সুমন রায়হান

সনেট Sonnet হলো একটি নির্দিষ্ট ছন্দ ও কাঠামোতে লেখা ১৪ লাইনের কবিতা।

মূলত ইতালীয় ভাষা থেকে উৎপত্তি, পরে ইংরেজি সাহিত্যে এর বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।

অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্য বা কাঠামোর দিক থেকে সনেট প্রধানত তিন ধরনের।

১. পেট্রার্কান সনেট (Petrarchan / Italian Sonnet)

বিভাজন: ৮ লাইন অষ্টক ( (Octave)) + ৬ লাইন ষষ্টক (Sestet)

ছন্দ: KLLKKLLK /ABBAABBA| MNOMNO/CDECDE ev MN-MNMN/CDCDCD

বিষয়: প্রথম ৮ লাইনে সমস্যা বা ভাবনা, পরের ৬ লাইনে সমাধান বা প্রতিক্রিয়া।

২. শেক্সপিয়ারীয় সনেট (Shake-spearean / English Sonnet)

বিভাজন: ৩টি চতুষ্পদী স্তবক (Quatrain) + ১টি দ্বিপদী স্তবক (Couplet)

ছন্দ: কখকখ/ABAB । গঘগঘ/CDCD । ঙচঙচ/EFEF । ছছ/ GG

বিষয়: ভাবনার ক্রমশ বিস্তার, শেষে চমক বা উপসংহার।

৩. স্পেন্সেরিয়ান সনেট (Spenserian Sonnet)

ছন্দ: কখকখ//ABAB । খগখগ/BCBC । গঘগঘ/ CDCD । ঙঙ/EE

বিষয়: ভাবনার আন্তঃসংযোগ ও ধারাবাহিকতা

কবি জানে আলম অধিকাংশ কবিতায় নিজস্ব রীতি ব্যবহার করেছেন। ফ্ল্যাপের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা সনেট সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। রীতিটি হল কককক, খখখখ, গগগগ, ঘঘ। আবার কোথাও একই কবিতায় প্রেট্রাক ও শেক্সপীয়ারের রীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। পুরো বইয়ে ছন্দ রীতি ভাঙার একটি সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তবে তার নিজস্ব রীতি পাঠককে তেমন মুগ্ধ করে না। বরং সহজ ছড়ায় আবদ্ধ করে। এই রীতি সনেটের মর্যাদা পাবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।

এই বইয়ের কবিতাগুলোকে কবি সনেট বা সনেটধর্মী বলেছেনÑযা দেখায় যে তিনি প্রচলিত ইউরোপীয় সনেটরীতিকে হুবহু অনুসরণ না করে নিজস্ব কাঠামো ও ধারা তৈরি করেছেন। এটি সাহসী ও সৃজনশীল সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থে সনেট কেবল রূঢ় কাঠামোর অনুশীলন নয়, বরং একটি আবিষ্কারমূলক চর্চা।

এটি পাঠককে শুধু কাব্যরস নয়, ছন্দের সৌন্দর্য ও বর্ণগত মিলের শিল্প সম্পর্কেও সচেতন করে।

ইতালিয় কবি প্রেট্রাক সনেটের জন্মদাতা।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ১৫৪টি সার্থক সনেট রচনা করে ইংরেজি সাহিত্যে সনেটকে করেছেন প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়। তারপর মিল্টন, স্পেন্সার, কীটস, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ কবি সনেটসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ।

বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাইলফলক। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আল মাহমুদ প্রমুখ কবির হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে সনেট সাহিত্য। বর্তমানে অনেকেই সনেট চর্চা করছেন। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। চৌদ্দ লাইনে নির্দিষ্ট ফরমেটে বিষয়কে সীমাবদ্ধ রাখা কঠিন কাজ বৈকি।

সেই কঠিন কাজটি সহজ করার চেষ্টা করেছেন কবি জানে আলম। এটি বাংলা কবিতায় একটি বিশেষ জায়গা রাখবে কারণ সনেট মূলত বাংলা কবিতায় অপেক্ষাকৃত কম চর্চিত একটি রীতি।

মাইকেল মধুসূদনের পথ ধরে হলেও, জানে আলম নিজস্ব ভাষা ও অনুভূতির জায়গা তৈরি করেছেন।

কবিতাগুলোতে নদী, প্রকৃতি, প্রেম, অস্তিত্ব, সময়ের রূপান্তর, দেশপ্রেম, ইসলাম ধর্ম ও আত্মানুসন্ধান উঠে এসেছে সহজ কিন্তু নান্দনীক ভাবে। ভাষা প্রাঞ্জল ও সাবলিল তবে ভাব গভীর নয়-অনেকটা খোলামেলা।

আমরা তার কিছু কবিতার দিকে নজর দিতে পারি। আমার নদী শীতলক্ষ্যা কবিতাটি শীতলক্ষ্যা নদীকে কেন্দ্র করে রচিত। তবে এটি কেবল একটি নদী নয়, একটি মানসচিত্র বা আত্মার প্রতীক হয়ে ওঠে। নদীটি দুঃখ নিয়ে বয়ে চললেও, তার মধ্যে এক প্রকার সুখ ও আত্মিক প্রশান্তি লুকিয়ে আছে, এটাই কবির দৃষ্টিভঙ্গি।

“সেই নদীতে কাটাতে সাতার লাগে তবু সুখ”Ñ জীবনের জলের মতো দুঃখে ভেসেও শান্তি মেলে।

“নদীর বুকে হাজার টেউয়ের কাব্য কথা হয়”Ñ নদীর গতি মানে জীবনের চলমান কাব্য।

“নেই যে কোনো অভিমান আর অহমিকা তার”Ñ নদী সরল, মায়াময়, অহংকারহীন; যেন প্রকৃত প্রেমিকা।

