নোমান সাদিক

বাংলা সাহিত্যের একটা দুর্ভাগ্য যে এখানে সাহিত্য বিচার প্রক্রিয়া পীরবাদ ও ঠাকুর তন্ত্রের মতো। সাহিত্য বিচারের মানদন্ড প্রায় সময় নজরুল বনীন্দ্রনাথ হয়া থাকেন। অবাক ব্যাপার এই যে কে কারচে বড় করি তা নিয়া প্রচুর আলাপ ও লেখালেখি হয়। অন্তত পশ্চিমবাংলায় এই ব্যাপারটা ভদ্রতার সব সীমা অতিক্রম করে ছাড়ছে। আপনি যখন নদীতে দেখবেন নৌকা ট্রলার লঞ্চ স্টিমার চলে তো প্রত্যেকটার আলাদা দরকার ও সৌন্দর্য আছে। আমাদের সাহিত্য সমালোচক কম। শাহাবুদ্দীন আহমদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দরা নিজেদের যুগে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। যেরকম দরবেশ ইব্রাহিম আদহাম কিংবা আবুজর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু নির্জনে ছিলেন এবং মারা গেলেন, সেইভাবে এই দুই মহান বিদগ্ধ ওই ভাবেই গেলেন। আমাদের চাই অফুরান খেজুরের মিঠাই আর আমরা হইতে চাই মাছি। পত্রিকার লেখাগুলা প্রায়ই নিজের তাগাদা-গবেষণার চাইতে সম্পাদকের চাপে লেখা। ‘ওঠ ছেমরি কাইল তোর বিয়া’ এই টাইপের লেখাই যে ভয়াবহ পরিমাণে এবং তা গরুর রচনা তা বলতে হয় না। হ্যাঁ, আমি কবি গোলাম মোস্তফার কথা বলতেছি। তার কপাল এতই খারাপ যে তারে নিয়া গরু রচনাও সেভাবে হয় নাই। গোলাম মোস্তফা নিয়া এই অবহেলার নেপথ্যে আমি আমার চোখে তিনটা কারণ দেখতে পাই। আরো পাওয়া যায় কিন্তু তিনটা নিয়াই কথা বলি।এক. গোলাম মোস্তফা একই সাথে ইসলামপন্থী ও পাকিস্তান সমর্থক হওয়ায় ৭১ পরবর্তী চেতনাবাদীরা তাকে বালুচাপা দিতে চায়।

দুই. রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে তার আগ্রহ তেমন ছিল না।

তিন, ৭১ পরবর্তী ইসলামপন্থীদের অতি প্রগতিবাদী হয়া ওঠা আর ঘনঘন ছুলুম বদলানোর তাগিদের কাছে গোলাম মোস্তফা কুষ্ঠ রোগীর মতো ম্লেচ্ছ হয়ে ওঠেন।

আমি বিষয়গুলার দিকে সামান্য নজর দিব। কেননা এই সামান্য নজরেই এত অবিচার ও হাসি তামাশার ব্যাপার ধরা পড়ে যে আপনার মনে পড়বে শেখ সাদির কবিতার লাইন- ‘মিঠাই অল্পতেই বোঝা যায়’।

এক নম্বর বিষয় নিয়া বলা যায়- নয় মাস যুদ্ধের ভিতর দিয়া একাত্তরের স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশরে ভালোবাসা মহাপাপ ছিল না। বাট ১৯০ বছর আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ বেনিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার একটা অসিলা ছিল পাকিস্তান। একাত্তরের আগে সেই পাকিস্তানেরে ভালোবাসাটা মহাপাপ। অর্থাৎ সূক্ষ্ম বিচারে আপনার পাপ পাকিস্তান ভালবাসা না। আপনার পাপ আপনি কেন ভবিষ্যৎ জানলেন না (যদিও তা আল্লাহর ক্ষমতায় থাকে, আপনার ক্ষমতায় নাই)। গোলাম মোস্তফা ১৯৬৪ তে মারা যান। একাত্তরের মাত্র ৭ বছর আগে কেন তিনি জানতে পারলেন না যে একটা ৭১ হবে। আমি পক্ষে-বিপক্ষে আর কিছুই বললাম না।

