DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

কবিদের কবি মির্জা গালিব

কবিদের কবি বলা হয় ক্ষণজন্মা, অসামান্য প্রতিভাধর এই মানুষটিকে। তাঁর নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ। লেখনী নাম ছিল গালিব। জন্মেছিলেন ভারতবর্ষের আগ্রায়।

Printed Edition
sdfs

হাসান হাফিজ

কবিদের কবি বলা হয় ক্ষণজন্মা, অসামান্য প্রতিভাধর এই মানুষটিকে। তাঁর নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ। লেখনী নাম ছিল গালিব। জন্মেছিলেন ভারতবর্ষের আগ্রায়। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ও ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে, ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর। মৃত্যুবরণ করেন ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি। আসাদ মানে সিংহ। গালিব অর্থ সর্বোচ্চ। অনন্যসাধারণ সাহিত্যকীর্তির জন্যে তিনি দু’টি উপাধি পেয়েছিলেন। একটি হলো দাবির উল মালিক, অন্যটি হচ্ছে নাজিম উদ দৌলা।

মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবের জন্ম মাতুলালয়ে। তাঁর পিতামহ কওকান বেগ ছিলেন তুর্কী, ভাগ্যসন্ধানী ব্যক্তি। দিল্লীতে এসে বাদশাহ শাহ আলমের ঘোড়সওয়ার দলে যোগ দিলেন। ৫০ ঘোড়ার দলের অধিনায়ক তিনি। গালিব যখন চার বছরের শিশু, তখন পিতৃহারা হলেন। পিতা আবদুল্লাহ বেগ খান মারা গেলেন আলোয়ারের যুদ্ধে। চাচা নসরুল্লাহ বেগ খানও মারা গেলেন আকস্মিকভাবে। গালিব তখনো নাবালক, নয় বছরের শিশু। ব্রিটিশ সরকার তাদের পারিবারিক জায়গির বাজেয়াপ্ত করে পেনশন বরাদ্দ করে। বছরে সাত শ’ টাকা ভাগে পড়লো এতিম বালকের। মাতামহ তাঁর অভিভাবক হলেন পিতৃব্যের ইন্তেকালের পর। মাতামহ তাঁর শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেননি। গালিব যখন মক্তবের ছাত্র, সেই নয় দশ বছর বয়সেই মুখে মুখে শের রচনা করতে পারতেন। সবাই অবাক হতো শুনে। ওই সময় আবদুস সামাদ ইরানী নামের এক ভদ্রলোক ভারত সফরে এসেছিলেন। তিনি ফার্সি ভাষার পণ্ডিত। আগ্রায় থাকাকালীন তাঁর কাছে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নেওয়ার সুযোগ হলো গালিবের। এ এক বিরল সৌভাগ্য।

কিশোর আসাদের কাছে প্রাচীন ও আধুনিক ফার্সি সাহিত্যের ভাণ্ডার ও সম্পদ মেলে ধরলেন গুরু। শিষ্য ভীষণ উৎসাহী। পরবর্তীকালে গুরু আবদুস সামাদ ইরানীর ঋণ বারবার স্বীকার করেছেন কবি। কিশোর শিষ্য তখন উর্দু ও ফার্সিতে মৌলিক রচনায় দক্ষতা ও প্রতিভার পরিচয় দিলেন। প্রথম জীবনে তখল্লুস বা পেন নেম অর্থাৎ লেখনী নাম ধারণ করলেন ‘অসদ’। পরিণত বয়সে ‘গালিব’ তখল্লুসই ব্যবহার করেছেন তুলনামূলকভাবে বেশি। ‘মির্জা নওশা’Ñ যা ছিল তাঁর পারিবারিক নাম, সেটা মোটেও পছন্দ ছিল না তাঁর।

