সীমান্ত আকরাম

বাংলা লোকসংগীতের কিংবদন্তী, ভাওয়াইয়া গানের বরপুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসী গত ১০ মে আমাদের থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আব্বাসী ১৯৩৭ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই পিতা আব্বাসউদ্দিনের হাতেই সংগীতের হাতেখড়ি। তিনি বাংলার লোকসঙ্গীত, সাহিত্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। পিতা ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সংগীতের যে নাও ভাসিয়েছেন, সে নাওয়ে চড়ে জীবনভর সংগীতের যে সুধা ছড়িয়েছেন তা আজও বাংলার ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি লোকসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রশংসিত করেছেন। পৃথিবীর ২৫টি দেশে আমাদের ভাটিয়ালি-বিচ্ছেদি-ভাওয়াইয়া-চটকা-নজরুলগীতি পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন। ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১১ বছর। সঙ্গীতজ্ঞদের বিশ্ব অধিবেশনে একাধিকবার তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ৫০ বছর তিনি ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে সংগ্রহ করেছেন কয়েক হাজার গান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা জামান আব্বাসী এক সময় তিনি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

সঙ্গীতের সূচনা

মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সঙ্গীতের সূচনা ওস্তাদ কাদের জমিরির হাতে। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের ঠুংরীর অবিসংবাদিত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ জামির উদ্দিন খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র। ওস্তাদ কাদের জমিরির সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৪৫ সালে তখন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পরিবার কলিকাতার ৬নং বেনে পুকুর লেন এ বসবাস করতেন। জানা যায়, মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পিতা আব্বাসউদ্দিন আহমেদ একদিন ওস্তাদ কাদের জামিরিকে তাঁদের বাসায় নিয়ে আসেন এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর থেকে নিয়মিত ভাবে আব্বাসী ও ফেরদৌসী ওস্তাদ কাদের জামিরীর নিকট সঙ্গীত শিক্ষা নিতে থাকেন। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ওস্তাদ কাদের জামিরীর নিকট প্রথম যে সঙ্গীতের রাগ শিখেন তার নাম ভূপালী রাগ। পরবর্তীতে দেশ বিভাগ হলে ১৯৪৭ সালের পর মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পরিবারের সবাই চলে আসেন ঢাকায়, বাসা নেওয়া হয় পুরান ঢাকার পাতলা খাঁন লেন।

আব্বাসীর সঙ্গীত ওস্তাদ য়ারা

ওস্তাদ কাদের জামিরী, ওস্তাদ গণেন চক্রবর্তী, ওস্তাদ আবদুল গফুর খান, ওস্তাদ মাস্তান গামা, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান, ওস্তাদ ইউসুফ খান কোরেশী, ওস্তাদ মনির হোসেন খান, ওস্তাদ সালামত আলী খান, ওস্তাদ নাজাকাত আলী খান, ওস্তাদ আসাদ আলী খান, কানাই লাল শীল, মফিজুল ইসলাম, বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল হালিম চৌধুরী, মোমতাজ আলী খানের ওস্তাদ মুন্সি রইছ উদ্দিন খানের নিকট দীর্ঘ বারো বছর উচ্চাঙ্গ ও অন্যান্য সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওস্তাদ হলেন ভক্তিময় দাস আর লোকসঙ্গীতের উপর শিক্ষা গ্রহণ করে পিতা আব্বাসউদ্দিন আহমদের কাছে। এভাবে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের সান্নিধ্যে অতিবাহিত হয় মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সঙ্গীত শিক্ষার প্রথম জীবন।

বেতারের শিল্পী আব্বাসী

ছোট বেলায় মুস্তাফা জামান আব্বাসী অনেক অনুষ্ঠান করেছেন বেতারে। তিনি প্রথম বেতারে একটি নাটকে অভিনয় করেন ১৯৪৯ সালে। নাটকের নাম ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, পরিচালক আবদুল মতিন। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর গানের রেকর্ড বের হওয়ার পর চতুর্দিকে ডাকা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্কে অংশ নেওয়া হচ্ছে নিয়মিত ভাবে, লোকে তাঁর উপস্থিতি দেখতে চায় সর্বত্র। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই আব্বাসী বেতারে গান গাওয়ার জন্য নিয়োগপত্র পেলেন। ফলাফলও ভালো, গান গাইতে গেলেন বেতারে। গান গাইলেন। প্রথম গানটি একটি আধুনিক গান ছিল। গানের কলি :

