মুসা আল হাফিজ

নদী প্রতিদিন অনন্তের সাথে প্রেম করে, আবার প্রতিদিন নিজের ক্ষুদ্রতাকে মেনে নেয়। নদীর জন্ম কোনো এক পুরনো চুম্বনের ব্যথা থেকে Í যখন আকাশ আর পৃথিবী প্রথমবার আলাদা হয়েছিলো। নদীর সাথে কথা বলেছি অনেক। সে কখনোই নিজের জন্মের গল্প ভুলে না; তার প্রতিটি ঢেউয়ে থাকে সেই প্রথম বৃষ্টির স্মৃতি। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো গল্প নদীর বুকে লেখা বালির চিঠিতে, ঢেউয়ের কবিতায়, চুপচাপ চোখের জলে। নদীতে আমরা দেখি পানিস্রোত, কিন্তু সে একই সাথে বহন করে মৃতদের স্বপ্ন আর জীবিতদের আকাক্সক্ষা।

নদীর পানি শুকিয়ে গেলে মাটিতে পড়ে থাকে সেইসব প্রতিশ্রুতির ছাপ, যা কোনোদিন রক্ষা করা হয়নি। সে যখন শুকায়, তার গায়ে লেগে রয় হাজার বছরের পদচিহ্ন, ভুলে যাওয়া প্রেমিকের চিঠির মতো। কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া শীতের নদীকে আমি জানি। সে আসলে এক ঘুমন্ত স্মৃতি তার স্তব্ধতার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে ভবিষ্যতের বন্যা।

নদীকে বলেছিলাম, তোমার ঢেউগুলো আসলে ভূতের মতো; পুরনো যন্ত্রণার ছায়া টেনে আনে বর্তমানে , আবার তাকে ফেলে দেয় দূর অতীতে। নদী হাসলো। বললো, আমাকে তুমি পাঠ করতে এসেছো। কিন্তু আমাকে আবিষ্কার করা কঠিন। যদি বন্ধু হও, বন্ধনের ভেতর থেকে পেতে পারো আমার নামতা।

নদীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলছে আমাদের মিতালি। কত গল্প, কত স্মৃতি, কত উন্মোচন। এই তো সেদিন। খেতের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে নদী। আমি ছিলাম সঙ্গে। দেখলাম, সময়ের সাথে ধানখেতের আত্মীয়তা। উভয়েই বেড়ে উঠছে নদীর দুধে। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতায় শহরের নিচে গলিপথের মতো বয়ে যাওয়া নদীতে দেখেছি ভিন্ন পাঠ। সেখানে ছায়া আর পানি মিলেমিশে অপরাধ ও প্রার্থনার ভাষা শেখাচ্ছিলো।

ঝড়ে উথলে ওঠা নদীতে দেখেছি নীরব ক্ষোভে ফেটে পড়া এক জনমের সংহতি। বৃষ্টির রাতে অরণ্যের ভেতর দিয়ে ঢল নামানো নদীকে মনে হয়েছিলো মত্ত এক আদিম স্তন্যপায়ী, যার ভাষা প্রতিধ্বনিত হয় আমার রাত্রিতে, উদ্দামতায়। রোদের ভেতর জ্বলন্ত দুপুরে শস্যক্ষেতের ফাঁক গলে বয়ে যাওয়া নদীতে দেখেছি ঘামের ভিতরে মাতৃস্নেহের হাসি ।

চরের বালুকণায় স্মৃতির দাগ বিলিয়ে দেওয়া নদীকে ভেবেছি প্রিয়চেহারার বিদায়ের শব্দহীন সান্ত্বনা। জনপদের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীÍযার প্রতিটি ঢেউয়ে শিশুর হাসি আর মায়ের পায়ের চলাচল খেলে যায়। নদীর বন্ধু হবার মানে নদীর রূপসমুহকে পান করা নয়, তার রূপসমূহের পানি হওয়া।

