্গিতময় পোজ দিয়ে কবিতার বা গদ্যের ক্যানভাস সাজাতে, তাই এ- কথা বলা। কিন্তু নিজের কাব্যগাঁথুনিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে মোটেও শঙ্কিত নন, কবি নয়ন আহমেদ। তিনিই এ সম্পর্কে বলেনÑ

‘কবিতায় ধর্মের ব্যবহারে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে আত্মস্থ করে কাব্য চর্চায় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। নজরুলে কি আমরা ধর্মের ব্যবহার দেখি না? তাঁর ‘খেয়াপারের তরনী’ কী কথা বলে? তাঁর অনেক কবিতাই তো ধর্মের বিশাল বলয়কে ধারণ করেছে। তিনি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। ফররুখে আমরা কী দেখি? তাঁর ‘সাতসাগরের মাঝি’ গ্রন্থটিতে ধর্মের ব্যবহার কি ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেনি? আজকের আল মাহমুদও লোকজ জীবনের পাশাপাশি ধর্মীয় মিথ-ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন সচেতনতার সাথে। তবে মনে রাখতে হবেÑসবার আগে চাই কবিতা, কবিতা করে তোলা। শ্রেষ্ঠ বা মহৎ কবিতায় ধর্মের আবেগ জড়াজড়ি করে থাকতে পারে। এখানে ধর্ম শাশ্বত দর্শনেরই সমার্থক বা প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে। কবিতা সবকিছুর সমন্বয়ে নিজেই একটি ধর্মÑ একটি বিকল্প ধর্ম। ধর্মের ব্যবহার করলেও তা বিকল্প। তা কখনোই ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে না; তা কবিতাই, একমাত্র কবিতা। আমি কুরআন থেকে অনেক রহস্য উদ্ধার করি, কিন্তু কুরআন লিখি না। তার ভাষা আমাকে মুগ্ধ করে কিন্তু আমার ভাষা কুরআন হয় না। আমি কবিতারই লোকÑআমি সবকিছুই কবিতা করে ফেলি। আমি ভাষাকে বইয়ে যেতে দেই প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেÑ জনস্রোতের মধ্যে; কিন্তু রহস্য রেখে দেই আমার হাতেÑ ও আমারই সৃষ্ট, ও আলাদা। তাই চোখে পড়বে ও তো কবিতা-সুন্দরী। কেন ধর্মের ব্যবহারে কবিতা অসুন্দর হবে? আমি নিশ্চিতÑ এতে কবিতা আলোময় হয়ে উঠবে।’২

এই যে কবির বিশ্বাস, যে কবির কবিতায় এমন চরণবোনেন সেই কবি নিশ্চয়ই মুমিন-মুসলিম কবিদের অন্তর্ভুক্ত। কবির ভাষা এমনÑ

আর দ্যাখো, আমি কবি আল্লা’র রঙে; সবরকম ক্রোধের উর্ধ্বে যাই।

ঘৃণার ব্রীজ তুচ্ছ করে যাই।

ঐ সুন্দরী কন্যাটির টেবিল ক্লথ ধরে যাই।

জানালায় আমার কন্যাই হাত নাড়ে; মানে সালামের বিনিময়

আমি বিনিময়ের গম্বুজ ধরে যাই

সুন্দরতম প্রত্যূষের ইঙ্গিত নিয়ে যাই।

আমি যেতে থাকি

...................

অভিযোগকারীবৃন্দ, দরোজায় কেন ঘৃণার সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে?

