আবুল খায়ের বুলবুল
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় কবি আহমদ বাসির বিচরণ করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন গীতিকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, কলামিস্ট, নিবন্ধকার, সমালোচক ও ছড়াকার তেমনি ছিলেন একজন ভালোমানুষও। কবি আহমদ বাসিরের লেখাগুলো খুবই ঋদ্ধ হয়ে সাহিত্যের সব শাখা- প্রশাখায় নানা ফুল ফুটিয়েছে। পাঠক সেই ঘ্রাণ সুঘ্রাণ গ্রহণ করে আত্মার আত্মায় বিকশিত হয়ে জীবনকে নানান রঙে চিনার প্রয়াসী হয়েছেন। এই দেশের প্রখ্যাত লিখিয়দের মতো কবি আহমদ বাসিরও বাংলা সাহিত্যের নানা দিক সমৃদ্ধ করেছেন। তার সুহাতের লেখার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের জমিন। তার প্রজ্ঞা ও মেধার আলোক বিচ্ছুরণে আঁধারের ঘনঘটা বিদূরিত হয়ে সেখানে আলোর প্লাবন নেমে এসেছে। সেই বিচারে কবি আহমদ বাসির বাংলা সাহিত্যের নিভু আকাশে এক উজ্জ্বল দীপ্তমান নক্ষত্র হয়ে আমাদের মাঝে চিরজাগরুক হয়ে থাকার সুপ্রয়াসী হয়েছেন। জীবনের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে চলতে গিয়ে বাসির গ্রাম বাংলার চিরচেনা সবুজ আকাশ দেখেছেন -দেখেছেন প্রকৃতির ঢেলে দেয়া নানান রঙ। তাইতো তার অনুপম হাতের তুলিতে এঁকেছেন বর্ণালী সবুজে ভরা বন বনানী, পাখপাখালির কিচিরমিচির সুর শব্দের কথা, গেয়েছেন আনমনে তিনি কতো সুখ ও বেদনার গান, শুনেছেন বাতাসের সুনসান শব্দে ভেসে আসা রাগ রাগিণীর কলকাকলি। গ্রাম্য প্রকৃতির যথায় তথায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা কতো শত শাখশাখির পত্রপল্লব গ্লুম লতা যেন কবি আহমদ বাসিরের সঙ্গী ছিলো। কবি আহমদ বাসির যখন কোন ফাঁকে বাড়ি আসতেন তখন আসার আগেই আমাকে ফোন করতেন এই বলে যে “বুলবুল ভাই ঐ তারিখে বাড়ি আসছি, আপনি আসবেন আমাদের বাড়িতে “ঠিকই কবি আহমদ বাসির বাড়ি এলেই আমাকে যেতে হতো তার সাথে খাওয়ার জন্য। কথা বলার জন্য। বিশ্বের নানা দিক নিয়ে কথা হতো সাবলীলভাবে। দেশের অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, আমাদের কি করণীয়, কিভাবে চলা উচিৎ সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা হতো। প্রকৃতির রঙ রূপ, কখন কেমন হয়, কখন কিভাবে বদলায় তাই নিয়েও আলোচনা হতো ওর সাথে। ভালোও লাগতো খুব। তার এই সব অনিন্দ্য সৌন্দর্যের আভা যেন আমার হৃদয় মননে শিহরণ জাগিয়ে তুলতো। তাই কবি আহমদ বাসিরের প্রশংসা করেতেই হয়। কবি সৃষ্টির স্রষ্টার গুণগান নিয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা। কবিতার শব্দ গাঁথুনীতে মেখে দিয়েছেন রাব্বুআলামিনের ভালোবাসার রঙ। মাঝে মধ্যে আমাকেও ছন্দের কিছু সঠিক দিক বুঝিয়ে দিতেন। আমি তাতে আনন্দিত হতাম যা এখনও মনে পড়ে। আহমদ বাসির আল্লাহর রঙে নিজেও রেঙেছেন এবং আমাদের মতো মননশীল পাঠকের মনকেও রাঙিয়েছেন। কবি বাসির জীবনে কখনই অপ্রতিভ ছিলেন না, নির্ভয় নির্ভীক তেজদীপ্ত তরুণ কবি ছিলেন। সত্যের কাছে মাথা নত করেননি।
আহমদ বাসিরের হৃদপিন্ডে ছিলো ব্যঘ্রসম সাহস। তার লেখার ও কথার তুড়িতে বেহুঁশে হুঁশ ফিরে পেয়েছে এ দেশের হাজারো আশাহত নিদ্রালু জনতা। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার মানসে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন গানে, কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, নিবন্ধে এবং মুখ ও ঠোঁটে। পীড়িত অসহায় মানুষের প্রতি কবি আহমদ বাসিরের ভালোবাসা ছিলো পাহাড়সম। দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের পাশে তিনি সদায় সর্বদাই থাকতেন, তাদের অভিযোগ অনুযোগ নিতেন ও দিতেন। মানবতার জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি পথ শিশুদের জন্য নির্মাণ করেন একটি স্কুল যেখানে ওরা যেন লেখাপড়া করতে পারে বিনা খরচে। বাসির পথভোলা মানুষকেও পথের দিকে আনতে আপ্রাণ চেষ্ট করে গেছেন। তিনি মানুষদেরকে বুঝাতে চেয়েছেন যে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান চলবে, কোন মানুষের রচিত সংবিধান মানব জাতিকে সুখ ও শান্তি দিতে পারে না। আল্লাহর বিধানের মাধ্যমেই জীবন নদী সুখের আশ্বাসের মিষ্টি ফোঁটায় কানায় কানায় ভরে যায় এবং জীবনের শুকনো গাছে অবারিত ফুল ফোটে সেই ফুলেরই স্নিগ্ধ সৌরভ গ্রহণ করে চলতে বলতে হয় হবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। পরিশ্রম ও পরিশ্রমী হাতকে তিনি সাহসের ঠিকানায় পৌঁছিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সংগ্রামী জীবনকে সংগ্রামী ভেবেই জীবনকে জীবনের চোখে দেখেছেন আর সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছেন বিজয়ের সুখময় মুক্তা রাশি রাশি।