তারা বললো, নদীকে আপনি বেশি অর্থ দিয়ে দিচ্ছেন। নদী তো প্রতিদিন নিজের মৃত্যু অনুশীলন করে। বললাম, ঠিক, নদী প্রতিদিন নিজের মৃত্যুর অনূশীলন করে, যাতে আগামীকালের জন্মটা সুন্দর হয়।নদীর ভিতর জন্ম নেয় অজস্র অসমাপ্ত গান, যাদের কোনও শিরোনাম নেই, শুধু গন্ধ আছে সময়ের। নদী তার জল হারায়। কিন্তু হারানো জল কাঁদে না; তারা বাষ্প হয়ে আকাশের পথে নাচে। নদীকে অর্থ দিচ্ছি, কারণ সে অর্থ তৈরী করে অবিরাম।

তারা বললো, নদী অনিয়ন্ত্রিত, বাঁধ মানে না। বললাম, নদীকে বাঁধতে যাওয়াটাই ভুল। কারণ মানুষ তাকে বাঁধতে গিয়ে শুধু নদীকে নয়, নিজেদের ভবিষ্যতকেও বেঁধে ফেলে । তারা বললো, তাহলে কি নদী ভাঙবেই? বললাম, ভাঙনের শব্দই নদীর ভাষা, কিন্তু গড়ার নিঃশব্দতা তার প্রকৃত সাধনা।

তারা বললো, নদীকে বিশ্বাস করা ভুল। কারণ সে বহুরূপী। বললাম,

নদী প্রেমও বটে। বিলীন হতে পারে সে। প্রেমিকের মতো নদীস্রোতও জানে হারাতে হয়; কখনো নিজের শীতলতা, কখনো নিজের গভীরতা, কখনো নিজেকেই। নদী বাঁক নেয় , ঠিক। কিন্তু প্রতিটি বাঁক নদীকে আরও বিচক্ষণ করে তোলে। নদী পথ বদলায় বটে। কিন্তু সে হঠাৎ পথ বদলায় না; সে ধীরে ধীরে ভূগোল বদলায়।

তারা বললো, নদীর মন বুঝা যায় না, এখানে কোনো কপটতা নেই? বললাম,

নদীর মনে প্রবেশ না করলে তার মন বুঝা যাবে না। সে কপট নয়। সে কখনো শান্ত। যখন সে শান্ত, তখন তার নিচে শত বছরের লড়াই জমা থাকে।নদী যখন ধীরে প্রবাহিতÍতখন সে দর্শনের নদী, প্রশ্নহীন জ্ঞানপ্রবাহ।

ভরা বর্ষায় নদীÍযেন নিয়তির চোখে টলমল করা এক দীর্ঘ আত্মজীবনী। নদী প্রতিটি বাঁকে বলে, জীবন কখনো সোজা ছিল না, হবেও না কখনো। বহমান নদীতে আমাদের সাঁতরাতে হয়। কিন্তু আমাদের প্রতিটি সাঁতার নদীর বিরুদ্ধে নয়, নিজের ভিতরের স্থবিরতার বিরুদ্ধে।

নদীর মনকে বুঝতে হবে নদীর আচরণে। সে যখন ছোট নদীকে গ্রহণ করেÍ তখন সে মাতৃত্বের পূর্ণতম রূপ। নদীর ফেনাÍযা এক মুহূর্তে আসে, আর এক মুহূর্তেই হারায়, তবু তারও একটা জীবনী আছে। নদী যখন শুধু বয়ে যায়, তখন সে নিছক এক দৃশ্য নয়, সে সময়ের অবিরাম আত্মপ্রকাশ।

নদীর গভীরে যে কাঁদা, তা আসলে ইতিহাসের জমা পাপ। একটা নদীর বাঁক দেখে বোঝা যায়, সে জীবনে কতগুলো ভুল ঘুরে এসেছে।

ভাঙনের মুখে নদীÍ সে নিজেকেই ভেঙে দেয়, যাতে অন্য কেউ গড়তে পারে। নদী যখন চর বুনে Íসে তখন নিজের ইতিহাস লিখে নিজের বালিতে। ভাটার সময় ফাঁকা নদীÍযেন জীবনের পিছনে ফেলে যাওয়া আত্মা।

