আযাদ আলাউদ্দীন
২০০২ সালের ২৩ আগস্ট শুক্রবার ভোর থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল বরিশাল শহরে। ফজরের নামাজ আদায় করে কুরআন হাদিস অধ্যয়ন করতে করতে সকাল ৭ টা বেজে গেছে। ভাবলাম এই ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে গান শুনলে মন্দ হয় না। উচ্চারণ শিল্পীগোষ্ঠীর ‘প্রশংসা তোমারি’ ক্যাসেটটা বাজিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছি- এমন সময় হকার প্রতিদিনের ন্যায় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা দিয়ে গেল। সাংবাদিকতা করার কারণে পত্রিকা পড়ার নেশাটা সাধারণ পাঠকের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি। ঘুম কি আর হয়? পত্রিকা পড়ছি আর গান শুনছি।
প্রথম পৃষ্ঠার একটি নিউজের বাকি অংশ পড়ার জন্য ২৩ নম্বর পৃষ্ঠা উল্টাতেই কবি গোলাম মোহাম্মদের ইন্তেকাল খবরটা চোখে পড়ল। যুগান্তর পত্রিকা দেখে ভেবেছিলাম হয়তো অন্য কোনো গোলাম মোহাম্মদ হবে। তবুও গোলাম মোহাম্মদ বলে কথা! সবটা নিউজ পড়ে তৎকালীন সমাজকল্যামন্ত্রী, কবি আল মাহমুদসহ মল্লিক ভাইদের শোক প্রকাশ দেখে মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো- আবেগ আরও ঘনীভূত হলো এই কারণে যে ঠিক তখন-ই ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছিল কবি গোলাম মোহাম্মদের লেখা সেই বিখ্যাত গান ‘হলদে ডানার সেই পাখিটা এখন ডালে ডাকে না, মনের কোণে রঙিন ছবি এখন সে আর আঁকে না...।’
বাইরে যে বর্ষা হচ্ছিল তার চেয়েও অঝোর ধারায় বর্ষা হতে লাগলো আমার মনের মাঝে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাল নিজ দু’চোখ। আবেগকে সংবরণ করতে পারছিলাম না। ছাতাটা মাথার নিয়ে ছুটে গেলাম পার্শ্ববর্তী সংগঠনের মেসে। ভাবলাম দৈনিক সংগ্রাম পড়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাবে। দেখলাম দৈনিক সংগ্রামের প্রথম পৃষ্ঠায় রঙিন ছবিসহ ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর খবরটি। অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হয়েছে জীবন্ত তিনি! তাকিয়ে আছেন। তাঁকে নিয়ে দৈনিক সংগ্রামের তাৎক্ষণিক ‘বিশেষ সংখ্যা’ দেখে আশ্চর্য হলাম। তাঁর মৃত্যুর সংবাদের সাথে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ যেন- সহকর্মী ও সহযাত্রীদের গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ সংখ্যাটিতে যারা লিখেছিলেন তারা সবাই কবি গোলাম মোহাম্মদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, স্মৃতিচারণগুলো পড়ে সেটাই বোঝা গেল। প্রিয় সাথীকে হারিয়ে তারা ছিলেন শোকাভিভূত। শুধু তাই নয় তাঁর লেখার অসংখ্য পাঠক-ভক্তরাও তাদের শোক প্রকাশ করেছেন। সেদিন গানের ক্লাসে হেরাররশ্মির শিল্পীদের মাঝেও তাঁকে বার বার স্মরণ করতে দেখলাম। একইদিন বিকেলে বরিশাল শেকড় সাহিত্য সংসদের সাহিত্য সভায় তাঁর স্মরণে দোয়া অনুষ্ঠান হয়েছে। বরিশালে ডান ধারার অনেক সংগঠনই কবির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে স্থানীয় পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন।
কবি গোলাম মোহাম্মদের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম ১৯৯৮ সাল থেকে। তবে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২ টায়। রাজধানী ঢাকায় মগবাজার ওয়্যারলেস রেলগেটে চাষীকল্যাণ ভবনের নিচতলায় তখন ছিলো- স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার তথা সিএইচপি’র বিক্রয় কেন্দ্র। অডিও ক্যাসেট কিনতে সেখানে গিয়ে দেখলাম শিল্পী ও সুরকার মশিউর রহমান এবং কবি গোলাম মোহাম্মদ সিঙারা খাচ্ছিলেন। মশিউর ভাই আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন- উনি কবি গোলাম