একজন সংস্কৃতিচিন্তকের বিদায়
ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ
ডক্টর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ ইন্তিকাল করেছেন। কথাটা ভাবেতই কষ্টের মেঘ জমে যায় হৃদয় আকাশে। কারণ ওবায়েদুল্লাহ মানে একজন চৌকস সংগঠক, একজন কবি, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ৮ মে বিকেল পৌনে ৩টায় তাঁকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ মে রাত দেড়টায় ৬৫ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেছেন। স্ত্রী, ২ পুত্র ও ৩ কন্যাসহ বহু আত্মীয়-স্বজন রেখে গেলেন। ১১ মে সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে প্রথম জানাযায় ইমামতি করেন মরহুমের দ্বিতীয় ছেলে মুয়াজ আবরার এবং ভোলার চরফ্যাশন কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসার সামনে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ড. ওবায়েদুল্লাহর জন্ম ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও কমনওয়েলথ এক্সিকিউটিভ এমবিএ ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। পিএইচ.ডি অর্জন করেছেন এ্যাডওয়ার্ড সাঈদকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশাগত জীবনে তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাকালীন রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্তিকালের পূর্বে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। পাশাপাশি বয়েজ স্কাউট ও রেড ক্রিসেন্টসহ নানা সংগঠনে যুক্ত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে তাঁর অনবদ্য অবদান রয়েছে। প্যারেন্টিং কাউন্সিলিং নিয়ে তাঁর তৎপরতা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে পীস স্কুল এন্ড কলেজের অনতম স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠিাতা। তিনি মাসিক অঙ্গীকার ডাইজেস্টের সম্পাদক এবং হুইল বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ইন্তিকালের পরে সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছিল। ডক্টর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ হাল ধরেছিলেন সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এসে। গড়ে তুলেছেন দেশীয় সাংস্কৃতিক সংসদ। সারা দেশে প্রায় ৯৫টি শাখা নিয়ে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। চারটি জাতীয় সংগঠন দেশীয় সাংস্কৃতিক সংসদ এর ছায়ায় কাজ করে চলেছে। ইসলামী আদর্শের সঙ্গীত চর্চায় কাজ করে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ সঙ্গীতকেন্দ্র’। কবিতার সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ‘কবিতা বাংলাদেশ’। নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের অঙ্গনে কাজ করছে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও নাট্য সংসদ’। আঁকিবুকি এবং কার্টুনসহ শিল্পচর্চার অঙ্গনে কাজ করছে ‘চারুকারু শিল্পী পরিষদ’। প্রতিটি সংগঠনকে বুকের মায়ায় আগলে রেখেছিলেন ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ।
ছাত্রজীবন থেকেই কবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ। ছড়া-কবিতা লেখা, কুরআন তিলাওয়াত, আবৃত্তি, অভিনয়, কৌতুক, ছবি আঁকা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সাহিত্য সভা, গল্পের আড্ডা এ সবের মধ্যদিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর লেখা ‘সাহিত্য সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থের লেখকের কথায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘ছোটবেলায় প্রাথমিকে পড়ার সময় থেকে হাতে লিখে দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। স্যারেরা গাইড করতেন। লেখা যোগাড় করা, টাকা পয়সা জোগাড় করা, রং-পেন্সিল-কলম কেনা, কাগজ কেনা, তারপর রাত জেগে পত্রিকার কাজ শেষ করা। এখন ভাবতেই অবাক লাগে, এভাবে ছোট থাকতেই এ কাজগুলো আমরা করতাম। হ্যাঁ, এভাবেই সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হই আমরা।’