“মোছে কি গো পরিচয়/গান থেমে যায় তবু যে গো হায়/রহে সুর মধুময়।”

প্রথম দিনের গানের পারিশ্রমিক পেলেন পনেরো টাকা। আর এই থেকে নিয়মিত প্রতিমাসে বেতারে অনুষ্ঠান করছেন। ১৯৫৭ সালের কোনো এক দুপুর বেলা হতে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত বেতারে গান গেয়েই গেছেন এবং বেতারে নিজের নামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্পী আব্বাসী

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই ভাটিয়ালি, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, ভাওয়াইয়া, মারফতি, মুর্শিদি ইত্যাদি বাংলা প্রাচীন লোকগীতি তিনি নিজে পরিবেশন করার পাশাপাশি তাঁর পরিচালনায় জনপ্রিয় ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘লৌকিক বাংলা’, ‘আমার ঠিকানা’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লোকসঙ্গীতকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি নদী বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে এসব অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা ও উপস্থপনা করতেন। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর হাত ধরে এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে বহু নামিদামি শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছে। বিটিভির জনপ্রিয় দুটি গানের অনুষ্ঠান ‘বাঁশরী’ ও ‘হিজলতমাল’-এ দীর্ঘ ২৫ বছর নিয়মিত গান গেয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক বিটিভিতে হামদ-নাত ও গজল গেয়েছেন নিয়মিত।

আব্বাসীর প্রথম রেকর্ড গান

মুস্তাফা জামান আব্বাসীর গান প্রথম রেকর্ড করে তৎকালীন বিখ্যাত কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েস [করাচি] ১৯৫৭ সালে। আর গানের কলি ছিল : ‘আমায় ভালোবেসে দিলি এতো জ¦ালা’, অপর গানটি ছিল : ‘ও মন মাঝিরে কোন ঘাটে ভিড়াবে তোর নাও।’ গান দুটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন বিখ্যাত লোকসঙ্গীত সুরকার কানাইলাল শীল। গান দুটি রেকর্ড হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর পরিচিতি ছিল সীমাবদ্ধ। বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের লোকজন ছাড়া তেমন কেউ তাঁকে জানতো না। তাঁর আকুল করা কণ্ঠে যখন দেশের মানুষ গান শুনতে পেল সেই সময় হতে লোকসঙ্গীতের জগতে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর নামটা লিপিবদ্ধ হয়ে গেল। এবং গান দুটি তাঁকে গানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। দেশের সঙ্গীতপিপাসু লোকজন যখন তাঁর পরিচিতি জানতে পারলো। একে অপরকে বলাবলি করতে লাগলো, কথায় বলেনা যেমন বাপ তেমন বেটা। আব্বাসী তাঁর প্রথম রেকর্ড গানের অ্যালবাম ‘উড়িল সোনার পায়রা’ দিয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

সঙ্গীত জগতে আব্বাসী নামের সূচনা

১৯৫৭ সালের করাচির হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানি গান দুটি রেকর্ড করার আগ পর্যন্ত তিনি নাম লিখতেন মুস্তাফা জামান এবং এই নামে সবাই জানতো। গান দুটি রেকর্ড হওয়ার পর কোম্পানি যখন নাম চাইলো তিনি তখন গভীরভাবে চিন্তা করলেন, গানতো রেকর্ড হলো। বাজারে বিক্রি করার জন্য বাজারজাত করা হবে। দেশের লোক গান শুনবে, আমাকে বা কতজন জানে কিংবা চিনে। আব্বাকে তো দেশের সকলেই জানে ও চিনে। তাঁর নামের সুখ্যাতি ও বিরাট পরিচিতি গানের জগতে বিদ্যমান। তাহলে নামের শেষ অংশটা আব্বাসী যুক্ত করে দেই। সত্যিই সে সময় কোম্পানিকে মুস্তাফা জামান আব্বাসী যোগ করে লিখে দেওয়া হলো। কোম্পানি গান বাজারজাত করল। অ্যালবামটি বাজারে ভালো বিক্রিও হল। মুস্তাফা জামানের নামের শেষে আব্বাসী যুক্ত দেখে আব্বাস উদ্দিন আহমেদ সত্যিই আনন্দিত ও খুশি হলেন, তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের বলে বেড়ালেন অনেকদিন পরে আমার ছেলে তার নামের শেষাংশে আব্বাসী যুক্ত করেছে। আর সেই দিন হতে মুস্তাফা জামান হয়ে গেলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী।

