ড. এম এ সবুর
বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ শতকের পরাধীন বাংলায় তার আবির্ভাব (১৮৯৯-১৯৭৬খ্রি.)। তখন বৃটিশ বেনিয়াদের হাতে ছিল ভারতের শাসন শোষণ দন্ড। আর বাংলা তথা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা ছিল ঘন তমসাচ্ছন্ন। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে নজরুল ইসলাম ‘ধুমকেতু’র বেগে আবির্ভূত হলেন। তাঁর এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাশের বাঁশরী’ অন্য হাতে ‘রণতুর্য’। তাঁর বাঁশির সুরে ও রণতুর্যে ঘুমন্ত জাতির চেতনার উদয় হয় এবং জাতীয় জীবনে নবজাগরণ ঘটে। এতে পরাধীন জাতির স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম হয়ে ওঠে। তাঁর গান-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে বৃটিশ শাসন-শোষণের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। পরাধীন ভারতীয়দের নবজাগরণে বিশেষত বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন ও অর্জনে নজরুল ইসলামের কবিতা-গান-প্রবন্ধ শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে।
পলাশীর ষড়যন্ত্র বাঙালি তথা ভারতীয়দের জন্য এক মর্মান্তিক বিষাদময় ঘটনা। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর থেকেই ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশে এবং সমগ্র ভারতে বৃটিশ বেনিয়াদের নিয়ন্ত্রণ ও শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। এতে বাঙালি ও মুসলমানদের উপর শাসক শ্রেণীর নির্যাতন-নিপীড়ন বেড়ে যায়। বাঙালি জাতির হৃত গৌরব পুুনঃউদ্ধারের লক্ষ্যে পলাশী প্রান্তরের এ বেদনাদায়ক ইতিহাস স্মরণ করে নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
মনে পড়ে আজ পলাশীর প্রান্তর,
আসুরিক লোভে কামানের গোলা বারুদ লইয়া যথা,
আগুন জ্বালিল স্বাধীন এ বাংলায়। (নবাগত উৎপাত)
বৃটিশ শাসনের আগে ভারতের শাসনভার ছিল মুসলমানদের হাতে। সুলতান, পাঠান, মোঘল ইত্যাদি নামে দীর্ঘ কয়েক শত বছর মুসলিম নৃপতিরা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে। এরও আগে আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সময় শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্যোর্তিবিদ্যা, গবেষণাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানরা বিশ্বনেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নজরুলযুগে মুসলিমরা বিশেষ করে ভারতীয় মুসলিমরা ছিল পরাধীন, নির্যাতিত-নিপীড়িত। এমতাবস্থায় কাজী নজরুল ইসলাম স্বধর্ম ও স্বজাতির উত্থান কামনা করেছেন। বঞ্চিত-অধঃপতিত বিশেষত ভারতীয় মুসলিমদের হৃত গৌরব পুনঃউদ্ধারের জন্য তিনি মুসলিম সমাজকে জেগে ওঠার আহবান জানিয়ে লিখলেন,
জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরী হাঁক
শহীদের দিলে, সব লালে লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন!
কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় জাগরণের কবি। পরাধীন জাতিকে জাগ্রত করার লক্ষ্যেই সাহিত্য সাধনা করেছেন তিনি। অত্যাচারিত-বঞ্চিতদের আর্তনাদ-আহাজারি তাঁর কবিতা হয়েছে। নির্যাতিত-নিপীড়িত, অসহায়-বঞ্চিতদের করুণ বেদনা তাঁর বাঁশির সুর হয়েছে। আর অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁর গান হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
তুফান আমার জন্মের সাথী আমি বিদ্রোহী হাওয়া
জেহাদ জেহাদ বিপ্লব বিদ্রোহ মোর গান গাওয়া।
ইসলাম দাসত্ব প্রথা সমর্থন করে না এবং এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত করার অনুমতি দেয় না। অধিকন্তু দাসত্ব-পরাধীনতা দূর করতে ইসলামের রয়েছে সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা। কিন্তু নজরুলযুগে ভারতীয়দের বৃটিশরা পরাধীনতা-দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছিল। এতে নজরুল ইসলাম ব্যথিত হয়ে বিভ্রান্ত-ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগ্রত করতে ইসলামের মর্মবাণী স্মরণ করে দিয়ে লিখেছেন এভাবে,
অন্যরে দাস করিতে কিংবা নিজে দাস হ’তে ওরে
আসেনি ক’ দুনিয়ায় মুসলিম, ভুলিলি কেমন করে?
ভাঙ্গিতে সকল কারাগার, সব বন্ধন, ভয়, লাজ
এল যে কোরান, এল যে রে নবী ভুলিলি সে সব আজ? (আজাদ ঃ নতুন চাঁদ)
নজরুল ইসলাম পরাধীন ভারতীয়দের স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করতে ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিদের স্মরণে অনেক কবিতা রচনা করেছেন। বিভিন্ন দেশের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ভারতীয়দের মনে শক্তি-সাহস সঞ্চার করেছেন। যেমন তুর্কী বীর কামাল পাশার বীরত্ব ও বিজয়াভিযানকে স্বাগত জানিয়ে তিনি লিখেছেন,
ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই
অ-সুর পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই। (অগ্নীবীণা)
অধিকন্তু স্বজাতি রক্ষায় ও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিভিন্ন দেশে যারা নিহত বা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতীয়দেরকেও অনুরূপভাবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে আত্মোৎসর্গে উৎসাহ দিয়ে লিখেছেন,
মৃত্যু এরা জয় করেছে কান্না কিসের?
আব্-জম-জম আনলে এরা, আপনি পিয়ে কলসী বিষের!
