গাজী গিয়াস উদ্দিন

বাংলা সাহিত্যে শরৎ বন্দনায় ঋতুরাণী শরৎকে নিয়ে রচিত কবিতা ও গদ্যসাহিত্য সম্ভারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শরতের স্নিগ্ধতা, প্রকৃতি, কাশফুল, শিউলি ফুল এবং শারদীয় উৎসবের বর্ণনা এসব কবিতা ও গদ্যে স্থান পায়। এবার কবিকন্ঠে শরৎ বৈচিত্র্য কিভাবে চিত্রিত হলো, দেখা যাক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক কবি শরৎকে নিয়ে তাদের লেখায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :

“আজিকে তোমার মধুর মুরতী/ হেরিণু শরৎ প্রভাতে/ হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ঝরিছে অনল শোভাতে”।

নজরুল কাব্যগীতিতে গেয়ে উঠলেন :

“এসো শারদ প্রাতের পথিক/এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে/এসো অরুণ-কিরণ-রথে।

নজরুল এ গীতিকবিতায় যেনো কোনো এক পর্যটককে শরতের সৌন্দর্য-বৈচিত্র্যকে উপভোগের জন্য- আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এই আগমনী গানে। বিচিত্র পথে না এলে শারদ প্রভাত যেন অদেখা রয়ে যায়। এই আগমনী গানের পথিক কবির মনোলোকের শরত। তার চলার পথ হলো- শরতের প্রবহমান রূপবৈচিত্রের ধারা।

এসময়ের এক কবি আধুনিক প্রকরণে প্রকাশ করেন:

“হালকা হাওয়ায় দলছুট মেঘেদের হাতছানি / কাশফুল খোঁপা পরা নদী যেন প্রকৃতির রাণী”।

ঝকঝকে নীল আকাশ, পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ এবং শুভ্র কাশফুলের বর্ণনা। শান্ত নদীর প্রান্ত, শিশির ভেজা ঘাস এবং স্নিগ্ধ প্রকৃতি। শিউলি ফুল ও ধানের ক্ষেতের বর্ণনা। শারদীয় উৎসব, ঢাকের তাল এবং খুশির আমেজের কথা। বিরহের পর মিলনের আনন্দ এবং প্রকৃতির স্নিগ্ধতা। মূলত, শরৎ বন্দনা মানেই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ শরৎ ঋতুকে নিয়ে কবিকন্ঠে শরৎ বৈচিত্র্য বয়ান।

পৃথিবীর চারটি নাতিশীতোষ্ণ ঋতুর মধ্যে শরৎ ঋতু একটি। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকাল গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে আগমন করে। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় এই ঋতুর সময়কাল ভাদ্র ও আশ্বিন মাস। মূলত শরৎ হলো বর্ষার পরবর্তী ঋতু। বর্ষার অতিবর্ষণ থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে নেমে আসে শান্ত সুনিবিড় মনোহারী পরিবেশ। যে কারণে শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ ও উদার। ক্ষণিকের জন্য মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। নদী তার যৌবনের উন্মাদনা শেষে শান্ত হতে থাকে। আকাশ-বাতাসে কিংবা দুর্বাঘাসে শরৎ তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। শাপলা-শালুক, পদ্ম-জুঁই, কেয়া আর কাশফুলের সৌরভে শরৎরাণী তার বীণার তারে সুর বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।

এ সময় কাশের বুকে কোমল কাব্যের মতো ভেসে চলে সাদা-শুভ্র পেঁজা পেঁজা নরম মেঘমালা। সূর্যের কিরণ হয় দীপ্তোজ্জ্বল আর বাতাস হয় অমলিন। শরতের মতো নীল আকাশ আর কোনো ঋতুতেই দেখা যায় না। শোভা ছড়ানো পুষ্পবন আর শস্যের শ্যামলতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শরৎ। শরতের অপরূপ রূপ দেখে বাংলার কবি-সাহিত্যিক ছন্দে ছন্দে মেতে উঠেন।

বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল ময়না-টিয়ার মধুর গুঞ্জন ধ্বনিতেই কেবল মুখরিত হয় না, বরং কবিদের কাব্যের দুয়ার খুলেও বের হয়ে আসে অনাবিল আনন্দের পরশ। শরৎ রাতের রূপালি চাঁদের আলোয় যখন প্রকৃতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন কবি-সাহিত্যিকদের মনোজগৎও আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত না হয়ে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা ও গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তার সুরের ধারায় ব্যক্ত করেছেন- ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল, ছড়িয়ে গেল/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন আঙ্গুলি। শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি। শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে, আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি/শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশির ভাগ রচনায় রয়েছে প্রকৃতির জয়গান। তিনি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশের শিমুল তুলার মতো শুভ্র মেঘেদের দলবেঁধে ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’ তবে শরৎকে কবি রবীন্দ্রনাথ বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তাই তিনি বলেছেন- আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/এসো গো শারদলক্ষ্ণী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/এসো নির্মল নীলপথে।’

শরৎ বন্দনায় সরব হয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন। তার ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’ সহ অনেক গানই শরৎ প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এসব রচনায়, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক/এসো শিউলি বিছানো পথে।/এসো পদতল/নীল লাবনি ঝরায়ে ঢলঢল/ এসো অরণ্য পর্বতে।’