গালিবের বিয়ে হলো মাত্র তেরো বছর বয়সে। বিয়ে সম্পর্কে পরে লিখেছেন,“ সাত রজব ১২২৫ (৯ আগস্ট ১৮১০) তারিখে আমার জন্য যাবজ্জীবন কারাবাসের বিধান হলো। একটি বেড়ি অর্থাৎ বীবী আমার পায়ে পরিয়ে দেওয়া হ’লো আর দিল্লী শহরকেই কারাগার সাব্যস্ত ক’রে আমাকে সেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হ’লো।” বিবাহের কয়েক বছর পর থেকে দিল্লীতে বসবাস শুরু। বার্ষিক একটা পেনশন পেতেন শ্বশুরের কাছ থেকে। মাতুলালয় থেকেও মাঝে মধ্যে মিলতো অর্থসহায়তা। দিল্লীর বাসিন্দা যখন হলেন, সে সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছে। মুঘল সম্রাট শাহ আলমের পুত্র আকবর শাহ (দ্বিতীয়) তখন নামে মাত্র বাদশাহ। মারাঠাদের হটিয়ে ততদিনে দিল্লীর রাজদরবারের পুতুলখেলার সূত্রধর হয়েছে ইংরেজরা। মুঘল বাদশাহকে মাসে দশ হাজার টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গালিবের গজল থেকে’ বইয়ে লিখেছেন,

“...জগৎবিখ্যাত মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পদ-বৈভব ততোদিনে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেছে। প’ড়ে রয়েছে শুধু অসংখ্য বেগম, বাদশাজাদা আর বাদশাজাদীর অক্ষম বিলাসব্যসন, কলহ-বিবাদ, ষড়যন্ত্র, হানাহানি। সাম্রাজ্যের এই উত্তরাধিকার নিয়ে আকবর শাহ-এর পুত্র বাহাদুর শাহ জফর, উর্র্দু সাহিত্যে যিনি কবি জফর নামে পরিচিত, সিংহাসন পেলেন ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে। রাজত্ব করার তো কিছু ছিলো না। লালকেল্লার মধ্যেই তাঁর রাজত্ব। পারিবারিক অশান্তি,আর্থিক অনটন, ইংরেজের অপমানÑসব কিছু ভুলে সাহিত্যেই তাঁর সান্ত¦না খুঁজে পেয়েছিলেন এই সূফী-স্বভাবের সম্রাট। কাব্যরচনার ঝোঁক ছিলো, যা-কিছু রচনা করতেন তা আবার কুশলী কোনো কবিকে ওস্তাদ মেনে তাঁকে দিয়ে শুধরে নিতেন। সর্বপ্রথমে শাহ নসীর সম্রাটের ওস্তাদ ছিলেন। তারপর বহুকাল ছিলেন কবি জওক, জওকের মৃত্যুর পর হলেন গালিব। সেটা ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দ। প্রৌঢ় কবির কাছে এর সম্মান যতো-না কাম্য ছিলো মাসোহারাটা ছিলো তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। শুধু বাদশাহ নয়, কবিযশঃপ্রার্থী সকলেই সে-কালে প্রথিতযশা কবিদের কাছে নিজের রচনা পেশ করতেন ঘ’ষে-মেজে দেবার জন্য। গালিব নিজে কিন্তু সেটা কখনোই করেননি, যদিও তাঁকে ওস্তাদ মেনেছেন অনেকেই।”

গালিবের গজল কয়েকটি এবার দেখে নেব আমরা। পরে আবার আসবে তাঁর জীবন প্রসঙ্গ। আবু সয়ীদ আইয়ুব অনুবাদিত কয়েকটি শের এখানে উদ্ধৃত করি। অনুবাদ করা হয়েছে উর্দু থেকে।

**

ফুলবাগিচার রূপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলতেও চাইÑ

হে বসন্তের স্রষ্টা, আমার মন পাপী॥

**

জীবনের ঘোড়া ছুটে চলেছে, দেখো কোথায় থামে;

না হাতে আছে লাগাম, না পা আছে রেকাবে॥

**

এদিকে তাকাও, আয়না হাতে অতো তন্ময় কেন?

দেখো, কী গভীর তৃষ্ণা চোখে নিয়ে আমি তোমাকে দেখছি॥

**

হায়, কেন কাঁদতে গেলাম তার কাছে!