কে মরেছে? কান্না কিসের?
বেশ করেছে!
দেশ বাঁচাতে আপনারি জান শেষ করেছে,
বেশ করেছে। (অগ্নীবীণা)
বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা গান ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বাংলার জাতীয় জাগরণে-উত্থানে তিনি অধিকার বঞ্চিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। কৃষক-শ্রমিক ও মজদুর শ্রেণীর লোকজনকে অধিকার সচেতন ও জাগরণ করতে তিনি লিখেছেন,
ওঠো, জগতের ভূখানাঙাদের জাগিয়ে দাও,
ধনীর যক্ষপুরীর প্রাচীর কাঁপিয়ে দাও,
খেতের শস্যে যে কৃষকের কোন হিস্যা নেই
সে খেতের প্রতি শস্য দানায় আগুন দাও।
অনুরূপভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের সজাগ হবার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন,
রাজার প্রাসাদ উঠেছে প্রজার জমাট রক্ত ইটে,
ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে। (সর্বহারা ঃ চোর-ডাকাত)
সমকালীন মুসলিম বিশ্বের নবজাগরণ, চিত্ত-উত্থান ও সংগ্রাম-সাধনা নজরুল ইসলামের মনে-প্রাণে জাগরিত ছিল। পরাধীনতা, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিকে জাগ্রত করাই ছিল তার সাহিত্য সাধনার মূল উদ্দেশ্য। স্বদেশের সকল মানুষের জাগরণই ছিল তার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য সাধনে তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে এক পতাকার তলে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলার মুসলিম জাগরণের উদ্দেশ্যে নিজের বিশ্বাস থেকে তিনি ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্যমূলক ও জাগরণধর্মী সাহিত্য রচনা করেছেন। অন্যদিকে বাঙালি হিন্দু সমাজের জাগরণের উদ্দেশ্যে তিনি শ্যামা সঙ্গীত ও কালীকীর্তন রচনা করেছেন। কালীকীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীতের রূপক ও প্রতীকের সহায়তায় তিনি শক্তি, সত্য ও সুন্দরের বন্দনা গেয়েছেন। এজন্যই তিনি লিখেছেন,
রণ-বঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশহাতে বাজে দশ প্রহরণ।
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে
শাশ্বত, নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর! (আগমনী ঃ অগ্নিবীণা)
কবি নজরুল ছিলেন ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা ও আশাবাদী কবি। তিনি কখনও হতাশায় ভোগেননি বরং তিনি ছিলেন উন্নতর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ী। এজন্য তিনি বিশ্বের জাগ্রত জাতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বজাতিকে জাগ্রত করতে লিখেছেন এভাবে,
যাক্ রে তখ্ত তাউস, জাগ রে জাগ্ বেহুশ,
ডুবিল রে দেখ্ কত পারস্য, কত রোম গ্রীক রুষ;
জাগিল তারা সকল, জেগে ওঠ্ হীনবল,
আমরা গরিব নতুন করিয়া ধুলায় তাজমহল। (চল্ চল্ চল্ ঃ সন্ধ্যা)
কবি নজরুল ইসলাম নির্যাতিত-নিপীড়িত ও পরাধীন জাতির হয়ে কবিতা ও গানে, ধারণা-ধ্যানে, কথা-কাজে ব্যাপক অনল উদগীরণ করেছেন। অনুরূপভাবে প্রাচীন চিন্তাধারা-কুসংস্কারের এবং বিদেশী শাসন-শোষণের বিরেুদ্ধে দুর্দান্ত বিদ্রোহ করেছেন। তার বিশ্বাস ‘যারা তেত্রিশ কোটি মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে’ খায় তাদের বিরুদ্ধে কবির ‘রক্ত লেখায়’ অচিরে ধ্বংস নেমে আসবে। আর সেদিন তারা দেখতে পাবে,
মহামানবের মহাবেদনার আজি মহা উত্থান;
ঊর্ধেŸ হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান।
পরাধীন জাতিকে মুক্ত করতে কাজী নজরুল এ দেশের হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতিকে জাগরণের চেষ্টা করেছেন। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে জাতিকে ম্ক্তু করতে তিনি শোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এজন্য কারাদন্ডসহ শাসকের বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতন তাকে সহ্য করতে হয়েছে। তবু শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে তার ‘রক্ত লেখা’ অবিরাম চলেছে।
অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের কোন খড়গ দিয়ে তার ‘বিদ্রোহ’ থামানো যাবে না বলে তিনি হুশিয়ার করেছেন। তবে জালিমের জুুলুম-উৎপীড়ন অবসান হলে তার ‘বিদ্রোহ’ শান্ত হবে মর্মে উল্লেখ করেছেন এভাবে,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত। (বিদ্রোহী)
স্বাধীনতার চারণ কবি ও হিন্দু-মুসলিম জাগরণের বাণীবাদক নজরুল ইসলাম বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতার তূর্যবাদক হলেও বাংলার জাগরণ বিশেষত পূর্ববঙ্গের জাতীয় জাগরণ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন তার চোখে স্পন্দিত হয়েছিল। তাই বৃটিশ ভারতের যুগেও স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন এবং এ দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা থেকেই বিদ্রোহী কবি গেয়েছিলেন,
স্বাগত বঙ্গে মুক্তিকাম,
সুপ্তবঙ্গে জাগুক আবার
লুপ্ত স্বাধীন সংগ্রাম।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাসাহিত্যে জাতীয় জাগরণের এক অনন্য নাম কাজী নজরুল ইসলাম। শোষণমুক্ত শাসন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালি জাতির জাগরণ ও স্বাধীনতা অর্জন ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য।