ফিরোজ মাহমুদ

হারুন আল রাশিদ। বাংলা সাহিত্যে একজন নান্দনিক ছড়াকার। তার প্রথম ছড়া গ্রন্থ মুদ্রাদোষ প্রকাশিত হয়েছিল-১৯৯৯ সালে। তার সম্পাদিত ছড়ার কাগজ ঝিলিক পাঠক মহলে হয় তুমুল নন্দিত। ঝিলিক এর মাধ্যমেই তিনি সাহিত্য অঙ্গনে নিবিড় যাতায়াত নিশ্চিত করে ঢুকে পড়েন সাহিত্যবোদ্ধাদের বুক পকেটে। তারও আগে সম্ভবত, ১৯৮৭ সালে কৈশোরেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি।

তারপর গদ্য লেখা। তার হাত বেয়ে বেরিয়ে আসে ভালো লাগার ঈর্ষণীয় অনেক গদ্য। একে একে প্রসব করে ফুলে ফলে সু-শোভিত কবিতার লোভনীয় শরীর। সময়ের গন্ডি পেরিয়ে তিনি সরব হয়ে ওঠেন গল্প লেখায়। ছড়া-কবিতা ছাপিয়ে আমরা হারুন আল রাশিদকে আবিষ্কার করি ভিন্ন এক আঙ্গিকে। এ ভাবেই দ্যূতি ছড়াতে শুরু করেন। অত্যন্ত মেধাবী এ কবি যেখানেই হাত দেন, সেখানেই সোনা ফলে। তারই এক জ্বলন্ত সাক্ষ্য কবির জীবনের প্রতিটি পরতে ঘটে যাওয়া সোনালী অতীতের স্মৃতি নিয়ে লেখা- “স্মৃতিনদী নিরবধি” বইটি।

আমি হারুন আল রাশিদকে একজন ছড়াকার হিসেবেই জানতাম। কিন্তু বেশ কয়েক বছর প্রবাস জীবনের রুঢ় বাস্তবতাকে বোগলদাবা করে ধীরে ধীরে গল্প লেখার হাতকে এত চমৎকার ভাবে রপ্ত করেছেন তা ভেবে বিমোহিত হই! আনন্দের হিল্লোলে আলোড়িত হয় দেহ-মন!! আসলে এটা কেবল মাত্র একজন মেধাবী, আত্নপ্রত্যয়ী এবং অধ্যবসায়ী লেখকের দ্বারাই সম্ভব।

২০২০ এর অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয় হারুন আল রাশিদের স্মৃতিকথা-”স্মৃতিনদী নিরবধি” বইটি। অমর একুশে বইমেলায় এ বছর যেতে না পারার কারণে একজন অধ্যাপকের মাধ্যমে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে শেষ করলাম। ৩৪ টি বিষয়কে উপজীব্য করে সাজানো বইটি এক কথায় সুখপাঠ্য। বলিষ্ঠ বিষয়সূচির সাথে সাবলীল বর্ণনা, শব্দচয়ন পাঠককে নিমিষেই পৌঁছে দেয় মোহনীয় আলোকের ঠিকানায়। প্রতিটি গল্পে লেখকের গ্রামীণ জীবনের লোকজ শব্দের নিপুণ ব্যবহার কবি আল মাহমুদের কোন কোন গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

বইটি পাঠ করে আমি অভিভূত হয়েছি! কী অপরুপ লিখনী শৈলীতে চমৎকার ভাবে অকপটে দক্ষ হাতের কুঁচিকায় তুলে ধরেছেন তার কাব্য সংসারের বিচিত্র বিষয়-আসয়। আমি অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, এমন কিছু বিষয় তিনি তার লেখায় নিয়ে এসেছেন যা আসলেই নিখুঁত স্মৃতি কথারই নামান্তর। যা আজ আর আমাদের মনে নেই! সম্ভবত, মনীষী জন পল এ জন্যই বলেছেন- ‘স্মরণ শক্তি আমাদের এক মাত্র স্বর্গ যেখান থেকে আমরা বিতাড়িত হই না।’

কবিতার সাথে তার গভীর প্রেমই তাকে কবিতার রাজকীয় বন্দরে পৌঁছিয়ে দেয়। কবি নিজেই বলেছেন-”কবিতার জন্য নির্ঘূম কেটেছে অনেকগুলো রাত। ঘুম কেড়ে নিয়েছে রুপসী বাংলার জীবনানন্দ দাস। শব্দেরা মোহিত রেখেছে দিনের পর দিন —কার বা জানা ছিলো এমন সরল মধূর বেপরোয়া কাব্যিক মনোভাবের!” এ বক্তব্য প্রমাণ করে কবি জীবননান্দ দাসের প্রভাব হারুন আল রাশিদের কবিতায় স্পষ্ট।

কবি হারুন আল রাশিদের কাব্য সংসার ছিল কন্টকাকীর্ণ। তিনি বাস্তববাদী। স্বপ্নচারী ও। তিনি বাস্তবতার কষাঘাতে বার বার হোঁচট খেয়েছেন, কখনো বা ছিটকে পড়েছেন কবিতার মসৃণ মানচিত্র থেকে। কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি। দুঃসহ বেদনা আর কষ্টের বেড়াজাল ছিন্ন করেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি আর শক্তিকে একত্র করে। প্রিয় পাঠক! আসুন শুনি কবির নিজের ভাষায়-” আমার ভেতরে কাব্যিক প্রেম তরঙ্গায়িত যমুনার মতো বইতে লাগলো উজানে। হৃদয়ের আরশিতে কবি হারুন হেসে উঠলো মেঘ ভাঙ্গা রোদের মতো—— আবার লেখা শুরু করবো।”

প্রবাস জীবনের কঠিন ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে ও বিরামহীন লেখা-লেখি চালিয়ে যাচ্ছেন হারুন আল রাশিদ। আলোচ্য বইটি কেবল মাত্র একটি স্মৃতি কথাই নয়। সাহিত্য বিচারে বইটি মানোত্তীর্ণ বলেই আমি মনে করি। বাংলা সাহিত্যে কবি হারুন আল রাশিদের ‘স্মৃতিনদী নিরবধি’ বইটি আমাদের স্মৃতির এ্যালবামে এক টুকরো আলো হয়ে জ্বলবে অনন্তকাল।

আমার কাছে বইটি সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। পাঠক মহলের কাছেও বইটি ভালো লাগবে বলে বিশ্বাস করি। স্মৃতি বহুল এ বইটি পড়তে পড়তে সম্মানিত পাঠক আপনারা ও মনীষী ম্যারিয়েটের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলবেন-”মধূর স্মৃতি হচ্ছে বাগানের সুন্দর ফুলের মতো, যা মানুষকে মাঝে মাঝে সু-ঘ্রাণে মুগ্ধ ও চমকিত করে।”

স্মৃতিনদী নিরবধি

হারুন আল রাশিদ

প্রকাশক : সাহিত্যবাড়ি প্রকাশনা সংস্থা

প্রকাশ কাল : অমর একুশে বইমেলা-২০২০

প্রচ্ছদ : নুরুজ্জামান ফিরোজ

মূল্য :২০০ টাকা মাত্র