১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো। ঝড়ের তান্ডবের উপর একটি অনন্য গীতিকবিতা লিখেছিলেন- ‘দ্যাশের মানুষ হইলো বেহুশ হারাইয়া স্বজন/ বানের তোড়ে ভাইসা গ্যাছে কত আপনজন।’ সুরকার-শিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সাইফুল্লাহ মানছুর গানটি সুরারোপ করে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। গানটি আজও কানে বাজে। এ রকম অসংখ্য গানের গীতিকার তিনি। গীতিকবিতায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো।
প্রবন্ধকার ও গবেষক হিসেবে ডক্টর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ অনন্য কৃতিমান ব্যক্তিত্ব। বিশেষত শিশু ও তারুণ্যের আইডল ছিলো তাঁর লেখালেখি। ‘সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থটি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মানুষের আত্মার খোরাক হিসেবে বিবেচিত। ‘তরুণ তোমার জন্য’ ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ‘সাহসের মন্ত্র’ গ্রন্থ তিনটি তারুণ্যের উদ্দীপ্ত চেতনার খোরাক। ‘কী টু সাকসেস : ম্যানার এন্ড এটিকেটস’, ‘শেপ দ্য লাইফ’ এবং ‘গ্রোইং চিলড্্েরন মাইন্ডস’ শিরোনামের তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ চৌকস প্রতিভাবান তরুণদের কাছে দারুণভাবে সমাদৃত।
নিজের কর্মচঞ্চলতার প্রসঙ্গে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘শুরু হলো সাহিত্য-সংস্কৃতির হাতেখড়ি, লেখক-কবি হওয়া, আস্তে আস্তে সংগঠন করতে অভ্যস্ত হওয়া এবং কালক্রমে লিটল ম্যাগ-সাহিত্য পত্রিকা ইত্যাদিতে পেয়ে বসে আমাদেরকে। প্রুফ দেখার সে কী আনন্দ! সম্পাদিত পত্রিকার তাজা তাজা কপি নিয়ে সবার কাছে পৌঁছানোর যে ছুটাছুটি সে এক অন্যরকম অনুভূতি।’
ড. আ জ ম ওবায়দুল্লাহ একজন উঁচুমানের সংগঠক ছিলেন। তিনি অনেক শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশে এবং ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। তিনি অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও স্পষ্টভাষী ছিলেন। তিনি মুহূর্তেই যে কাউকে আপন করে নিতে পারতেন। প্রকাশনার জগতে তাঁর স্বপ্ন বিস্তৃত হয়েছে সবুজের মতো। উদার আকাশের মতো। সাগরের বিশালতার স্বপ্ন নিয়ে। দেশজ প্রকাশনীকে তিনি নতুন স্বপ্নের প্লাটফর্ম গড়ার চেষ্টায় কাজ করেছেন। নজরুল শিশু-কিশোর সমগ্র, ফররুখ আহমদ, শ্রেষ্ঠ শিশু কিশোর সাহিত্য, প্রথম প্রকাশ হিসেবে নতুনভাবে লেখকদের জাগিয়ে তোলার প্রয়াস এবং ৬ খণ্ডের মল্লিক রচনাবলী আমাদের প্রকাশনা জগতের নতুন স্বপ্ন উন্মোচন করেছে। শুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার জন্য ত্রয়োমাসিক পত্রিকা ‘শতাব্দী’ বিশেষ কমিটমেন্ট নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
অতি অল্পসময়ের ব্যবধানে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আসাদ বিন হাফিজ। চলে গেলেন তারই আরেক কবিবন্ধু মুকুল চৌধুরী। চলে গেলেন বিশুদ্ধ সংস্কৃতির আরেক আকাশ মোস্তফা জামান আব্বাসী। এই মনীষীগণের বিদায়ের মধ্য দিয়ে হতাশার কালো অন্ধকার ধেয়ে আসছে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে। এই সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস আরো বেশি দরকার। তাহলেই আমরা সকলে মিলে সেই অন্ধকার তাড়িয়ে সম্ভাবনার নতুন আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবো। তৈরি করতে সক্ষম হবো আগামীর সুন্দর বিশুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতির স্বপ্নউঠোন। গড়ে তুলতে পারবো বসবাসের উপযোগী সুখময় নান্দনিক বাংলাদেশ।