মোহাম্মদ অংকন

বাংলা কবিতার জগতে নতুন কণ্ঠস্বরের আবির্ভাব সবসময়ই কৌতূহল তৈরি করে। আমাদের সুপরিচিত কবি নুশরাত রুমুর কাব্যগ্রন্থ ‘অন্য সৈকতে’ সেই অর্থে এক অভিনব সংযোজন। তিনি যেন নতুন প্রজন্মের এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। এই বইটি নিছক কিছু ছন্দমালা বা আবেগপ্রবণ শব্দের সমষ্টি নিয়ে লেখা নয়; বরং এটি এক অন্বেষণমানুষের ভেতরের অচেনা যাত্রা, নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা, হারানো ও ফিরে পাওয়ার নান্দনিক ভুবনে প্রবেশের দরজা।

‘অন্য সৈকতে’ কবি যাপিত সময়, জীবন, প্রকৃতি ও সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কবিতা বুনেছেন শৈল্পিক ছোঁয়ায়। ‘শান্তির বাতাবরণ’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন

‘অতলান্ত সমুদ্র থেকে অজেয় মনোবল নিয়ে

যার বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল হবে অন্ধকার জগৎ।

স্বপ্নীল দেবলোকের স্বর্গীয় বাতাসে

অফুরন্ত প্রাণরস পাবে, আজন্ম ছন্নছাড়া জীবন।’

এই কবিতায় কবি প্রকৃতিকে শুধু দৃশ্যমান রূপে নয়, মানুষের মানসিক অবস্থার প্রতীকে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির ভেতরে যেমন রং, আলো ও নীরবতা আছে, মানুষের ভেতরেও তেমনই আছে স্মৃতি, শূন্যতা আর আশ্রয় খোঁজার তাগিদ।

কবি নুশরাত রুমুর লেখা প্রতিটি কবিতার সুর আলাদা হলেও এর অন্তর্গত আবহ মূলত মানবিক বোধে ভরপুর। বইটি বহুমাত্রিক পাঠ-অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। পাঠক একদিকে ব্যক্তিগত অনুভূতির ভেতর ডুবে যাবেন, অন্যদিকে সমষ্টিগত জীবনের প্রতিফলনও খুঁজে পাবেন। কখনও প্রেমের কোমল টান, কখনও জীবনের অস্থিরতা, আবার কখনও সমাজ-সংকট তুলে ধরেছেন কবিতায়। ‘বলাকা’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন

‘লাল সুরুযে রাঙিয়ে নেব হৃদয়ের দু-পাশ,

বলাকা রূপে হারিয়ে যাব হোক না সর্বনাশ।’

এ কবিতায় প্রেমকে দেখা যায় দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে। ‘বলাকা’ প্রেমের পথকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করছে যেখানে গন্তব্য কখনও স্পষ্ট হয় না। এই অস্পষ্টতাই প্রেমের সৌন্দর্য ও বেদনা দুটোকে একসঙ্গে ধারণ করেছে।

নুশরাত রুমুর কবিতায় ভাষা কখনও মোলায়েম, কখনও ঝড়ের মতো অস্থির। চিত্রকল্পে আছে প্রকৃতির রূপককাশফুল, নদী, সন্ধ্যার আলো কিংবা বৃষ্টির শব্দ। আবার আছে নগর-জীবনের ক্লান্তি ও একাকিত্ব। ভাষা সহজ, কিন্তু তার মধ্যে গভীর আবেগ ও দার্শনিক আভাস মিশে আছে। ‘নীলাম্বরের দেশে’ শিরোনামের কবিতায় পাওয়া যায়

‘চলো যাই নীলাম্বরের দেশে,

ভাবনার রঙিন পেখম মেলে।

তোমার আমার যৌথ আবেদনে,

চিরবসন্তের স্মৃতি পথ বেয়ে, বনফুলের সাজে।’

এখানে কবি নিঃসঙ্গতার গভীরতাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি শব্দ যেন নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। পাঠক নিজের ভেতরকার নিঃসঙ্গতার সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন, সহজেই শব্দগুলিকে অনুভবে পরিণত করতে পারেন।

‘অন্য সৈকতে’র কবিতাগুলো বেশিরভাগই মুক্তছন্দে রচিত, যা আধুনিক বাংলা কবিতার স্বাভাবিক ধারা। তবে কবি কোথাও কোথাও ছন্দ ও অন্ত্যমিল ব্যবহার করেছেন, যেন কবিতার সুরে বৈচিত্র্য তৈরি হয়। কবিতার শৈলীতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামাজিক চেতনার সংযোগ রয়েছে। চিত্রকল্পে প্রকৃতি, শহর ও সময়ের ভাঙা আয়না ব্যবহার করেছেন। এতে বইটি একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি; বরং প্রতিটি কবিতা পাঠকের মনে আলাদা ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

এই বইয়ের বড় শক্তি হলো এর আবেগঘন সুর। কবি পাঠককে থামতে বাধ্য করেছেন, চারপাশের বাস্তবতা ও অন্তর্জগৎকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন। পাঠক হয়তো নিজের জীবনের কোনো মুহূর্তকে খুঁজে পাবেন এই বইয়ের কবিতায়। বিশেষ করে যারা ভেতরকার নিঃসঙ্গতা ও সময়ের প্রবাহকে অনুভব করেন, তাদের কাছে বইটি হয়ে উঠবে সঙ্গী। তিনি শুধু আবেগ প্রকাশ করেননি, বরং প্রশ্নও করেছেন। প্রেম, নিঃসঙ্গতা, সমাজ ও সময়সবকিছুর ছাপ এই বইয়ের কবিতায় আছে। তারই উদাহরণ ‘অন্য সৈকতে’ কবিতার চরণগুলো

‘আজকাল অন্য সৈকতে ঘুরে বেড়াও,

সাগরের ঘ্রাণ পেয়েছ বলে!

এখন নন্দিনী তোমার প্রিয়তমা...

আমি তোমায় দিয়েছিলাম টুকরো বিকেলের

এক চিলতে আকাশ আর ছোট্ট নদীর পাড়

এখন আর তাতে তোমার মন ভরে না।’

‘অন্য সৈকতে’ কেবল কাব্যগ্রন্থ হিসেবেই নয়, বরং এক সম্ভাবনাময় কবিকণ্ঠস্বরের পরিচায়ক। এখানে আছে ভিন্ন চোখে পৃথিবী দেখা, ভিন্ন আবেগে সম্পর্ককে অনুভব করা, আর ভিন্ন ঢঙে পাঠককে ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। বইটি প্রমাণ করে নুশরাত রুমু শুধু আবেগ প্রকাশ করেননি, বরং জীবনের গভীর প্রশ্নগুলোও উসকে দিয়েছেন। সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য বইটি হবে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতা; কবিতা পাঠ করতে যারা ভালোবাসেন, তারা ‘অন্য সৈকতের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা রং, যন্ত্রণা ও আনন্দের সঙ্গতিপূর্ণ মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। সেই সাথে পাঠকের সঙ্গে লেখকের এক নীরব সংলাপ হবে যেখানে শব্দ হয়ে উঠবে সেতুবন্ধনের মাধ্যম। বইটি পাঠকপ্রিয় হোক, সে প্রত্যাশা রইল।

কাব্যগ্রন্থ : অন্য সৈকতে

লেখক : নুশরাত রুমু

প্রচ্ছদ : সরকার জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশক : লেখাচিত্র প্রকাশনী

প্রকাশকাল : অমর একুশে বইমেলা ২০২৫

মলাটমূল্য : ২৫০ টাকা।