বাংলা সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ/নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কবি ঋতুসংহার কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে লিখেছেন,- কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের নিক্বন, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহবল্লরী, অপরূপ যার আকৃতি, সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’ কবি কল্পনায় শরতের সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় নেই।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের চোখে শরতের রূপ-রঙ তার ধরা পড়েছে : তার এখানে নীল আকাশ কবিতা থেকে ‘এখানে আকাশ নীল নীলাভ/আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার/আশ্বিনের আলোর মতো। আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এখানে করে গুঞ্জরণ/রৌদ্রের দুপুর ভরে বারবার/রোদ তার সুচিক্কণ চুন/কাঁঠাল জামের বুকে নিংড়ায়/দহে বিলে চঞ্চল অঙ্গুল।’

কবি জসীম উদ্দীন এ ঋতুতে প্রিয় কাছে না থাকায় প্রেয়সীর যে বিরহরূপ তা তিনি কাছ থেকে অবলোকন করেছেন : ‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল/আসিল ভাদ্র মাস/বিরহী নারীর নয়নের জল/ভিজিল বুকের বাস।’ কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন- শরতের দ্বিপ্রহরে, সুধীর সমীর পরে/জল ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়/ ভাবি, একদৃষ্টে চেয়ে-যদি ঊর্ধ্ব পথ বেয়ে/ শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্রভেদি ধায়।’

কবি আহসান হাবীবের ভাষায় , ‘এবার শরৎ রাত্রি স্বপন নয় এসেছে সঙ্গিন/লুণ্ঠিত স্বর্গের শীর্ষে সে স্বপন রঙ্গিন/কেঁদে মরে মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীড়ে।’

কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শরৎ এসেছে জ্যোতি ছড়িয়ে। তার কবিতা ‘জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের শিশির জ্যোতিকণা।’ শরতে প্রিয়ার রূপ-বন্দনায় ব্রতী হয়েছেন কবি নিমের্লন্দু গুণ। তার ছান্দিক অনুভব :সবে তো এই বর্ষা গেল/শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্রকাশে/ভরলো তোমার গাত্র।/শেষের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের এ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/বাঁশবনের ওই ধারটায়।’

অপরূপ বৈচিত্র্যে শরৎ বন্দনা গানে, গল্পে, উপন্যাস ও প্রবন্ধে মুখরিত বাংলা সাহিত্যে।

বিদেশি কবিরা শরৎকালকে প্রকৃতির পরিবর্তনশীল, মনোমুগ্ধকর এবং কখনো বিষণ্ণ এক ঋতু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জন কিটস এই ঋতুর দৃশ্যপটকে কবিতায় তুলে ধরেছেন, যেখানে শরতকে প্রকৃতির পরিবর্তন ও নতুন জীবনপ্রবাহের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

অন্যদিকে, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার শরৎকে জীবনের ক্ষয় এবং মৃত্যুর পর শোকের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। রোমান্টিক কবি জন কিটস তাঁর বিখ্যাত কবিতা “টু অটাম” (ঞড় অঁঃঁসহ)-এ শরৎকালের এক মনোমুগ্ধকর এবং বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এই ঋতুতে প্রকৃতি তার পূর্ণতা ও সৌন্দর্য ধারণ করে।

শেক্সপিয়ারের উক্তি অনুসারে, শরৎকাল যেন কোনো মৃত রাজার বিধবা স্ত্রীর মতো, যা তার প্রভুর মৃত্যুর পর অসহ্য বোঝা বহন করে। এটি জীবনের ক্ষয় এবং পরিবর্তনের এক বিষাদময় রূপ তুলে ধরে। সাওভান ভিভিয়ান শরৎকালের রঙকে প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “শরতের রঙগুলি মজার। এগুলি এত উজ্জ্বল, তীব্র এবং সুন্দর। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আপনাকে রঙে ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, আপনাকে পরিপূর্ণ করার জন্য যাতে শীত সবকিছু নিস্তব্ধ এবং বিষণ্ণ করে তোলার আগে আপনি এটি মজুদ করতে পারেন”।

রুশ ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয় শরৎকালকে এক ধরনের Writers Block বা লেখার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে বলে মনে করতেন। তিনি শরৎকে অভ্যন্তরীণ আলো খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখতেন, যা তাঁর সৃজনশীলতাকে ব্যাহত করত। অন্যান্যদের বিপরীতে, আলেকজান্ডার পুশকিন শরৎকালকে “বোল্ডিনো অটাম” বা উদ্যমী শরৎ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা সৃজনশীলতার এক নতুন স্পৃহা জাগিয়ে তোলে।

সবশেষে কবি আল মাহমুদ এর “একটি শরৎ সন্ধ্যা” ( শ্রেষ্ঠ কবিতা - এপ্রিল ২০১৯ সংস্করণ, প্রতিভাস প্রকাশনী, কলকাতা।) কবিতা দিয়ে উপসংহার টানছি :

“ঋতুর অতীত আমি । কে জিজ্ঞাসে এটা কোন্ মাস?/ বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষন্ন নির্যাস। শ্রবণেরও/ শক্তি নেই। কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে প্রতিটা বাড়ির / রন্ধ্রে, ইটে ইটে, আনাচে কানাচে। এটা কি শরৎ সন্ধ্যা? / বাংলাদেশ? কাশফুলে ছেয়ে গেছে চর? উদাম আকাশে / তবে কি এখনও কি মাথার ওপর? এমন নির্গন্ধ বায়ু / কোনকালে ছিল কি এদেশে? / আমার পঙক্তি শুনে, কারা/ হাসে? প্রেতের আদেশে মনে হয় মরে গেছে শরতের / সন্ধ্যার শহর। আর কোন স্মৃতি নেই, ভীতি নেই, নীতি নেই / কাঁপে থরথর । অস্তিত্বের কাঠামোখানি, হাড়গোড় রক্তের / নহর। এভাবেই কাব্য হয় তর্কে তর্কে কেঁপে ওঠে কবির অধর।