তোমাদের ঘৃণার মলাট তোমাদের কাছেই ফেরত যাক।

না, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছিÑ আমি কোনো পরিচর্যাহীন বাজারে যাই না।

‘ইন্নাল্লাহা মা-আছ ছাবেরীন’- আমি তো তাঁর ধৈর্যের বোরাকে চড়েছি।’৩

কবি নয়ন আহমেদ মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় নত হন। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য অবিরাম এক সচল ভোরের নিবেদন করেন। তিনি মহান রবের কাছে সচল একটা জীবনের জন্য আবেদন করেন। এ পৃথিবীর গতির সাথে তিনি এগিয়ে যাওয়ার বাসনা পোষণ করেন। সদা ঘূর্ণায়মান এ পৃথিবীতে সজীব জীবন-যাপন করাই হলো বেঁচে থাকার আরেক নাম। কবি যেতে চান একটি সুন্দর আগামীর দিকে; কবির গতি একটি মায়ামায়া সৌন্দর্যের আঁধার এ পৃথিবীর চতুর্দিকে। যেখানে কবি দেখেন, কুরআনের মধুর তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বাবা ভোরকে নিমন্ত্রণ করছেন, আর সূরা ইয়াছিন তিলাওয়াত করে মা মহান রবের কাছে প্রার্থনা করেন। কবি বলেন-

আমি যাই।

‘ফাবি আইয়ে আলা ই রাব্বিকু মা তুকাযজিবান’ বাবার নিমন্ত্রিত ভোরÑযাই।

‘ইয়াছিন। অল কুরআনিল হাকিম ...’ মায়ের নিবেদিত প্রার্থনাÑ যাই।

আপনার সলজ্জ অভিধান ঘাটের মাঝিকে পৌঁছে দেবো।

আমি যাই।৪

কবি নিজেই বলেন, কোরানিক ভাষা তিনি আয়ত্ত করেন, সেই ভাষা তাঁর অনেক পছন্দ, তিনি ভালোবাসেন কুরআনকে। তাইতো তিনি কোরানিক ভাষায় কবিতা লেখেন, কিন্তু কুরআন লেখেন না। আর একজন ঈমানদার কবি এ ধৃষ্টতা পোষণও করেন না কখনো। তিনি আল কুরআনের অসম্ভব সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই ভাষায় কবিতা প্রকাশ করেন। তা শুধুই কবিতা, অন্যকিছু নয়, কুরআন বানানো ব্যর্থ চেষ্টাও নয়। কবির ভাষা এমন-

আমার হাতের মুঠোয় মৃত্যুÑ মুঠো মুঠো ধ্বংস।

মৃত্যুর আহ্বানেই রক্ত ও মাস্তুল খুলে দিলাম।

তার গৌরব পরলাম আংটির মতো।

শপথ, আমি যাচ্ছি উষ্ণতার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে।

সমস্ত রৌদ্র ও প্রভাত আমার বাহন।

না। কোনো মিথ্যে শপথ আমার কণ্ঠ ধারণ করে না।

জিহ্বা স্পর্শ করে না স্তুতির বোঝা।

আমি আজীবন জেনে আসছি, কিষাণীর জিকিরেই

ভোর শুরু হয়।

আমি ছাড়া আর কে আনবে ভোর।৫

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই কবি এগিয়ে যান সত্যের পথে। কবি বলেন, ‘রৌদ্র ও প্রভাত আমার বাহন’ এখানে ‘রৌদ্র ও প্রভাত’ শব্দদ্বয় কবি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। সকল অন্ধকারের জীর্ণতাকে ছাড়িয়ে কবি এ-পৃথিবীতে মহান আল্লাহর তাওহীদের আলো ছড়িয়ে দিবেন, তিনি ছড়িয়ে দিবেন রিসালতের প্রভাত। কবি সত্যের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেন। কবি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘কোনো মিথ্যে শপথ আমার কণ্ঠ ধারণ করে না।’ বাঙালি মুসলমানদের আবহমানকালের একটি রেওয়াজ ভোরের জিকির বা সুবহে সাদিকের পর পাড়া-মহল্লায় সুর করে আল-কুরআন তেলওয়াত। কবি এ মিথের ‘জিকির’ শব্দটি ব্যবহার করেও মুসলিম সমাজের একটি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করেছেন। আর বিশ্বাসী কবির প্রত্যয় ‘আমি ছাড়া আর কে আনবে ভোর।’ এ ভোর মহান আল্লাহর তাওহীদের আলোর বিচ্ছুরণ বলে আমরা ধরে নিতে পারি। (চলবে)