আমি কি জানতাম, বন্ধু, এতে বুকের জ্বালা আরো বেড়ে যাবে॥

**

না-চাইতেই যদি দেন তিনি তো তার স্বাদই আলাদা;

সেই ভিখারী শ্রেষ্ঠ, হাত পাতার অভ্যেস হয়নি যার॥

**

শতবার প্রেমের বন্ধন থেকে আমি মুক্ত হলাম,

কিন্তু কী করি, হৃদয়ই মুক্তির পরিপন্থী॥

**

রাগিণীর আলাপ নই, সেতারের তার নই,

আমি কেবল একটি আওয়াজ, পরাজয়ে ভেঙে পড়ার আওয়াজ॥

**

সব সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না, বন্ধু;

আর যদি কিছু না-থাকে তো শত্রুতাই থাক॥

**

প্রেম ছাড়া জীবন কাটে না; অথচ

প্রেমের যন্ত্রণায় যে-স্বাদ আছে, তা গ্রহণ করার শক্তিও আমার নেই॥

**

কতোকাল হ’লো গালিব মারা গেছে, তবু মনে পড়ে

কথায়-কথায় তার বলাÑ “ এমন যদি হতো তাহ’লে কী হতো?”

মির্জা গালিবকে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি ও দক্ষিণ এশিয়ায় উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে মনে করা হয়। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই গালিবের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

বংশের ঐতিহ্যের কারণে অহঙ্কারী স্বভাবের মানুষ ছিলেন মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব। যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি ফার্সিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ফার্সিকে তিনি তাঁর প্রথম প্রেম হিসেবে বর্ণনা করে গেছেন। শৈশবে যে উর্দুতে কবিতা লিখতেন, তার দৃষ্টান্তও রয়েছে। সমালোচকদের মতে, গালিবের প্রথম জীবনের কবিতা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মতই দুর্বোধ্য ও সামঞ্জস্যহীন। একটি কবিতায় তিনি ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, ‘ও, আমার হৃদয়, এটা তো সত্য যে আমার কবিতা খুবই কঠিন। খ্যাতিমান ও সফল কবিরা আমার কবিতা শুনে সেগুলো সহজ করতে বলে। কিন্তু কঠিন ছাড়া কোনো কবিতা লেখা আমার জন্যেই কঠিন।’

তাঁর কবিতা অপূর্ব নান্দনিক, ছন্দোময়, সহজ ভাবসমৃদ্ধ। নিজের লেখা কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই অহঙ্কারী। তাঁর ধারণা ছিল যে, খুব কম লোকই তাঁর কবিতা বিচার করতে, রস আস্বাদন করতে সক্ষম। আপন কাব্যপ্রয়াস প্রসঙ্গে লিখেছেন তিনি, “আমার হৃদয়ের আগুন থেকেই আলো দিচ্ছে আমার কবিতা। আমি যা লিখছি, তাতে একটি আঙুল দেয়ার সাধ্য নেই কারো।” দিল্লীর অভিজাত সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে নিজেকে মনে করতেন তিনি। সেভাবে চলাফেরা করতে এবং সে ধরনের আচার আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন। মদ্য পান করতেন এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তাঁর মন ছিল না। এজন্য তাঁকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে অনেকবার। জুয়া খেলার তীব্র নেশা ছিল এই কবির। জুয়া খেলার অপরাধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় এবং দু’শ’ রুপি জরিমানা করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি ওঠে। তখনকার সংবাদপত্রগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার পরও সরকার ছিল অনড়।

পুরো মেয়াদ কারাবাস অবশ্য মির্জা গালিবকে করতে হয়নি। তিন মাস পরেই মুক্তি দেয়া হয় তাঁকে। জেলখানায় তাঁকে কোনো শ্রম দিতে হয়নি। বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খেতে দেওয়া হয়েছে। দর্শনার্র্থীরাও সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন তাঁর সঙ্গে। দিল্লীর সিভিল সার্জনের সুপারিশে মেয়াদ পূর্তির আগেই মুক্তি লাভ করেন কবি। তবে এই শাস্তির নেতিবাচক প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছিল তাঁর ওপর। নিজেকে যে তিনি অভিজাত, বুদ্ধিজীবী এবং দুঃখ-আনন্দে অতি স্পর্শকাতর কবি বলে মনে করতেন, সে অহঙ্কার গুঁড়িয়ে যায় এ ঘটনার পর। এমন দুঃসময়ে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর গালিবের পাশে দাঁড়ান। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গালিবকে খেতাব দেন ‘নাজমুদ দৌলাহ দবির উল মূলক নিজাম জং’। তৈমুরের বংশ ইতিহাস লেখার দায়িত্ব প্রদান করেন। বার্ষিক ভাতা ছয় শ’ রুপি। মানসিকভাবে কিছুটা থিতু হলেন কারামুক্ত কবি। কিন্তু ইতিহাস লিখতে গেলে যে পড়াশোনা ও ধৈর্য দরকার, তা ছিল না তাঁর। সুতরাং কাজে বেশিদূর এগোতে পারেননি। যতটুকু লিখেছিলেন, তা ‘মিহির-ই-নিমরোজ’ নামে প্রকাশিত হয়। সেটা ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের কথা।

দারিদ্র্য, অর্থকষ্ট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সে এক দীর্ঘ প্রসঙ্গ। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর ভাতা বন্ধ করে দেয়। আর্থিক সঙ্কট ঘনীভূত হয় আরো। ভাতা পুনর্বহালের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির করা হয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু ফল হয়নি কোনো।

এবার একটু নজর দিচ্ছি আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর ‘গালিবের গজল থেকে’ গ্রন্থের ভূমিকায়। আইয়ুব লিখছেন,

“... গালিবের কবিতাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলা যায় এবং সে-ব্যক্তি কবি স্বয়ং। তবু সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ব’লে গালিবকে তাচ্ছিল্য করা যায় না। প্রায় সর্বত্রই তিনি নিজেকে এঁকেছেন অত্যন্ত সাধারণ রক্তমাংসের মানুষরূপে, এমন লক্ষ কামনা-বাসনায় পীড়িত যার অত্যধিক অংশই বাস্তবিক সম্ভাব্যতার সীমানা ছাড়িয়ে। এ-কথা তাঁর জানা আছে তবু সাধারণ মানুষের মতো তিনিও চাঁদের পানে হাত বাড়ান এবং নাগাল না-পেলে নিজের হতবিধিকে অভিসম্পাত দেন। তাই গালিব যখন একান্ত নিজের পরাজিত পর্যুদস্ত যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের কথা বলেন তখন পরোক্ষে তিনি সব সাধারণ মানুষের কথাই বলছেন।

অধিকাংশ সমালোচক ও সাহিত্যরসিকের মতে উর্দু ভাষার দুই শ্রেষ্ঠ কবি গালিব ও ইকবাল। অনেক দিক থেকে এই কবিদ্বয় প্রায় বিপরীতধর্মী; তবে একটি ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে আশ্চর্য মিল দেখা যায়। তাঁদের কাব্যসৃষ্টির একটি বড়ো ভাগÑ কারো কারো মতে, এবং সম্ভবত দুই কবির মতেও, শ্রেষ্ঠ ভাগÑ রচিত হয়েছে ফারসী ভাষায়। গালিব ১৫/১৬ বছর বয়সে কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন, এবং স্বভাবতই তখন তাঁর মাতৃভাষা উর্দুতেই কবিতা লিখতেন। কিন্তু ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত (১৮২৭ থেকে ১৮৪৭) তিনি ফারসী ভাষাকেই আত্মপ্রকাশের মূল বাহন করেছিলেন।

উর্দু ভাষায় প্রত্যাবর্তন ঘটে প্রধানত দুটি কারণে। তিনি দেখলেন যে তাঁর অবহেলিত উর্দুভাষার গজলগুলিই জনপ্রিয় হ’য়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, বয়স যখন পঞ্চাশের কাছাকাছি তখন দিল্লীর বাদশাহ বাহাদুর শাহের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ হ’য়ে ওঠে; এবং ঐ-সময়ে জওকের মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রকবি (শায়েরুল-মূলক) পদে বহাল হলেন। বাহাদুর শাহ জফর নিজে উর্দু ভাষায় কবিতা লিখতেন। অনেকটা তাঁরই প্ররোচনায় গালিব ফারসী ছেড়ে উর্দুর দিকে পুনরায় মনোযোগী হন।... উর্দুর সঙ্গে ফারসী ভাষার প্রাণের মিল অনেক বেশি। তাই স্বীকার করতে দোষ নেই যে কবি গালিবের উর্দু চলিত উর্দু নয়, একপ্রকার মিশ্রিত কিন্তু শক্তিশালী ভাষা যা তাঁরই সৃষ্টি এবং বৈশিষ্ট্য। ‘কবি গালিব’ বলছি এইজন্য যে উর্দু গদ্যের ইতিহাসে গালিবের অবদান সকলের স্বীকৃতি ও প্রশংসা লাভ করেছে। রামমোহনের মতো তাঁকে গদ্যের স্রষ্টা বলা যায় না, উর্দু গদ্য আরো প্রাচীন। তবে গালিব উর্দু গদ্যকে আশ্চর্য গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য দান করেছেন। অনেকের মতে তিনি আধুনিক উর্দু গদ্যের জন্মদাতা।”

জীবনের শেষ প্রান্তের কথা দিয়ে শেষ করছি এই লেখা।

‘গালিবের গজল থেকে’ বইয়ের কবিজীবনীতে লেখা হয়েছেঃ

“ অবশেষে ১৮৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যু এসে সব লাঞ্ছনা, সব দৈন্য, সব শারীরিক যন্ত্রণার অবসান ঘটালো। মৃত্যুর আগে কয়েকদিন বার-বার অচেতন হ’য়ে পড়ছিলেন, মাঝে মাঝে অল্পক্ষণের জন্য চেতনা ফিরে আসছিলো। হালী গিয়ে দেখেন চেতনা-অচেতনার দোলায় দুলতে-দুলতেই গালিব নবাব আলাউদ্দীন আহমেদ খানকে একটা চিঠির উত্তর লেখাচ্ছেনঃ “আমি কেমন আছি কেন জিজ্ঞাসা করছেন? দু-একদিন অপেক্ষা ক’রে আমার প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করবেন।’ তারপর সাদীর একটি শের উদ্ধৃত ক’রে বললেন,‘আপনি তো আমায় দেখতে আসতে পারলেন না, বেশ, খুদা হাফিজ।’

জানাজাতে (শোকযাত্রা) শিয়া-সুন্নী দুই সম্প্রদায়েরই বহু লোক গিয়েছিলেন। গণ্য-মান্যের অভাব ছিলো না। দাফনের আয়োজন শুরু হবার পূর্বমুহূর্তে শিয়া সম্প্রদায়ের একজন মুখপাত্র এগিয়ে এসে বললেন,“গালিব শিয়া ছিলেন, তাই যদি অনুমতি করেন তো আমাদের প্রথা অনুযায়ীই সব কাজ করি।’ কিন্তু নবাব জিয়াউদ্দীন আহমেদ সে-কথা কানেই তুললেন না।

সব অনুষ্ঠান সুন্নী মতে হ’লো। হালী লিখেছেন,“ কতো ভালো হ’তো যদি শিয়া-সুন্নী দু-পক্ষই সে-দিন জানাজার নামাজ পড়তেন, গালিব তো দুই সম্প্রদায়কেই সমান জ্ঞান করতেন।”

গালিবের জন্য যে বিশ্বের কোনো কাজই আটকে থাকবে না, তাই তাঁর মৃত্যুতে শোক করবার কিংবা অঝোরে কাঁদবার কোনো প্রয়োজন নেই সে-কথা তিনি নিজেই ব’লে গেছেন:

গালিব-এ খস্তা কে বগৈর কওন-সে কাম বন্দ হৈঁ।

রোইয়ে জার-জার ক্যা, কীজিয়ে হায় হায় কিঁউ?