পিতার সাথে গানের অনুষ্ঠানে আব্বাসী

১৯৪৮ সালে মহাত্মা আততায়ীর গুলীতে নিহত হওয়ার পর নারিন্দাতে তৎকালে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই শোকসভায় গান গেয়েছিলেন আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান। গানের কলি ছিল ‘ও ভাই হিন্দু মুসলমান ভুল পথে চলি’। এরপর ১৯৪৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে এক অনুষ্ঠানে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সাহেবকে ডাকা হল গান গাওয়ার জন্য তিনি মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমানকে সাথে নিয়ে গেলেন গান গাওয়ার জন্য। তখন মুস্তাফা জামান আব্বাসী মাত্র স্কুলের ছাত্র। অনুষ্ঠানে আব্বাসউদ্দিন কৃষকের সাজে সজ্জিত হয়ে গান গাইলেন। আর পিতার সঙ্গে মুস্তাফা জামান আব্বাসী অভিনয় করেছিলেন। গানের কলি ছিল : ‘ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙ্গল বাইতে’। এছাড়া ১৯৫০ সালে ঢাকা কার্জন হলে অনুষ্ঠিত নাটকে পিতা আব্বাসউদ্দিনের সাথে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও মহুয়া সুন্দরী পালাগানসহ অনেক অনুষ্ঠানে তিনি পিতার সঙ্গে গান গেয়েছেন।

লোকসঙ্গীত সংগ্রহক আব্বাসী

মুস্তাফা জামান আব্বাসী লালন ফকিরের মূল সুরে গান বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচার করেন। তিনি লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। গান সংগ্রহ করা তাঁর নেশা। তিনি টেপ রেকর্ডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় পল্লীর গান ও গীতিকারের মূল সুর সংগ্রহ করেন তিন হাজার এর বেশি। তাঁর একটি সংগঠন আছে নাম ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপ; যার পরিচালক তিনি নিজে। আর এসব লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করে যাঁদের শুনিয়ে আনন্দ পান তাঁদের মধ্যমণি হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, আব্বাসীর চাচা আবদুর করিম, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. মযহারুল ইসলাম, তোফায়েল আহমেদ আরো অনেকে। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ১৯৬৪ সালে কুষ্টিায়া হতে বাউল বিহাল শাহ, ফকির বাউল খোদা বকস বিশ্বাস, ঝড়ুশাহ ও জনাব আলী মল্লিক সহ ১০জন বাউলকে ঢাকায় তাঁর বাসায় নিয়ে আসলেন। এই ১০জন বাউলের নিকট হতে লালন ফকিরের মূল সুরে প্রায় ৩০০ গান টেপে রেকর্ড করলেন। আর টেপে গান রেকর্ড করার সময় প্রতিদিন উপস্থিত থেকে উপদেশ দিতেন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন।

মুস্তাফা জামান আব্ববাসী পল্লী গ্রামের বাউলদের গলা হতে মূল সুর সংগ্রহ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আজ হয়তো অনেকে জীবিত নেই। কিন্তু তাঁদের সুর রক্ষিত আছে তাঁর সংগ্রহে। এ বিশাল সংগ্রহ সযতনে রাখছেন আব্বাসী তাঁর ঘরের একটি আলমারিতে। সব গান টেপ রেকর্ড করা।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বড় আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ফোকলোর ইনস্টিটিউট থাকত, তাহলে আমাদের হাজার বছরের পুরানো গান সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। আর সরকার কিংবা ক্যাসেট প্রকাশনা সংস্থাগুলো যদি প্রকাশ করত দেশের বাউল গান, মারফতি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকা ইত্যাদি তাহলে বিশ্ববাজারে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলতে পারতাম আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সুযোগ সুবিধার অভাবে আমাদের এইসব এখানেই থেকে যাবে। বিশ্বসভায় এ সুর আর পৌঁছাবে না’। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর স্বপ্ন বাংলাদেশে একটি ফোকলোর ইনস্টিটিউট হোক। ১৯৬৪ সনের আগে লালন ফকিরের গান মারফতি ও মুর্শিদী সুরে গাওয়া হত। ১৯৬৪ সালে লালনের মূল সুর সংগ্রহ করার পর আজঅবধি মূল সুরে টেলিভিশন ও রেডিওতে গান গাওয়া হচ্ছে, আর এ কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ৫০ বছর তিনি ফোক মিউজিক রিসার্চ প্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে সংগ্রহ করেছেন কয়েক হাজার গান।