নদী যখন শহরের ড্রেন হয়ে পড়েÍতখন সে নিষ্পত্তিহীন বিবেক। নদী যখন দুই দেশ ভাগ করেÍতখন সে নিজের নাম ভুলে যায়, আর শুধু সীমান্ত হয়ে ওঠে। নদী যখন দুই পাড়ে দুই ধর্মের মানুষÍসে তখন নিছক ধর্মের ঊর্ধ্বে একটা চলমান উপাসনালয়। আবার নদীর পাড় বুঝিয়ে দেয় যার যার সীমা। নদীর পাড় শুধু নিরাপত্তা নয়, প্রান্তেরও সংকেত।

এখানে নদীর ভূমিকাকে অনুভব করতে হয়। কিন্তু মানুষ যখন নদীর মনকে ভুলে যায়, সে তখন কেবল ভূগোল হয়ে পড়ে, অনুভব নয়। অনুভবের মধ্য দিয়ে নদীকে না বুঝলে আমরা তাকে ভুল বুঝি। জুলুম করি। নদী প্রতিশোধ নেয়। ফলে নদী যখন মানুষকে খায়, তখন তার চোখে পানি থাকে না, থাকে ক্ষমাহীনতা।

ফলে নদীকে প্রতিপক্ষ ভাবতে নেই। নদী মানে শুধু জল নয়, নদী মানে জায়গা, স্মৃতি, ভূমি, ভাষা, ও হারিয়ে যাওয়া কোনো মাতৃকণ্ঠ। সে যখন হারিয়ে যায় মানচিত্র থেকেতখন মনুষ্যসভ্যতা একটু একটু করে ছোট হয়ে যায়।

নিজের বিচিত্র প্রবণতার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত নদী যা রেখে যায়তা তার নিজের নয়, বরং আমাদের সম্মিলিত ইতিহাস।

তারা বললো, নদীর মনের সান্নিধ্য কীভাবে আমাদের মনকে সমৃদ্ধ করে? বললাম, শতভাবে।

নদী যখন অশ্রু হয়ে নামে, তখন মরুভূমিও রঙিন হয়। অন্ধকার রাতে নদী তার ভেতরের চাঁদ জাগিয়ে তোলে।পাহাড়ের অশ্রু দিয়ে জন্ম নেয় যে নদী, তার মন উদ্দাম, স্বাধীন। তার কাছে কোনো শাসকের দাম নেই।যখন যুদ্ধ শেষ হয়, তখন নদীই প্রথম জীবনের সংবাদ নিয়ে আসে।

নদীর মনে গভীর বেদনা। প্রত্যেক নদী বহন করে কোনো এক হারানো শহরের বিলাপ। নদী আমাদের দেখিয়ে-শুনিয়ে কাঁদে না, অথচ পৃথিবী তার কান্নায় তলিয়ে যায়। তুমি নদীকে কী বলো, তাতে নদীর কিছু যায় আসে না Í তার মন শুধু বয়ে চলে নিজের নিজস্বতার দিকে। নদীর প্রতিটি ঢেউ বলে, আমি ছিলাম, আমি ভেঙে পড়েছি, আমি গঠিত হচ্ছি আবার।

শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে মোড়া নদীর মন, যেন স্মৃতিভেজা কোনো অচেনা মুখ, হাত বাড়ায়, ডাকে। সে ডাকে কীসের প্রতি, ব্যাখ্যা করে না। বলে, খুঁজে নাও!

ভরা পূর্ণিমায় নদী যখন পলিমাটির ঘ্রাণে আলো ঢালে তখন তার মন ধ্যানমগ্ন ডায়োজিনিস, নিজের শরীরে ঢালছে গোসলের রোদ।

তীব্র গরমে পিপাসায় ফেটে যাওয়া শুকনো খালে দাঁড়িয়ে থাকা নদীর মন যেন বিস্মৃত আত্মজ, যার ভাষার ব্যাকুলতা উপচে পড়ছে মায়ার পিপাসায়।

উদয়ের প্রথম আলোয় নদীর মনকে পড়তে চেয়েছি। দেখলাম, সে মন কেবল পাখির চোখেই দৃশ্যমান, মানুষের চোখ সেখানে শব্দই শুনে না। পাখি ও নদীর বোঝাপড়ায় আছে মানুষেরও জরুরী কিছু অধ্যয়ন। চাঁদহীন রাতের নদীতীরে একাকী আমি ভীত হচ্ছিলাম। নদী হেসেছিলো। বলেছিলো , চাঁদহীন অন্ধকারে আমার ধ্বনি ভয় নয়, বরং বিস্তার শেখায়।