দুই নম্বর পয়েন্ট নিয়া বলতে হয় যে, বাংলা মাতৃভাষা হওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা কইরা গোলাম মোস্তফা বড় বা ছোট কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন এই কথা কেউ বলতে পারে না। অথচ রবীন্দ্রনাথ মহাযুক্তি দিয়া বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে হিন্দী রাষ্ট্রভাষার পক্ষে এত কিছু করার পরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়েছেন আর গোলাম মোস্তফা স্নেচ্ছো। এখানেও আমার কিছু বলার থাকলেও বলবো না কারণ, যা স্পষ্ট দেখা যায় তা নিয়ে বলা বাড়তি কাজ।

তিন নম্বরে গোলাম মোস্তফা নিয়া কাজ করার সবচেয়ে বেশি দায় ছিল ইসলামী কালচারাল মোর্চাগুলার। কিন্তু আমি আগেও বলেছি যে তারা গোলাম মোস্তফার সাথে ওই আচরণ করছে যা মানুষ কুষ্ঠ রোগীর সাথে করে।

পয়েন্টের বাইরেও আরো কিছু সমস্যা ধরা পড়ে। আপনি যদি আপনার ভাষায় মধ্যযুগে, মানে হল যদিও বর্বর মধ্যযুগ ইউরোপের আর উজ্জ্বল মধ্যযুগ এশিয়ার যার নেতৃত্বে ছিল আরব মুসলমানরা তবুও বাংলাদেশের সুশীল ভাষায় মধ্যযুগীয় আরব সাহিত্যে আমরা দেখি ক্লাসিফিকেশন আছে। তারা কোন কবিরেই ফালাইয়া দেয় নাই।

তাদের বিভাজনগুলা এইরকম ছিল যে যেমন-

এক, জাহিলি যুগের কবি

দুই. মুখাদারাম বা ইসলামী ও জাহিলি যুগের কবি

তিন, ইসলামী উমাইয়া যুগের কবি

চার, ইসলামী আব্বাসী যুগের কবি

পরবর্তীতে ওসমানী, মামলুকী, তৈমুরী নানা যুগে আরবে সাহিত্যের ক্লাসিফিকেশন হইছে।

মানের বিচারে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় এরকম সারির ভাগ করা হইছে। এর ফলে প্রতিভা ও কবিতা বিচারে কোন কবি বাদ যান না। সময়ে তার আলোচনা ঠিকই আসে। অনেকে হয়তো বলবেন যে- কাউরে প্রথম সারির কাউরে তৃতীয় সারির বলার মতো অসম্মানের কি দরকার? আমি মানলাম। যে স্তর ভাগ কইরা হয়তো কাউরে সামান্য ছোট করা হইছে বাট অস্বীকার করার মতো মহাপাপ তো হয় নাই। ইংরেজি সাহিত্যেও এমনটা আছে। ফলে যদি দুই দশক আপনি সাহিত্য চর্চা করেন আপনি জাতির স্মরণ ও মন মগজ থেকে বাদ পড়েন নাই। ঝামেলাটা হইলো বাংলা কবিতার বিচার-বিশ্লেষণে আগে আসে ব্যক্তির রাজনীতি ও ব্যক্তিগত মতামত। ফলে বাংলা সাহিত্য ইনসাফের জায়গা না হইয়া হইলো পীর ঠাকুর এর আদালত।

একজন গোলাম মোস্তফা:

গোলাম মোস্তফার জন্ম ১৮৯৭ সালে। মৃত্যু ১৯৬৪ সালে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন কবিদের মধ্যে তিনি একজন। তার রাজনৈতিক সচেতনতা মাঠে নয়, রাস্তায় নয়, কবিতায়। মাঠ ও রাস্তায় যারা রাজনীতি করেন তারা ছোট না। তারও দরকার আছে। তার মৌলিক কবিতার বই পাঁচটা। রক্তরাগ, খোশরোজ, হাসনাহেনা, বনি আদম, সাহারা। তার কবিতার বিষয়বস্তুগুলা এরকম ভাগ করা যায় যে-

এক - মুসলিম জাগরণ

দুই - রাজনীতি

তিন- জাতীয় ঐতিহ্য

চার প্রেম

তরজমার মধ্যে তার শ্রেষ্ঠ কাজ এবং বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কর্মগুলার একটি হইল ইকবালের ‘শিকোয়া জবাবে শিকোয়া’র তরজমা। এছাড়াও সূরা ফাতিহার তরজমাটা সম্ভবত বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতায় সূরার তরজমা। তজমায় সুর দেওয়া হইছে। মোস্তফা জামান আব্বাসীর কণ্ঠে গাওয়া সেই ফাতিহার তরজমা “অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামী” এখনো আমাদের অনেকের কানে বাজে।