মোহাম্মদ। আমি বললাম হ্যাঁ, আপনার অনেক লেখা পড়েছি। আপনার গানগুলো আমরা প্রায়ই শুনি। স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি দিয়ে একটি সিঙারা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন। আমি আপত্তি জানিয়ে কোন লাভ হলো না- আমাকে সিঙারা খাইয়ে তিনি যেন পরম তৃপ্তি পেলেন। আমার সাথে ছিল আমারই সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘উৎস’ ভাষা দিবস সংখ্যা। তাঁকে এবং মশিউর ভাই দু’জনকে দু’টি কপি উপহার দিলাম। কবি গোলাম মোহাম্মদ বলে উঠলেন, বাহ্ আগামীকাল ২১ ফেব্্রুয়ারি তার একদিন আগে হাতে ভাষা দিবসের একটি প্রকাশনা পেলাম- ‘ভালোই লাগছে’। এমনিভাবে পনের-বিশ মিনিটের আলোচনায় তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনিও যেন একই আদর্শে বিশ্বাসী একজন তরুণ লেখককে পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছেন। তিনি বরিশালের ‘হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী’ এবং ‘শেকড় সাহিত্য সংসদ’র খোঁজ নিলেন। আমি তাঁর কাছে ‘উৎস’র জন্য কবিতা আর হেরাররশ্মির জন্য গান চাইতেই তিনি বললেন- দেবো। আরও বললেন- মশিউর ভাইয়ের স্টকে আমার অনেক গান সংরক্ষণ করা আছে। মশিউর ভাইও হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলেন। এমনিভাবে নানা আলাপের মাধ্যমে সেদিন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এরপর অনেকবারই তার সান্নিধ্য পেয়েছি- ‘চাড়ুলিয়া’ সম্পাদক কবি ওমর বিশ্বাসকে খুঁজতে গিয়ে ‘শিল্পকোণ’এ বসে তাঁর সাথে অনেক কথা হয়েছে। আল ফালাহ মিলানায়তনে সাংস্কৃতিক দায়িত্বশীল ক্যাম্পে তাঁর কবিতা আবৃত্তির দৃশ্য, পাশাপাশি বসে একত্রে ভাত খাওয়ার সময় নানা উপদেশমূলক কথাগুলো এখনো স্মৃতির দর্পণে ভেসে উঠছে। লেখকদের খোঁজখবর নিয়ে তিনি যেন খুব আনন্দ পেতেন। বরিশালের লেখকদের খোঁজ নিতেন আমার কাছে। বলতেন- কবি নয়ন আহমেদ কি করেন, আল হাফিজ কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
সহযাত্রী কবিদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। একবার কবি আল হাফিজ ঢাকা থেকে বরিশাল এসে আমাদের কারো সাথে দেখা না করে বাসায় অবস্থান করছিলেন নীরবে-নিভৃতে। আমরা তো জানি তিনি ঢাকায় আছেন। সাংস্কৃতিক কর্মশালায় কবি গোলাম মোহাম্মদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আল হাফিজ ভাই কোথায়? তিনি বললেন, কেন তিনি তো বরিশালে গিয়েছেন। আমি বললাম, তিনি বরিশালে নেই। তিনি আশ্চর্য হয়ে কবি জাকির আবু জাফরকে বললেন, আপনি জানেন কিছু? আল হাফিজ সাহেব গেলেন কোথায় তাহলে? এরপর দেখলাম তিনি একাধিক লোকজনের কাছে কবি আল হাফিজ কোথায় আছে তার খোঁজ নিচ্ছেন। এই যে একজন কবির জন্য আরেকজন কবির হৃদয়ের এই টান- এটাইবা ক’জনের মধ্যে আছে।
যেহেতু আমাদের কারো কাছেই তখন মোবাইল ফোন ছিলো না, তাই পারস্পরিক যোগাযোগ অতো সহজ ছিলো না। কবি গোলাম মোহাম্মদের মৃত্যুর কয়েকদিন পর আমার কাছে যখন খবরটি শোনেন- কবি আল হাফিজ ও কবি কামাল আহসান তখন হতবাক হয়েছিলেন তারা। আশ্চর্য হয়ে বললেন, কি বলছো তুমি? গোলাম মোহাম্মদ ভাই মারা গেছেন! যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না তাঁরা। সেদিনই কবি আল হাফিজ আর কবি কামাল আহসান বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে গেছেন, কবির পরিবারের সার্বিক খোঁজ নিতে। এভাবেই লেখকদের ভালোবাসতেন তিনি। সেই ভালোবাসার কবি, বনবনানী, সবুজ বীথি আর পাখ-পাখালির কবি গোলাম মোহাম্মদ আমাদের মাঝে নেই! ভাবতেই যেন অবাক লাগে। ভেবে আর কি লাভ? এভাবে তো সকলকেই একদিন প্রভুর সান্নিধ্যে যেতে হবে। শিল্পীর গানে গানে বলতে হয়- ‘এই দুনিয়া হবে ছাড়তে... দুইদিন আগে পরে....।