ড. মোজাফফর হোসেন

বলশেভিক বিপ্লবের রশদ যুগিয়েছিলেন ভøাদিমির মায়োকভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০)। তিনি রাশিয়ার পুরাতন রাজনীতির শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়ে করতে চেয়েছিলেন নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্ত। সেজন্য রাশিয়ার শিল্প-সাহিত্যের গাত্রে অঙ্কন করেছিলেন বিপ্লবের অগ্নিচিত্র। আর মায়োকভস্কির কবিতা হয়ে ওঠেছিল তরুণদের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার আগ্নেয়াস্ত্র। যুগে যুগে ভøাদিমির মায়োকভস্কির মতো বিপ্লবী কবিদের উত্থান ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। তাদের অন্যতম চিলির পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩), ইংরেজ কবি পার্শি বিশি শেলি (১৭৯২-১৮২২), লাতিন আমেরিকার এনেস্তো কার্দেনাল(১৯২৫-২০২০)। এসব কবি মজলুম নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লিখেছেন কবিতা। তাদের কবিতা রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে কাজ করেছে বারুদের মতো। উর্দু সাহিত্যের বিপ্লবী কবিতার মহানয়ক ছিলেন কবি আল্লামা ইকবাল; যিনি পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নপুরুষ। তাঁর কবিতা যেন স্ফুলিঙ্গ। তাঁর কবিতাও পাকিস্তানের তরুণদের করেছিল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী। বাংলা সাহিত্যও পেয়েছে বিপ্লবী কবিদের উষ্ণ সাহচর্য। পেয়েছে আশা জাগানিয়া বিপ্লবী কবিতা। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬); ফররুখ আহমেদ (১৯১৮-১৯৭৪) ও সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭) ছিলেন বিপ্লব ও বিদ্রোহ ধারার অন্যতম কাব্যপ্রতিভা। সুকান্ত লিখে ফেললেন ‘সাবাশ বাংলাদেশ/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ নজরুলের অসংখ্য কবিতা ইংরেজদের দুঃশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে; মানুষকে করেছে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত। বিপ্লবী কবিদের পথ বেয়ে বাংলা সাহিত্যে আরেক কবির আগমন ঘটেছে; তিনি মোশাররফ হোসেন খান (১৯৫৭, ২৪ আগস্ট)। তাঁর কাব্যচর্চা চলছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে; প্রকৃত মুক্তির লক্ষে।

যে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি দিনের পর দিন। বরং অধপতন ঘটেছে মানবতার। মানুষ বঞ্চিত হতে থাকেন রাষ্ট্রীয় সুশাসন থেকে। এ সময়ে রাজনীতির মিথ্যা অহংকারে রাজনীতিকরা হয়ে ওঠেন জনসাধারণের প্রতিপক্ষ। ফলে দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার চরিতার্থ করতে প্রতিনিয়ত হতেন বাধার সম্মুখিন। বিশেষ করে গত ১৭ বছর সরকারের কাছে ইনসাফ প্রত্যাশা করে মানুষ বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তান্ডবে দেশের নাগরিক শ্বাসরুদ্ধকর সামাজিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন, যা পাকিস্তানের নিপীড়নকে ম্লান করে দিয়েছে। সচেতন কবি হিসাবে কবি মোশাররফ হোসেন খান মানবতাহীন এই রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র তাঁর কবিতায় ধারণ করে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য লেখেছেন দ্রোহের পঙক্তি। তিনি লিখলেন ‘পুনর্জাগরণ’- ‘আমার ছোট ছোট ক্ষোভগুলো/সিকি-আনা-পাইয়ের মতো/প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত জমা করে রাখি/জমা হতে হতে একদিন পাহাড়ের মতো হবে/জমা হতে হতে একদিন খুব ঘন কালো মেঘ হবে/জমা হতে হতে একদিন চূড়ান্ত বজ্রপাত হবে/এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষোভের খোলস থেকে বেরিয়ে আসবে/শতকোটি মানুষের জন্য একটি মাত্র কণ্ঠস্বর/খামোস!/অবাক স্তব্ধতার মধ্যে/বিপুল বিস্ময়ের মধ্যে পৃথিবী দেখবে-/ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে/মানুষ ও মানবতার পুনর্জাগরণ. . .!’

ক্ষোভ, দ্রোহ, আক্ষেপ ও বঞ্চনার স্তূপ উঁচু হতে থাকলে সেখান থেকে স্বপ্নহীন মানুষও ঘুরে দাঁড়াতে শিখে যায়। স্বপ্ন দেখতে শেখে। স্বপ্নকে বাস্তব করতে প্রতিবাদের জন্য, বিদ্রোহের জন্য, প্রতিরোধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। এভাবে প্রস্তুত হতে হতে সর্বশেষ দুর্বল মানুষটিরও শিরদাঁড়া দৃঢ় থেকে দৃঢ় হতে থাকে। বাংলাদেশে তিপ্পান্ন বছর পর চব্বিশের জুলাই আগস্টে তারই চিত্র দেখা গেছে গণভবনের খোলা মাঠে, ভেতরে, বাহিরে এমন কী অন্দরেও। এই যে দ্রোহের যাত্রা তার পথের সম্বল তৈরিতে মোশাররফ হোসেন খানের অবদান খাটো হবার নয়। কেননা তাঁর কলমে লেখা হলো প্রতিবাদের কাব্য। তিনি লিখলেন -

‘আসুন ঘুরে দাঁড়াই/ যেমন ঘুরে দাঁড়ায় সংক্ষুদ্ধ মৌমাছি/ পিপীলিকা যেমন ঘুরে দাঁড়ায়/কাকপক্ষী যেমন ঘুরে দাঁড়ায়/মুরগী যেমন ঘুরে দাঁড়ায়.. .. ../একবার ঘুরে দাঁড়াতে পারলেই/ দুই পা আর অবস হবে না/একবার ঘুরে দাঁড়াতে পারলেই/সামনে সবুজ স্বাধীনতা/আসুন ঘুরে দাঁড়াই/আমাদের জন্য/উত্তরসূরিদের জন্য।’

চব্বিশের গণজোয়ারকে এগিয়ে নিতে মোশাররফ হোসেন খান নিরলস পরিশ্রম করে দ্রোহের কবিতার পসরা সাজিছেন। মানুষকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলার কাজটি মূলত লেখকরা করে থাকেন। যে কাজ নজরুল, ফররুখ, সুকান্তরা করেছিলেন ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে। সে কাজ মোশাররফ হোসেন খানরা করেছেন আওয়ামী দুঃশাসনকে উৎখাত করার জন্যে। তিনি লিখলেন-

‘ক্ষোভের মিছিল দ্বিগুণ হলো/ভাঙলো অধীনতা/রক্ত সাগর পেরিয়ে তারা/আনলোস্বাধীনতা/

বুকেরভেতর আগুন জ্বলে/চোখের ভেতর অগ্নি/ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বীর/চব্বিশের ভাই ভগ্নি।’

কবি মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যপ্রতিভা অল্পপরিসরের অবকাশ রাখে না। তিনি হাজার তরুণের চোখে বুনে চলেছেন মানবতাবাদের স্বপ্ন। সত্যিকারের মানবিক বাংলাদেশ গড়তে তিনি তারুণ্যকে কাছে টানছেন। সত্য অনুসন্ধানী এই কবির জীবনকাল দীর্ঘ হোক্, তাঁর কাব্যে মুক্তিপাক মানবতা।