শস্যভরা মাঠে নদীর সান্নিধ্যের কথা মনে আছে। নদীর সাথে ভূমির বিবাহের ফসল উর্বর খেত, যা দেখে কৃষক হাসে,আর নিঃশব্দে চাষ করে বিধাতার অদৃশ্য হাত।

উজাড় ভূমির বুকে ছায়াহীন নদীর মনে দেখেছি জীবনরেখা, সে মৃত্যুকেও সিক্ত করে।

তপ্ত বিকেলের নদীতে শিশু কাদা মেখে সাঁতারে নামে তখন নদীর মন সেই মাতৃগর্ভ, যা শিশুর আনন্দ ও উদযাপনকে লক্ষ বার জন্ম দিতে চায়।

অরণ্যে গা ঢাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মনের প্রতিটি মোচড় প্রাগৌতিহাসিক নীরবতাকে ব্যাখ্যা করে। দূরগ্রামের সন্ধ্যায় মেঘলা আকাশে নদীর মন যেন বাতাসে লেখা এক প্রেমপত্র, পড়া যায় না, অনুভব করা যায়।

চরে গজিয়ে ওঠা ঘাসে নদীর মন ঢেউ হয়ে খেলে যেন কেউ চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত পৃথিবীর।

পাহাড়ি ঢালে নদীর মন নাচে, সে গহীন। কিন্তু সে উপর থেকে পতনের মধ্যে খোঁজে অভিযানের উল্লাস।

জলডুবির সময় নদীকে হিংস্র মনে হয়। কিন্তু তখনও তার মনের দিকে তাকালে দেখা যায় সে গ্রাম, ঘর, মানুষ, পশু সবকিছুকে নিজের মধ্যে নিয়ে নেয় এক অতল আত্মসমর্পণে। ধূলিঝড়ের মধ্যে নদীর মনের পানিও মাটি হয়ে যায়, শুধু থেকে যায় প্রবল প্রবাহ। রোদে চকচকে বালু ও তার উপর দিয়ে চলা স্রোতের মনে থাকে দিন ও রাতের মধ্যবর্তী চিত্রকল্প।

মেঘলা বিকেলে নদীর মন অন্য রকম। সেখানে আলোর ভিতরে চুপিচুপি মৃত্যুর ছায়া নামে।

শরতের নদীর মনে দেখেছি স্বচ্ছতা, যাতে নিজের অস্থিও দেখতে পাওয়া যায়।

একদিন একটি নৌকা নিয়ে দিনভর খেলা করলাম নদীর বুকে। ক্লান্ত বিকালে ঢেউগুলো বারবার নড়ে ওঠলো। বললাম, কী করছো, সে বললো, আপাত বিদায়ের খাতায় স্বাক্ষর করছি। ঘরে যেতে হবে, নীড়ে যাও। তারা জানতে চায় নদীর আখলাক। বললাম, দেখো, নদী কখনো হাঁটে, কখনো দৌড়ায়, কিন্তু থামে না যেন সময়ের জলীয় রূপ। নিজের আদিসূত্র তার চরিত্রকে আকার দেয়। বাঁকে বাঁকে তার মনে পড়ে জন্মক্ষণের পাহাড় তাই সে ফিরে তাকায়। ফিরে তাকায় বটে, কিন্তু সেটাও প্রশ্নহীন নয়। তার প্রত্যেক বাঁকে আছে একটা মনস্তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা কেন সোজা যাইনি?