কবি আহমদ বাসির জীবনকে সাজাতে ও রাঙাতে কুরআানের সৌন্দর্য ধারণ করতে বড্ড প্রয়াসী ছিলেন। বিধাতা যাতে খুশি হন কবি আহমদ বাসির সেই নিয়ম সেই বিধানকেই আঁকড়িয়ে ধরতেন সাহসের সাথে। এটি তার ইহলৌকিক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিক। আমার জীবনে দেখা অনেক মানুষের মধ্যে কবি আহমদ বাসির ছিলেন মেধাবী, মননে ও চিন্তনে একজন খাঁটি ভদ্র মানুষ। বয়োজেষ্ঠদের প্রতি কিভাবে কতোটুকু শ্রদ্ধা ভক্তি করা ও দেখানো যায় বোধকরি বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের মাঝে হয়ত তার মতো খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভদ্রতায় নম্রতায় ব্যবহারে তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ ও কবি। তার আতিথেয়তা ছিলো অনন্য যেন নিন্দুকও তার সেই মিষ্টি ব্যবহারের ধারায় ডুবে চুপে চুপে তারই মমতার নির্যাস গ্রহণ করতো। একথাও ঠিক যে কবি আহমদ বাসির ঝটপট করে বহু সমস্যাময় প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারতেন। তিনি একজন বাগ্মীয়ও ছিলেন —ছিলেন একজন সফল আবৃত্তিকারও, যেমন পেরেছেন নজরুলের বিদ্রোহীকে তেমনি পেরেছেন ফররুখের পাঞ্জেরীকে কন্ঠে ধারণ করে তা প্রকাশ করতে। ভাবগম্ভীর ভরাট কন্ঠের সুরলহরীতে যেন সমগ্র মানুষের হৃদ এলাকা থৈ থৈ করতো কবি আহমদ বাসিরের কন্ঠ উচ্চারণ ধ্বনি মূর্চ্ছনায়। আমার মতে কবিতা আবৃত্তিতে যদি না ভরাট কন্ঠ না হয় এবং সুর ও কন্ঠে যদি না উঠা নামা না হয় তাহলে শ্রোতাদের কাছে আকর্ষণে প্রকর্ষিত হয়ে ওঠে না। কবি আহমদ বাসিরে কন্ঠে সেই কারুকাজ ছিলো যা প্রত্যাশার ভিতরে আরেক আশার জন্ম নিয়েছে । কবি আহমদ বাসির ছিলেন একজন পাঠক পোকা। অজস্র বই পড়া ছিলো তার বড় অভ্যাস আর সেখান থেকেই তিনি রস বের করে তা লেখার কাজে লাগাতেন। তাই বই উপহার দেয়া নেয়া তিনি ভালোবাসতেন। তিনি অনেক বিষয় পড়াশোনা করতেন বলেই গানেও তিনি সুরও দিতে পারতেন। গানের সুর সম্পর্কে আজকার অনেক সুরকার শিল্পী না জেনেই গানে সুর দেয় সেজন্যে তাদের গান হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে না। বাসির কিন্তু তা জানতেন আর সেই জন্যেই তিনি তার লেখা অনেক গানে সুর দিয়েছেন। আমাকেও বলতেন যদিও আমি তার থেকে বয়সে অনেক বড় ছিলাম। তার লেখা প্রায় সাতশত গান ছিলো তার মধ্যে কয়েকটি গান শিল্পী সুরকার গীতিকার লিটন হাফিজ চৌধুরীর কণ্ঠে সফলভাবে গীত হয়েছিলো। ইসলামের হারানো গৌরব নিয়ে লেখা গানটি শ্রোতা নন্দিত হয়েছিলো। গানটির কথাগুলো ছিলো ঠিক এমন-
“আয়াসোফিয়ার শিকল ভেঙেছে
শিকল ভাঙবে আলআকসার
উইঘুর প্রাণ কাঁদবে না আর
কাশ্মীর পাবে স্বাধীনতা
আরাকান হবে আবারো আবাদ
উপশম হবে ক্ষত ব্যথা
মুসলমানের হাতে ঝলসে যদি ওঠে
সেই ন্যায় তলোয়ার
সত্যের নিশান উড়াতেই হবে
মুক্তির আকাশে তুলেছে সুর
জ্ঞানের মহিমা অবারিত হলে
পালিয়ে যাবে সব অসুর
বাবরি আবার মসজিদ হবে
কর্ডোভা ফিরে পাবে আবার”
তার খোৎবার তলোয়ার ঐ গানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মুসলমানদেরকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। বীরেরা যে জাগিয়ে ওঠলে হারানো গৌরব আবার ফিরে পায় তারই চিত্র ফুটে ওঠেছে তার খোৎবায়ে তলোয়ার গানে। ভয়হীন জাতিকে ব্যঘ্র সিংহও ভয় করে আটকানো পথ ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায় তারই ইঙ্গিত সেই গানের স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী ও আভোগে বার বার উচ্চারিত হয়েছে।