পথিক মোস্তফা

০২.

কবি লিখে যান নিজের ভাষার বন্ধনীর ভেতর। কবির মনন যেখানে যেমন সায় দেয় কবিতার ভাষা-সওগাতও তেমনি পসরা মেলে। আমরা বাইরে থেকে কবিতার আঙ্গিক বিচার করতে পারি। আমরা পারি কবির জীবনের কর্মযজ্ঞ আর বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা বয়ানকে বিশ্লেষণ করে তাঁর আত্মার আরো কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু মনের বন্দরে নোঙর করে বসতিস্থাপন কোনো পাঠক-সমালোচকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর কবি নয়ন আহমেদের মতো মেধাবী কবিদের কবিতার হেরেমে পৌঁছানোতো আরো বেশি দুঃসাধ্য। তাই কবিকে আমরা বিশ্লেষণ করি বিশ্বাস দিয়ে, তাঁর সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা দিয়ে। কবি নয়ন আহমেদ এতো বেশি আলঙ্কারিক যাদু দিয়ে কবিতার দেহ সাজান সেখানে পৌঁছুতেও সাধনা প্রয়োজন। যেমন কবি যখন বলেন-

কোন বাড়িটির কাছে যাবো!

ইতিহাস পাড়ায় বাঘ আসছেহালুম, হালুম!

জ্ঞান-বিজ্ঞানময় আর শক্তি-সাহসের জ¦লন্ত অগ্নিবারুদ যে মুসলমানগণ গোটাজাহান শার্দুলের ন্যায় তেজস্বীতায় শাসন করেছে সে আজ রাখাল ছেলের মিথ্যে বাঘের কথা শুনেও ভয়ে লুকায়; কবির আক্ষেপ এমন। কবির আশা এমন যে, ইসলামের গৌরব আর সৌন্দর্যের সুনাম দশদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, পৃথিবীর তাবৎ মানুষ একে স্বাগত জানাবে; আর এ কাজটি করবে না মুসলমানগণই। যেমনটি করেছিলেন, প্রিয়নবী সা. ও তাঁর সাহাবাগণ (রা.)। ইসলাম সুন্দরের ধর্ম, মানুষের মমত্ব আর ভালোবাসার ধর্ম, আর নবীজী সা. প্রতিটি মানুষ শুধু নয়, প্রতিটি প্রাণিকূলের জন্যই ভালোবাসা নিয়ে ধরায় এসেছেন। বনের প্রাণী আর আকাশের পক্ষীকূল সেই নবীর প্রেমের ডোরে বন্দি হলো, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের মুসলমানগণ সেই ইতিহাস ধরে রাখতে পারলেন না। কিংবা নাস্তিক, মুরতাদ, বিজাতীয়দের কারণে ইসলামের ইতিহাস আজকে ম্লান হচ্ছে, দিকে দিকে নির্যাতিত হচ্ছে।

সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের সাথে প্রতারণা নিশ্চয়ই ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত অপরাধ। রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দিবে সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়।’ যে ব্যক্তি সম্পর্কে প্রিয় নবী সা. বলেন, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, সে তো সমাজের বুকে সবথেকে বড় অপরাধী। এ অপরাধীরা সমাজে যে কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে। কবি নয়ন আহমেদও সেই সব সমাজের কীটদের ঘৃণা করেন, তাদের সামাজিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি আবারো সুন্দর কুরআনিক ভাষায় রচনা করেন কবিতার সৌষ্ঠব-

ধানের বীজ ছিটানোর মতো- প্রতারণাকারীগণ উপস্থিত থাকুক।

জাল ফেলে যারা রৌদ্র ধরেছে- ডাকো তাদের।

অবৈতনিক সংযোগ- তার জালের নাম

ধূর্ততাÑ তার চোখের নাম;

আর ডানায় যার অযুহাতের পতাকা- সেও হাজির থাকুক।

এই শহরের সম্মানিত কবি আজ বিচারক।

ওহে মাছির পোশাক পরা মেজবানরা,

একটি ক্ষুধার্ত কবর আহার হিসেবে

চাচ্ছে তোমাদের।

আমি, কবরের প্রার্থনা মঞ্জুর করি।

সমাজের নীচু মানসিকতার শঠ আর প্রতারকে ভরে গেছে আজ সমাজ। ইসলামের সুন্দর শাশ্বত বিধান থেকে সরে গিয়েই আজ মানুষের এ অধঃপতন। কবি এ সকল মানুষ যে একদিন কবরের ন্যায় নিস্তব্ধতায় নিজেরাই বন্দি হয়ে যাবে, তাই তিনি বলেন তাঁর সুন্দর কবিতায়। তিনি এ কবিতায় সকল অবিশ্বাসী আর মুনাফিকদের সম্বন্ধে বলেন- ‘ওহে, মাছির পোশাক পরা মেজবানরা’। ‘মাছির’ মতো বিষ বহনকারী- যা এক থেকে অন্যে ছড়িয়ে দেয়; তেমন মুনাফিকদের সম্পর্কে কবি এ রূপকটি ব্যবহার করেন। এ কবিতায় কবির রূপকল্প ও উপমাগুলো অসাধারণ মূল্যবোধের এবং কাব্যিক ব্যঞ্জনা পূর্ণ। যেমন তিনি বলেন- ‘ধানের বীজ ছিটানো মতো- প্রতারণাকারীগণ উপস্থিত থাকুক।’ ধানের বীজ ছিটাতে গিয়ে প্রতারণা করলে যেমন বীজ উদ্গত না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না, কিংবা কখনোই তাকে পাকড়াও করা যায় না, ইসলামের মধ্যে সুন্দর সমাজের মধ্যে এমন বিনষ্টকারী প্রতারক মুনাফিকের বসবাস রয়েছে। এমনি করেই চলে এ মেধাবী কবির নৈতিক মূল্যবোধপূর্ণ সৌন্দর্যের বয়ান। (চলবে)