লিখেছেন অনেক গান, সুর করেছেন প্রচুর। সুরকার হিসেবে ওই সময়ে তিনি প্রথম সারির ছিলেন। এছাড়া তার বিখ্যাত কয়েকটা কবিতা হইলো ‘জীবন বিনিময়’ ‘বিশ্ব সভায় আবার মোরা নতুন করে আসন লব’ শিরোনামে ‘তরুণের অভিযান’ কবিতা। এছাড়া ‘শবে বরাত’ ‘বনি আদম’ ‘হাসনাহেনা’ শিরোনামে কবিতাগুলা পাঠ্যবইতে থাকার কল্যাণে এক সময় মুখেমুখে ছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিখ্যাত কাজগুলার অন্যতম একটা হইল গোলাম মোস্তফারে একেবারে বালিচাপা দেওয়া। জিয়াউর রহমান একটা মহান কাজ করেছিলেন। শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান “নতুন কুঁড়ি”র নাম গোলাম মোস্তফার কবিতার অবলম্বনে দিয়েছিলেন। এবং সেখানে গানটাও গোলাম মোস্তফার। আজও প্রবাদের মতো আমরা বলি, লিখি, ভাব সম্প্রসারণে আসে “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরা অন্তরে’। এই চিন্তা একেবারে মৌলিক না কিন্তু তার প্রকাশ এবং আকৃতি মৌলিক।

শিকোয়া ও জবাবে শিকওয়া

আমাদের দেশে যদি ইকবালকে আলোচনায় আনা হয়, তাহলে তার কোন কবিতাগুলি বেশি পরিচিত এই প্রশ্ন আসবে। এর উত্তর একটা, তা হলো ‘শিকওয়া জবাবে শিকওয়া’। এই অমূল্য বইটি বাংলার মানুষের হাতে সবচেয়ে সরল, সবচেয়ে ছান্দসিক সবচেয়ে শ্রুতিমধুর, মূল কবিতার সাথে সবচেয়ে মিল, মূল কবিতার সাথে লাইনের সংখ্যায় সবচেয়ে মিল, সবকিছু বিচারে কোন তরজমাটা আসবে? উত্তর একটাই। গোলাম মোস্তফার তরজমা। জনপ্রিয়তার দিক দিয়া গোলাম মোস্তফার ‘শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া’ নজরুলের ‘কবাইয়াতে ওমর খৈয়াম’ ও ‘রুবাইয়াতে হাফিজ’র কাছাকাছি। হাঁ, একটা কথা সত্য যে- গোলাম মোস্তফার স্বতন্ত্র কাব্যভাষা হইয়া ওঠে নাই। আমি আগেই বলেছি গোলাম মোস্তফা নজরুলের মতো প্রতিভাবান হন নাই। তাই তার বিচারও নজরুলের মতো করা যায় না।

তবে এইটা বলা যায় যে, বাংলা কবিতার তরজমার দুনিয়ায় গোলাম মোস্তফা শীর্ষস্থানে যারা আছেন তাদের একজন। সেই হিসাবেও তিনি সম্মান ও স্মরণীয় হওয়ার হক রাখেন। অবশ্য উগ্র সেকুলার সাম্প্রদায়িকতা তার কাজ অস্বীকার করে যাবে এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অনেক কিছু করার ছিল। আমি এই বিষয়ে কথা আর বাড়াইতে চাই না।

গোলাম মোস্তফা’র ‘বিশ্ব নবী’

