ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

রোজা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং মুসলমানদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। এটি আত্মশুদ্ধি, সংযম ও ধৈর্যের প্রতীক। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই রমজান মাসে রোজা পালনের বিধান ছিল, তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রোজার ধরন, পরিবেশ ও সামাজিক পরিস্থিতির নানা দিকেও পরিবর্তন এসেছে। তাই

সেকালের রোজা: ধর্মীয় নিষ্ঠা ও সরলতা

ইসলামের প্রথম যুগে রোজার নিয়ম-কানুন অনেকটাই সরল ও আত্মনিয়োগমূলক ছিল। নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময় মুসলমানরা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও রোজা রাখতেন। তখনকার সমাজে প্রযুক্তির সুবিধা ছিল না, তাই সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি নির্ধারণ করা হতো চাঁদ, সূর্য ও প্রাকৃতিক লক্ষণ দেখে। সাহরি ও ইফতার হতো সাধারণ খাদ্যে, যেমন খেজুর, পানি, দুধ এবং সামান্য রুটি বা খাবার।

প্রথম যুগের মুসলমানরা রোজাকে কেবল একটি ইবাদত হিসেবেই নয়, বরং আত্মসংযম, ধৈর্য ও দানের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতেন। দরিদ্রদের সাহায্য করা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া এবং বেশি বেশি ইবাদত করার প্রবণতা ছিল প্রবল। মসজিদে গিয়ে ইবাদত করা, কোরআন তিলাওয়াত করা এবং লাইলাতুল কদরের সন্ধানে রাত জাগা ছিল তখনকার রোজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

গ্রামবাংলার প্রাচীন যুগেও রোজার পরিবেশ ছিল অন্যরকম। গ্রামের মানুষ সাধারণত কৃষিকাজ করত, ফলে রোজা রাখার পাশাপাশি তারা শারীরিক পরিশ্রমও করত। ইফতারিতে থাকত খেজুর, মুড়ি, চিড়া, দুধ, কলা ও পান্তা ভাত। সাহরি ও ইফতারে তেমন বাহুল্য ছিল না। সেকালে রোজার সময় ছিল পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও একে অপরের প্রতি সহানুভূতির অনন্য উদাহরণ।

একাল: আধুনিকতা ও নতুন চ্যালেঞ্জ

বর্তমান সময়ে রোজার ধরন ও পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এখন রোজার সময়সূচি মোবাইল অ্যাপ ও ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ইফতারের মেনুতে এসেছে বিশাল পরিবর্তন-বিভিন্ন প্রকার ফল, শরবত, ভাজাপোড়া খাবার, বিরিয়ানি, কাবাবসহ নানা সুস্বাদু পদ এখন ইফতারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরাঞ্চলে ইফতারে বাহুল্য এবং অপচয়ের প্রবণতা বেড়েছে, যা ইসলামের সংযমের মূল শিক্ষার পরিপন্থী।

একালেও মানুষ রোজা রাখে, তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। কর্মজীবী মানুষকে দীর্ঘ সময় অফিস করতে হয়, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ থাকে, এবং গরমের কারণে অনেকের জন্য রোজা রাখা কঠিন হয়ে যায়। তবুও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে মানুষ রোজা রাখার চেষ্টা করে।

বর্তমানে মসজিদে তারাবির নামাজে লোকসমাগম বাড়লেও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় আলোচনা অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হয়ে পড়ছে। আগে যেখানে মানুষ সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিত, এখন তা অনেকাংশেই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছে। রমজান মাসে দান-খয়রাত ও সাদকার প্রবণতাও বেড়েছে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে ফান্ডরেইজিং ক্যাম্পেইনগুলোর মাধ্যমে অনেকে অসহায়দের সাহায্য করছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে দানের চেয়ে লোক দেখানো প্রবণতাও দেখা যায়, যা সেকালের নিঃস্বার্থ দানের মানসিকতার সঙ্গে বৈপরিত্য সৃষ্টি করেছে।

সেকাল-একালের তুলনা ও শিক্ষা

সেকালের রোজা ছিল সরলতা, সংযম ও পারস্পরিক সহানুভূতির প্রতীক। একান্নবর্তী পরিবার ও প্রতিবেশীদের মধ্যে একসঙ্গে ইফতার করার প্রচলন ছিল বেশি। বর্তমানে প্রযুক্তির সুবিধার কারণে জীবনযাত্রা সহজ হলেও সামাজিক সংযোগ অনেকাংশে কমে গেছে।

একাল ও সেকালের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো খাদ্যাভ্যাস। আগে রোজার সময় সাধারণ ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া হতো, এখন ভাজাপোড়া ও ভারী খাবারের আধিক্য বেড়েছে, যা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রোজার মূল শিক্ষা হলো আত্মসংযম, ধৈর্য ও দানশীলতা। একাল ও সেকালের পার্থক্য যাই হোক না কেন, এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অতীতের সরলতা ও ধর্মীয় নিষ্ঠা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি এবং বর্তমানের সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে রোজার ইবাদত পালন করতে পারি।

পরিশেষে বলতে চাই, রোজার সেকাল ও একাল দুই সময়েই মূল উদ্দেশ্য এক-আত্মশুদ্ধি, সংযম ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। সময়ের পরিবর্তনে রোজার ধরনে কিছু পার্থক্য এলেও এর মৌলিক শিক্ষা একই রয়ে গেছে। তাই আমাদের উচিত অতীতের শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানের প্রযুক্তিগত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোজাকে আরও অর্থবহ করে তোলা। রোজার প্রকৃত শিক্ষা যদি আমরা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, তবে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য আরও বৃদ্ধি পাবে।