প্লে-ব্যাকের জগতে আব্বাসী

মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পিতার শখ ছিল ছেলে লেখাপড়া শেষ করে নিমোটোগ্রাফিতে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে অভিনয় কিংবা বড় মাপের পরিচালক হবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। তবে আব্বাসী বাংলাদেশের ছায়াছবিতে কমপক্ষে ১০/১২টি গান গেয়েছেন। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও তাঁর বোন ফেরদৌসী রহমান প্রথম যে ছবিতে গান করেন তার নাম ছিল ‘আসিয়া’, গানটি ছিল ‘দ্যাওয়ায় করছে মেঘ মেঘালি’ ছবির নায়ক ছিলেন সেরাজুদ্দাহার, নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী। যেদিন গানটি রেকর্ড হয় সেদিন স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন তাঁর পিতা আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। আজকালের মতো ভালো ব্যবস্থা ছিল না। তখন বাংলাদেশের এফডিসি হয়নি। ছবির গানটি রেকর্ড করছিল তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কোয়াপরেটিভ কোম্পানি। গানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আবদুল আহাদ।

ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর মুস্তাফা জামান আব্বাসী দর্শক ও শ্রোতাদের নিকট থেকে খুব প্রশংসা পেয়েছিলেন। এরপর ৭-৮টি ছবিতে প্লেব্যাক করেন। গানের কলি ছিল ‘চাঁদ বাঁকা জানি’। গানটি সুর করেছিলেন সত্য সাহা। গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালক এহতেশাম ‘তাঁর রাজনীতির বুকে’ ছবিতে গান গাওয়ায় সাফল্যের পর মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে পরবর্তী ছবিতে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন কিংবা সহকারী পরিচালক হওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি লোকসঙ্গীত পছন্দ করতেন। অভিনয় জগতে আসেন নি তবে ঘুরে ফিরে সে-জগতের সকলের সাথে সব সময় উঠাবসা ছিলো তাঁর। পরিচালক আবদুল জব্বার খান সব সময় আব্বাসীর বাসায় আসতেন। এছাড়া নায়ক রাজ রাজ্জাকের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে কলকাতায় গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলে, সেই সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিলো মৃত্যু অবদি। রওশন আরা, সুষ্মিতা, সুলতানা, সুচন্দা, শাবানা, রোজী, রেশমা সবার সাথে ভালো একটা সম্পর্ক আছে আব্বাসীর।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী সঙ্গীত পরিচালনার জন্য বেশ ক’টি প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। তিনি চার বছর সেন্সর বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্য থাকাকালে প্রায় তিনশত ছবি দেখেছেন।

জীবনভর গানের সঙ্গে কাটানো মুস্তাফা জামান আব্বাসী গবেষক হিসেবেও দেশীয় সংগীতের বৈচিত্র্যের সন্ধান করে গেছেন। ইসলামি ও লোকধারার গান সংগ্রহ এবং তা জনপ্রিয় করতে কাজ করেছেন। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ‘কাজী নজরুল ইসলাম এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদ গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্রের’ গবেষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগীত সম্মিলনে উপস্থাপন করে গেছেন এ দেশের সংগীত বৈভব। একসময় পত্রিকায় নিয়মিত কলামও লিখতেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং জাতীয় সংগীত কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা একাডেমির এই সম্মানিত ফেলো বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য এবং বাংলাদেশ ফোকলোর পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সংগীতে অবদানের জন্য একুশে পদক, নজরুল একাডেমি পুরস্কার ছাড়াও বহু পুরস্কার আর সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী।