রফিক রইচ

সাহিত্য লিখে পাঠককুলকে পাতালপুরীতে নিয়ে দিব্যি হাঁটানো যায়। আকাশে তুলে পাখির মতো উড়িয়ে ঘুরানো যায়। শরতের সাদা মেঘের ভেলায় ভাসানো যায়। কিন্তু তাতে আর যাই হোক টেকসই ও প্রাণবন্ত সাহিত্য রচনা হয় না। সাহিত্য তখনই টেকসই অনবদ্য ও প্রাণবন্ত সাহিত্য হবে যখন সে সাহিত্য মানুষের কল্যাণে লেখা হবে। আর তা থাকতে হবে জড়তামুক্ত। এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নেই, সে নির্জীব সাহিত্য দিয়ে আমাদের কোন উপকার হইবে না, আর তাহা স্থায়ী সাহিত্যও হইতে পারে না।

সাহিত্য লিখতে হবে স্বতস্ফূর্তভাবে। জোর করে নয়। কিংবা মুখে একরকম আর সাহিত্য লেখায় আরেক রকম। এটা নয়। যা প্রচলিত হয়ে গেছে বা ভাষার সাথে একাত্ম হয়ে গেছে, একাকার হয়ে মিশে গেছে তাকে সংস্কৃতি ফলাবার জন্য বাদ দিয়ে বা পরিবর্তন করে সাহিত্য রচনা করা নিষ্ফল। সে সাহিত্য কখনই টেকসই হতে পারে না। এক্ষেত্রে সাহিত্যিকদের হতে হবে নজরুলের ভাষায় আকাশের মতো উন্মুক্ত উদার, তাহাতে ধর্মবিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ, বড়, ছোট জ্ঞান থাকিবে না। বাঁধ দেওয়া ডোবার জলের মতো যদি সাহিত্যিকদের জীবন পঙ্কিল সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ হয়, তাহা হইলে তাহার সাহিত্য সাধনা সাংঘাতিকভাবে ব্যর্থ হইবে। তাহার সৃষ্টি সাহিত্য আঁতুড় ঘরেই মারা যাইবে। যাহার প্রাণ যত উদার যত উন্মুক্ত, তিনি তত বড় সাহিত্যিক। তাঁর লেখাও বড় সাহিত্য। অবশ্য সাহিত্য নানা কারণে বাঁক নিলেও প্রধানত একটি কারণে প্রকট ভূমিকা রাখে আর তা হল- কারা কখন কোন এলাকা শাসন করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী যখন প্রতিষ্ঠিত ছিল তখন সাহিত্যের এক ধরন ছিল আবার যখন ব্র্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লো তখন সাহিত্যের রূপ রেখা বা ধরন (চধঃঃবৎহ) পাল্টে গেল। তবে আমি মনে করি শাসন যার যখনই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন সাহিত্যে থাকতে হবে সার্বজনীনতা। সাহিত্যিকদের তা সেভাবেই সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু তা হয়নি কখনো। বরং উল্টো হয়েছে। যে সব শব্দ বাংলাতে মিশে গেছে সেটা আরবি হোক পারসী হোক, তুর্কী হোক, পর্তুগীজ হোক, ডচ হোক, ইংরেজী হোক-যাই হোক না কেন সে শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে বেশির ভাগ সাহিত্যিক রচনা করেছে সাহিত্য। যেগুলো আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে পুরোটাই এসে গেছে সেটাকে গুরুত্বই দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে দুজন মহারথীর মত তুলে ধরছি।

  • রবীন্দ্রনাথ বলেন “পার্সি আরবি শব্দ চলতি ভাষা বহুল পরিমাণে অসংকোচে হজম করে নিয়েছে। তারা এমন আতিথ্য পেয়েছে যে তারা যে ঘরের নয় সে কথা ভুলেই গেছি। ‘বিদায়’ কথাটা সংস্কৃত সাহিত্যে কোথাও মেলে না। সেটা আরবি ভাষা থেকে এসে দিব্যি সংস্কৃত পোশাক পরে বসেছে। ‘হয়রান করে’ দিয়েছে’ বললে ক্লান্তি ও অসহ্যতা মিশিয়ে যে ভাবটা মনে আসে, কোনো সংস্কৃতের আমদানি শব্দে তা হয় না। অমুকের কণ্ঠে গানে ‘দরদ’ লাগে না, বললে ঠিক কথাটা বলা হয় ও ছাড়া আর কোন কথাই নেই। গুরু-চণ্ডালির শাসনকর্তা যদি দরদের বদলে সংবেদনা চালাবার হুকুম করেন, তবে সে হুকুম অমান্য করলে অপরাধ হবে না।”

দিনেশ বাবু বলেন, “বর্তমান কালে গোঁড়া হিন্দুরা দিবা রাত্র যে সকল উর্দ্দু কি ফারসী শব্দ জিহ্বাগ্রে ব্যবহার করিয়া থাকেন, লেখনী মুখে তাহা বদলাইয়া তৎস্থলে সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করেন, এইরূপে ‘হজম’ স্থলে ‘পরিপাক’ বা ‘জীর্ণ’ ‘খাজনা’ স্থলে ‘রাজস্ব’ ‘ইজ্জৎ’ স্থলে ‘সম্মান’ ‘কবর’ স্থলে ‘সমাধি’, ‘কবুল’ স্থলে ‘স্বীকার’ ‘আমদানি স্থলে’ ‘আনয়ন’ বা সংগ্রহ করিয়া আনা খেসারৎ’ স্থলে ‘ক্ষতিপূরণ’ ‘জমিন’ স্থলে ‘ভূমি’ ‘খানদান’, স্থলে ‘পদ-প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি কথার প্রয়োগ করেন। একটু কাগজ লইয়া টুকিয়া দেখিবেন, বাঙ্গালা ভাষায় এইরূপ বিদেশী শব্দ কত প্রচলিত হইয়া গিয়াছে। ইহাতে আমাদের ভাষার জাত যায় নাই। পরের জিনিস আত্মসাৎ করিবার শক্তি সতেজ জীবনের লক্ষণ। শব্দগুলি বাদ সাদ দিয়া ভাষা শুদ্ধ করিয়া ইহাকে তুলসীতলা করিয়া রাখিলে হিন্দু-মুসলমানের উভয়ের মাতৃভাষাকে আমরা খণ্ডিত ও দুর্ব্বল করিয়া ফেলিব।”

তাহলে এখানে আসলে কোন স্বতস্ফূর্ততা থাকছে না। জোর করে শব্দগুলোকে বাদ দেয়া বা যোগ করে সাহিত্য রচনা করলে সে সাহিত্য ব্যর্থ হবে। হবেই। কাজেই আমাদের সংস্কৃতির সাথে যা মিশে গ্যাছে তার পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমেই টেকসই সাহিত্য রচনা করতে হবে। আর সেটাই করা উচিত। হওয়া উচিত। এতে করে কারও মগজে থাকবে না কোন কথা লাগবে না নিরবদ্য ব্যথা।