নূরজাহান নীরা
ছোটবেলায় যখন এত দূরদর্শন, দূরবার্তা, আকাশদর্শন বা ইন্টারনেট সুবিধা ছিল না তখন সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে চোখ রেখে চাঁদ দেখে তবে ঈদের দিন ঠিক হতো আর সেই ঈদের আনন্দের খবর চাঁদ দেখার সাথে সাথে রেডিওতেও ছড়িয়ে পড়ত একটি গানের মাধ্যমে, গানটি ছিল-
‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।
রোজার ঈদ আর এই গান যেনো একে অন্যের পরিপূরক ছিল। ঐ গান ছাড়া ঈদ পানসে। পরে জেনেছি ঐ গানের কথাগুলো লিখেছেন একজন কবি। যে কবির লেখা পড়ে শিশুমনের কল্পনার জগত হয়ে ওঠে আরও উচ্ছ্বসিত, আরও কল্পনাপ্রবণ, জাগরিত হয় সুপ্ত ইচ্ছেশক্তি। যার লেখা ইসলামি গানগুলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়কে শীতল করে তোলে, তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই আরবের মরুভূমির পথ ধরে তিনি উঠে গেছেন মহাকাশে। ‘কঠিন মরু সাহারায় কে এলো হায় ইসলামেরই ফুল...’বা আকাশ হতে চাঁদ নেমেছে মা আমেনার কোলে...। আবার দূরদৃষ্টি কলমের আচড়ে নেমে এসেছে থাকব না আর বদ্ধঘরে দেখব এবার জগতটাকে’। ছোটো একটা মোবাইল ডিভাইস। হাতের মুঠোয় রেখে বিশ্ব দেখি। কবির কল্পনা কতটা দূরদর্শী হলে এমন লেখা আসে ভাবলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। ছোট বেলায় পিতৃহীন হয়ে কঠিন দরিদ্রতার মধ্যে পড়েন তিনি। এ সময়ে তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। দারিদ্র্যের কারণে মূলত লেখাপড়ার চেয়ে তিনি কর্মজীবনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং সেনাবাহিনীতে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন। ধূমকেতুর মতো বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। তিনি শুধু ইসলামী সংগীতই লিখেছেন তা না, লিখেছেন শ্যামা সংগীতও। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, ও শিশুতোষ ছড়াও। বলা যায় বাংলা শিশু সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক তীক্ষ্ণ প্রতীভার অধিকারী। তিনি গভীরভাবে শিশুদেরকে উপলব্ধি করতে পারতেন, উপলব্ধি করতে পারতেন সমাজের নিঁখুত চিত্র। তাইতো খুব সহজেই তিনি ছন্দের তালে মজার ছলে শিশুদের কাছে নিজের সাহিত্যকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের যেমন বিদ্রোহী মনোভাব ছিল, ছিল সাম্যের টান তেমনি ছিল একটা শিশুসুলভ সারল্য মন। শিশুদের কল্পনা, সাধ, আকাক্সক্ষা, খেলাধুলা, কার্যকলাপ, মা বাবার সাথে খুনসুটি, অভিমান, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, কল্পনার জগত এসব বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং সাহিত্যে তার রূপদান করেছেন। যেমন শিশুদের কৌতূহলী মন পাখা মেলে উড়তে চায়। অজানাকে জানতে চায়। তাইতো বারবার আছাড় খেয়েও শিশু আবার উঠে দাঁড়ায়, হাঁটতে চেষ্টা করে। আঘাতের যন্ত্রণা সে ভুলে যায়। তার শেখার ইচ্ছে শক্তি তাকে সব যন্ত্রণা লাঘব করে দেয়। শিশু মনের সে ভাষায় নিজেকে মিলিয়ে কবি লিখেছেন -
আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুব বাগে
উঠব আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে
উঠবো আমি জেগে
হয়নি সকাল ঘুমো এখন
মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি, আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি
সকাল হবে নাকো।
কবিতার মাঝে শিশুমনের ভাব প্রকাশের সাথে সাথে শিক্ষণীয় বিষয়ও তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখায়। সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে উঠা স্বাস্থ্যের জন্য উপকার। পাখির কিচিরমিচির ডাকে সকালের ঘুম ভাঙে। লেখার মাঝে তিনি সেই পাখির আগেই শিশুদের ঘুম ভাঙার উৎসাহ জাগিয়েছে। ভোরের নির্মল বাতাসে শরীরের জড়তা কেটে যায় । ভোরে উঠা অভ্যাসে শিশু হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
শিশুদের মধ্যে যেমন বিচরণ করেছেন তেমনি আবার গর্জে উঠেছেন প্রতিবাদে সরব হয়ে।
তিনি জেলে বসেই লিখেছিলেন -
কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট...।
তার লেখা রণসংগীত মানুষকে উজ্জীবিত করে দারুণ ভাবে। মানসিক শক্তি অর্জনে রণ সংগীতের শব্দগুলো রক্তে ঢেউ তোলে।
এছাড়াও কীর্তন-বাউল-জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের প্রতি ছিল তার প্রাণের টান। তার আয়ত্তে ছিল ফারসি গজলের মনমাতানো সুর। যাতে সব বয়সী মানুষের হৃদয় জয় করে নিতে পেরেছিলেন সহজেই। সব ধরনের শোষণ-শাসন ও শৃঙ্খলের বিরুদ্ধাচরণে আর দুর্জয় সাধনায় তিনি ছিলেন ব্রতচারী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, জাগরণের কবি, নিপীড়িত মানুষের কবি, শিশুদের কবি। আবহমান গ্রাম বাংলার গ্রামীণ পটভূমি তার শিশুতোষ লেখায় উঠে এসেছে অধিক যা শিশুমনকে সহজেই রাঙিয়ে দেয়। শিশুমনকে উজ্জীবিত করে সহজেই। কাজী নজরুল ইসলামের সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম আজও আমাদের মনে দোলা দেয়, নিয়ে যায় সেই শিশু বেলায়।
বহুমাত্রিক এই কবির অনেক লেখার মাঝে একটি লেখা-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কবিতাটি গ্রামের পথে পা রাখলেই মনের পাতায় ভেসে ওঠে আমগাছের নিচে মাচান বাঁধা, দোলখেলা আর কাঠবিড়ালির সাথে দুষ্টমির সেইদিনগুলো। শ্রদ্ধায় স্মরণ করি প্রিয় কবিকে।