দেখেন, বর্তমানে বাংলা ভাষায় তরজমায় একটা বিপ্লব ঘটছে। বিশেষত আরবি ও ফার্সি ভাষায়। তাফসীর, ফিকাহ, সিরাত, ইতিহাস ইত্যাদির উপরে অসংখ্য বই তরজমা হইছে। কেউ যদি চায় ৫০ থেকে ১০০ সিরাত কালেকশনে রাখবে এইটা তার কেবল টাকার ব্যাপার। ১০০ বছর বা ৮০ বছর আগে ব্যাপার এমন ছিল কি? মা ফাতেমার কিচ্ছা, কারবালার কিচ্ছা, হরিণ কিচ্ছা, সিকান্দার বাদশার কিচ্ছা, লাইলি মজনুর কিচ্ছা, আর নবী জীবনের খুঁটিনাটি কিছু মুখরোচক কাহিনী ছাড়া সীরাতের কি আলোচনাই বা ছিল? গোলাম মোস্তফাই বাংলা ভাষার প্রথম সিরাত লেখক না। কিন্তু ‘বিশ্বনবী’ কেন বাংলা ভাষায় রচিত সব সীরাতের কিতাব ছাড়ায়া গেল? রাহীকুল মাখতুমের বিচারে ‘বিশ্বনবী’তে অনেক দুর্বল তথ্য হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে গোলাম মোস্তফার রচিত ‘বিশ্বনবী’ বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মৌলিক সিরাত। এইটা কোন সাধারণ সিরাত ছিল না। মধুর বলার ভঙ্গি, শুরু করলে শেষ না কইরা ওঠা যায় না, লোকের হাতে হাতে মুখে মুখে, বিকাল বেলা বাড়ির সিঁড়িতে, সন্ধ্যায় মসজিদে মজলিসে, ওয়াজে মাহফিলে, সবচেয়ে বেশি পঠিত সিরাত ‘বিশ্বনবী’। একদিকে তো জনপ্রিয়তা অন্যদিকে দুই খন্ডের বইয়ে দ্বিতীয় খন্ডে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আনা বিভিন্ন অভিযোগের দলিল যুক্তি বিজ্ঞান ভিত্তিক জবাব।

সেই সাথে বিভিন্ন ভাষায়ও তরজমা হইছে। এইসব বিচারে ‘বিশ্বনবী’র সমান কোন জীবনী গ্রন্থ কি বাংলা সাহিত্যে আর একটাও আছে? এমন একজন লেখক আমাদের আলোচনায় না থাকলে ক্ষতিটা লেখকের নাকি আমাদের এইটা যত দ্রুত ভাবতে পারবো সম্ভবত তত কম ক্ষতি।

গোলাম মোস্তফার দার্শনিক মানস: ‘ইসলাম ও কমিউনিজম’ বই

আমরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে সাম্যের স্লোগান মার্কসবাদীদেরকে তুলতে দেখি তার মধ্যে ঠগের হাটের একটা গোমর যে আছে এটা এখন আমরা আমাদের চেয়ে কম জানা অনেকেই বুঝতে পারে। কিন্তু ৭০-৮০ বছর আগে এত সহজ ছিল না ব্যাপারটা। ওই সময়ে যে কমিউনিস্টের বিরুদ্ধে সেই মানবতার বিরুদ্ধে এমন একটা প্রোপাগান্ডা ছিল। অসংখ্য লেখকদের মহুয়া ফুলের মধু পোকের মতো কমিউনিজমের বাটির ভিতর আধামরা হইয়া ডুব দিয়া ছিল তা আমরা দেখি। সেই সময়ে দাঁড়ায়া কমিউনিজমের সংজ্ঞা বিচার, তার ফিলোসফি, ইসলামের সাথে তার বিরোধ, তার ফাঁকি-ঝুঁকি, মার্কসিজম এর হায়াত, সোভিয়েতী নারীর হালহাকিকত, কৃষকের হালহাকিকত, কমিউনিজম এর ভাঙ্গনের সম্ভাবনা এই সবই স্পষ্টভাবে গোলাম মোস্তফা বলে গেছেন তার ‘ইসলাম ও কমিউনিজম’ বইয়ে। তার জন্য আমরা তারে কিছুই দেই নাই। আজকের এই পৃথিবীতে গোলাম মোস্তফার চিন্তা কতটা সমসাময়িক তা ভাবতে চাই না। কেননা তা ভাবলেই আমাদের কর্তব্য আর যা করছি তা সামনে আসে, আমরা লজ্জা পাই, ছোট হইয়া যাই।

বিরক্তিকর কথার খতম টানার সময় হইল। আমার প্রবন্ধে গোলাম মোস্তফার সমালোচনা নাই। ইচ্ছা করেই করি নাই। সমালোচনা তার হয় যার আলোচনা হয়। একটা জ্বলজ্যান্ত সত্যরে যখন এইভাবে চাপা দেওয়া হয়, ভুলে যাওয়া হয়, তখন সেই সত্যের ভিতরে মিথ্যার ছিদ্রে খোঁজার আগে জগদ্দল এর তলা থেকে তারে বাইরে আনা আজ জরুরি। আমার পক্ষে আমি আজ আর একটাও যুক্তি দিতে চাই না।