তার সুর উঁচু আবার নীরবও। নদীর গভীরে সাঁতার কাটা মাছেরা চেনে নীচু কণ্ঠের সেই নিয়মিত সুর। সেখান থেকে তারা শিখে কীভাবে ধরা না পড়ে নদীতে থাকতে হয়। আবার নদী গর্জন করে ঝড়ে। তখনও কিন্তু নদীর চোখ লাল হয় না, কেবল তার স্বরটা গাঢ় হয়ে ওঠে। নদীর ভিতরে থাকে এক গোপন নদী যাকে শুধু সাঁতারুরা চিনে। তারা দেখে, প্রতিটি মোহনাই নদীর একেক মুখ যেখানে সে নিজেকে বলে, নীরবে। এই নীরবতার আছে মায়াবি হাত। তা দিয়ে নদী একবার ছুঁয়ে গেলে, তোমার শরীরে চিরকালীন অনুপস্থিতির গন্ধ লেগে থাকে।

নদী ভালোবাসার মতো যত গভীর, তত অন্ধ; যত স্বচ্ছ, তত নিষ্ঠুর। সে আপনার জন্য নিরাপত্তা, কিন্তু তার স্বাধীনতার শর্তে। তাকে পরাধীন করতে চান? চেষ্টা করতে পারেন। নদীর দিক পাল্টালে নদী ক্ষিপ্ত হবে না; কেবল একদিন এসে তোমার শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে চিরায়ত মানুষের মতো যত বাধা দাও, তত তার প্রবাহ চতুর হয়ে ওঠে। তাকে উপেক্ষা জারি রেখেছেন? তাহলে সেও উপেক্ষা জারি রাখবে। নদী কখনো আপনাকে বাঁচাতে আসবে না; সে নিজের গান গাইবে, আপনি শুনুন আর না শুনুন।

সে যে গান গাইছে, তা আপনার জন্য। বলছে, যেখানে নদী হারিয়ে যায়, সেখানে মানুষও নিজেকে খুঁজে পায় না। কিন্তু তুমি যদি নদীর স্রোতে হারানো কাঠের টুকরোও হও, পানির নিচেও তোমার চারপাশে থাকবে জীবনের গল্পের আসর।

আমার সাথে এসো এবং সাঁতরাও। সাঁতারের সময় মানুষ আসলে নিজের মধ্য দিয়ে নদীকে পার হয়। এসো যাত্রা করি, সব যাত্রা মূলত মাটির কাছে আত্মসমর্পণের আরেকটি নাম। নদী পার হতে হতে তুমি বুঝবে জীবনকে , কারণ তাকে কখনোই পেরোনো যায় না; প্রতিবার নতুন করে তলিয়ে যেতে হয়।

নদীর সাথে তোমার প্রতিটি যাত্রায় সে কেবল বয়ে চলবে না; বরং ভেতর থেকে তোমার পাথরগুলোকেও গোপনে বদলে দেয়। প্রতিটি ঢেউ প্রশ্ন করবে: তুমি এখনো বেঁচে আছো নাকি ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছো? বলবে, পানির মধ্যে নিজেকে দেখো এবং বুঝো, তুমি কি আসলে অন্য কারো ভুল স্বপ্ন? চলতে চলতে তুমি দেখবে নদীর ফেনা গড়িয়ে যায়; কেবল বেদনার গন্ধ পড়ে থাকে। দেখবে, নদী প্রতিবার ভুল রাস্তায় নেমে নতুন মানচিত্র আঁকে, কখনো রাস্তা দেখায় না; সে শুধু হারিয়ে যাওয়ার কৌশল শেখায়। নদীও যদি নিজের গতিপথ নিয়ে অহং করত, তবে সে আজও এক গর্তেই ঘুরপাক খেত।

প্রতিটি ছোট নদী বলবে, আমরা আরো বেশি বড় হবার স্বপ্ন দেখি না কারণ আমরা জানি, অন্যের আকার নয়,বরং নিজস্বতা এবং বয়ে চলার গতিই শ্রেষ্ঠ। এ যাত্রায় মৌসুম বদলাবে। সে বরাবরই থাকবে লক্ষ্যের দিকে, গন্তব্যগামী । নদী তাই একটি অনন্ত ধারণাকে উচ্চারণ করছে, সেটা হলো রূপ বদলায়, সত্য

বদলায় না।

নদীকে কষ্ট দেয় আবর্জনা। যা দিয়ে তার বুকে ক্ষত তৈরি হয়। সে হাহাকার করে না। অপেক্ষা করে প্রথম বৃষ্টির, তখন সে হঠাৎ কান্নার সুযোগ পেয়ে যায়। তার কান্না তাদেরকেই পরিচ্ছন্ন পানি দেয়, যারা তার পানিকে অপরিচ্ছন্ন করেছে!