শহিদুল ইসলাম
বিশ্বজুড়ে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার। পরিবেশের উপর তাপপ্রবাহ ছোবলের ফলে ধারিত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে শঙকা দেখা দিচ্ছে। জীব বৈচিত্র্য রক্ষার আশু ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। বিজ্ঞানীদের মতে অদূর ভবিষ্যতে ১১ হাজারের ও বেশি প্রজাতির বিলুপ্তির অপেক্ষায় আছে। এর মতে ৩০ শতাংশ মৎস্য এবং এক চতুর্থাংশ স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ। বায়ুমন্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ ২১০০ সালের দিকে ১০০০ পি পি এম পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করতে যেয়ে ওয়াল্ড ওয়াইড লাইফ ফান্ড (WWLF) বলেছে ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর আয়তনের সমতুল্য আরও দুই গ্রহের সন্ধান করতে হবে। কারণ এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেখানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে না সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি। সৃষ্টি, কৃষ্টি, স্বপ্ন জীবনবোধ ও সার্বভৌমত্ত্বের প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং বিশ্ব বাসিকে সত্য জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসংযত জীবন পরিহার করে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কিছুটা কমাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ফলদায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবেশ সচেতন কবি নজরুল তার সাহিত্যের ভিতর বিভিন্ন দিক দিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সামাজিক, সংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক দিক দিয়ে বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতি তিনি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে পরিবেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তা ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ‘‘রোজ-কেয়ামত বা প্রলয় দিন।’’- প্রবন্ধে নজরুল বলেন-
‘‘এ সবের মানে কি? প্রফেসর লুইস ও অন্যান্য বড় বড় বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের পৃথিবীতে দ্বিতীয় মহা প্লাবন বা মহাধ্বংস অতি আসন্ন। যদি সমস্ত দুনিয়াও ধ্বংস না হয় তাহা হইলে পৃথিবীর একাংশ যে ধ্বংস হইয়া যাইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাস্তি।
দক্ষিণ মেরুতে যে গগনচুম্বী বরফের মহাআচ্ছাদন রহিয়াছে তাহা লম্বাতে চৌদ্দ শত মাইল এবং কত শত মাইল যে পুরু তাহার ইয়াত্তা নাই। এখন যে দক্ষিণ মেরুর আবহাওয়া এই রকমে ক্রমে অসহ্য উষ্ণ হইয়া উঠিতেছে ইহার পরিণাম কি সকলেই জানেন বরফ গরম হইলে গলিয়া যায়। সুতরাং এখন দক্ষিণ মেরুর এই অত্যাধিক উষ্ণতার দরুন সেখানের ঐ সহস্র সহস্র যোজন ব্যাপী তুষারের মহা পর্বতসমূহ ভাঙ্গিয়া গলিয়া যাইবে। এবং আকাশ সমান সচল হিমালয়ের মত তরঙ্গের রাশি চতুর্দিক ধুইয়া মুছিয়া লইয়া যাইবে। প্রথমে এই মহা প্লাবন আক্রান্ত হইবে পৃথিবীর ঢালু দিক অর্থাৎ দক্ষিণ মহাদেশ সমূহ।’’
পরিবেশ সচেতন কবি নজরুল আরও বলেন- ‘‘কয়লা যুগের সময় এই পৃথিবীর বাতাস কার্বনিক এসিডের দরুন ভারি ছিল। সে সময় সে বাতাস মানুষ সহ্য করিতে পারিত না। কেবল মৎস্য ও সরীসৃপ জাতীয় জীববৃন্দ স্রোতাময় জলাভূমিতে ও নিশ্চল বাতাসে বাঁচিয়ে ছিল। ক্রমশ উদ্ভিদ ও গাছ গাছরার বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিষাক্ত নিশ্চল বাতাস দূর হইয়া যাইতে লাগল। আকাশ পরিষ্কার হইলো এবং এই রূপে এই বাতাস রক্তময় জীবের উপযোগী হইয়া উঠিল।’’ বিশ্বের চারভাগের একভাগ লোক মারা যায় বজ্রপাতে। জলবায়ুগত কারণে বজ্রপাতে বেড়েছে শতকরা পাঁচ ভাগ। দশ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২৫০০ লোক বজ্রপাত মারা গেছে। এটি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ভয়ানক অবস্থায় ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে নজরুল তা-‘‘রোজ কেয়ামত বা প্রলয় দিন-’’ প্রবন্ধে বলেন- ‘‘আগে হইতে আবহাওয়ার ক্রম পরিবর্তন পরিলক্ষিত হইতেছে। বজ্রাঘাত বিশেষ করিয়া শীতকালে বজ্রপাত- ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। আর ইহার একদম সোজা কারণ রহিয়াছে যে পৃথিবীর আর বাতাসের ইলেক্ট্রসিটির ঠৌকাঠুকির দরুনই এই উৎপাতের সৃষ্টি। তাহা হইলে ‘ক’ পন্থা? সেই জন্যই বুঝি পান্নাময়ী আগে হইতেই গাইয়া রাখিয়াছে। মরিব মরিব সখি নিশ্চই মরিব।’’
সূর্য একটি জ¦লন্ত নক্ষত্র। সূর্যের বহিঃদেশের তাপমাত্রা ৬০০০০ সেন্টিগ্রেট। কেন্দ্র ভাগের তাপমাত্রা ১৫০০০০০ সেন্টিগ্রেট। লোহার বলকে যদি সূর্যের ভিতর ছুড়ে মারা যায় তাহলে বাষ্প হতে এক সেকেন্ড ও সময় লাগবে না। সূর্য পূর্ব গগনে উদিত হয় এবং পশ্চিম গগনে অস্ত যায়। এই সূর্য সম্পর্কে বলতে যেয়ে কবি নজরুল তার ‘‘রোজ কেয়ামত বা প্রলয় দিন’’- প্রবন্ধে বলেন- বর্তমান সূর্যি মামার ক্ষমতা এত উগ্র প্রচন্ড যে যদি এর সমস্ত রশ্নি আর উগ্রতা শুধু আমাদের এই গরীব পৃথিবীর উপর আসিয়া পড়িত তাহা হইলে মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যেই ঐ যে আগে মহা মহা বরফ পর্বতের কথা বলিয়াই সে সমস্ত গলিয়া টকবক করিয়া ফুটিত। এবং আর এগারো সেকেন্ড থাকিলে দুনিয়ার এত বড় সমুদ্র পর্যন্ত শুকাইয়া ফাটিয়া চৌচির হইয়া হা করিয়া থাকিত।’’
গোটা পৃথিবী যখন পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিভীষিকাময় অবস্থা এবং ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা দেখা দিচ্ছে তখন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ থেকে নিজকে দূরে রাখতে পারেননি। বরং তার প্রবন্ধ রচনায় তিনি পরিবেশবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। যা একজন সচেতন কবির বহিঃপ্রকাশ। তিনি যেমন ছিলেন সমাজ সচেতন। তেমনি ছিলেন পরিবেশ সচেতন। তার প্রতি থাকলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।