শেষ চরণগুলোতে প্রেম, বিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তি প্রকাশ পেয়েছে। নদী এখানে শুধু প্রকৃতির প্রতীক নয়, বরং জীবন, ভালোবাসা, ত্যাগ, নীরবতা ও গভীর প্রেমÑএসব অনুভবের রূপান্তর। এটি শুধু একটি নদীকে নিয়ে লেখা কবিতা নয়Ñএ এক অন্তর্জাগতিক আবেগের প্রবাহ। “শীতলক্ষ্যা নাম” হয়ে ওঠে প্রেমের নাম, নদীর নাম, আত্মার নাম।

আমাদের সুখ কবিতাটিতে মসজিদকে আধ্যাত্মিক শক্তি, নৈতিকতা ও সামাজিক ঐক্যের উৎস হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

মসজিদে আমাদের সুখÑ অর্থাৎ সুখ কেবল ভোগ বা আরামে নয়, বরং আত্মিক পরিতৃপ্তি ও সামাজিক শান্তিতে নিহিত। আলোকিত হয়ে উঠে আমাদের মুখ-অর্থাৎ মসজিদে এলে আমরা আলোকিত হই, পথ পাই। ঈমানদার সমাজের কাঠামো নির্মাণে মসজিদ যে কী গভীর ভূমিকা রাখে, কবি সেটি অত্যন্ত আবেগ ও উপলব্ধির সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। শেষ দুই পঙ্ক্তিতে ক্লাইম্যাক্স ও আছে।

আযানের ধ্বনি শুনে সটান দাঁড়াই

জিহাদের জোশ নিয়ে দুইপা বাড়াই।

এখানে ‘জিহাদ’ শব্দটি আত্মসংযম ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের রূপে ব্যবহৃত, কোনো সহিংসতার নয়। এটি দেখায়, কবি আন্তরিকভাবে সমাজ গঠনে আত্মনিবেদন ও প্রেরণার কথা বলেছেন।

কবিতাটি চতুর্দশপদী (সনেট) হলেও ছন্দে কিছুটা ঢিলেঢালা, মধ্যমপন্থী আধুনিক বাংলা সনেটের ধারায় রচিত।

কবিতা আমার- কবিতাটি খুবই আন্তরিক ও গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। নামের মধ্যেই কবির আত্মার সংলাপ লুকিয়ে আছে। কবিতা যেন আত্মশুদ্ধির এক উপায়। পাঠ করলে “দূর হবে পাপ, দূর হবে গ্লানি,” এখানে কবিতা ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক প্রায়শ্চিত্তের প্রতীক।

কবিতা হলো কাবার গিলাফ, অত্যন্ত শক্তিশালী উপমা, যা কবিতাকে পবিত্রতার চরম পর্যায়ে স্থাপন করে। এখানে কবিতা শুধুই শিল্প নয়, আত্মার পরিশুদ্ধি।

এই কবিতা কেবল কবিতাকে নিয়ে লেখা নয়, এটি এক কাব্যমূল্যবোধের ঘোষণা। লেখক মনে করেন, কবিতা যদি সত্য হয়, তবে সে আত্মা ও সমাজ উভয়েরই পরিশুদ্ধি ঘটাতে পারে।

আমাদের কবিতা জীবন একটি আবেগনিবদ্ধ, চিন্তাশীল কবিতা। কবিতাটি কবিতার প্রয়োজন, প্রভাব এবং আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে লেখা। এটি বোঝায়, কবিতা শুধুই সাহিত্যিক অভিব্যক্তি নয়, বরং জীবনের অংশ, শুদ্ধি, প্রতিবাদ এবং ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।

ষষ্টকের চার পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে।

কবিতাই আমাদের সকালের রোদ

কবিতাই আমাদের কোরানিক সুখ

আমাদের তাই থাকে অমলিন মুখ

কবিতাই মনে আনে অনাবিল বোধ।

কোরআনিক সুখ, অমলিন মুখ, অনাবিল বোধ – কবিতা এখানে আত্মার প্রশান্তি এবং চেতনাবোধের উৎস। এই কবিতাটি পাঠকের মনে একধরনের নিবিড় ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা জাগায় কবিতার প্রতি।

জানে আলমের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, একটি প্রায় বিস্মৃত ছন্দরীতিকে নতুনভাবে ফিরিয়ে এনেছেন নিজস্ব রীতিতে। কিছু কবিতায় গভীর ভাবের চেয়ে বিন্যাস ও কাঠামো রক্ষার চেষ্টাই প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়। তার গদ্য কবিতা যতটা গভীর ভাব ও চিত্রকল্প সমৃদ্ধ সনেটে ততটা নয়। একই ধরনের চিত্রকল্পের পুনরাবৃত্তি কোথাও কোথাও পাঠের বৈচিত্র্য কমিয়ে দিয়েছে। পাঠকের ভিন্ন স্তরে পৌঁছাতে গেলে আরও কিছু ভিন্ন মাত্রা ও অন্তর্মুখী সনেট যুক্ত হতে পারত।

আমার নদী শীতলক্ষ্যা শুধুই একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, বাংলা সনেটচর্চার একটি সাহসী ও সার্থক সংযোজন। জানে আলম কেবল একজন কবি নন, তিনি বাংলা শুদ্ধ সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধকও বটে। একনিষ্ঠ সাধক ও ধ্যানি না হলে সনেট চর্চা প্রায় অসম্ভব। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।