তাজ ইসলাম
প্রেম ও শাসন একটি প্রবন্ধের বই। বইয়ের নামকরণটা বেশ ভিন্নতর। বইটি এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য বইয়ের ভিড়ে এ বইটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মেলায় বেশ আলোচনায় ছিলো বইটি।
‘বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি -যাহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন।’ উপরের কথাগুলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম’র। এই কথাগুলো উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন। নাঈমুদ্দীন আলোচনা করেছেন যৌবন ও ধর্ম নিয়ে। তার আলোচনা বিস্তৃত করেছেন প্রবন্ধের মালায়। সরল শব্দে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় রচনা করেছেন তার প্রবন্ধ । প্রবন্ধের শিরোনাম ‘যৌবন ও ধর্ম’। বিস্তর কথা বলেছেন এ নিয়ে। তার মতে, ‘মানসিক যৌবন স্থির ও স্থায়ী এবং আদর্শের অনুসারী না হলে দৈহিক যৌবন গুরুত্বহীন’। দৈহিক যৌবন দেহের সূর্য পশ্চিমে হেলে গেলে হারিয়ে যায়। তাই বলা যায় যৌবন সবসময় বয়সের ফ্রেমে বন্দী থাকে না। দেহের সাথে বন্ধুত্ব চিরকাল থাকে না যৌবনের। মনের যৌবন যার যত মজবুত তার দেহের যৌবনের স্থায়িত্ব তত দীর্ঘ। মন মজবুত রাখে ধর্ম। ধর্মের আদর্শে উজ্জীবিত মন সবসময় থাকে চাঙ্গা। ধর্ম শেখায় ভোগের চেয়ে ত্যাগের মাহাত্ম্য বেশি। জীবনে ত্যাগের আদর্শ মনে রোপণ করে ধর্ম। লেখক বলেন, ‘আমার মতে ধর্ম মানে যৌবন, কারণ ধর্ম চির যৌবনের।’ লেখক নিজের প্রজ্ঞার জাল ছড়িয়ে একীভূত করেছেন যৌবনের সাথে ধর্মকে। একে অপরের কতটুকু পরিপূরক তা শব্দে শব্দে দেখিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন আলোচ্য প্রবন্ধে।
নাঈমুদ্দীন একটি বিষয়কে আরেকটি বিষয়ের সাথে জোড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের প্রজ্ঞা মিশিয়ে আঞ্জাম দিয়েছেন এ কাজ। শিক্ষার সাথে কর্মের যোগসূত্র কী? শিক্ষা ছাড়া কর্ম, অথবা কর্মহীন শিক্ষা কতটুকু ফলদায়ক তা বয়ান করেছেন ধীরস্থিরভাবে । নিজের বোধবুদ্ধির গুরুত্ব বাড়াতে স্মরণ করেছেন বিভিন্ন মহামানবকে ।
কথা বলতে বলতে মনের অজান্তে বলে ফেলেছেন কিছু চটুল কথা। প্রাবন্ধিকের ভাষা মতে এটি হালকা কথা।
‘আপনি কাজ জানেনতো বেশ আপনার কদর স্বয়ং আল্লাহ খোদাও করবেন।’ মানে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি একজন প্রাবন্ধিক এতোটা সরল বক্তব্যে না গিয়ে কাজের গুরুত্ব, শিক্ষার পাশাপাশি কাজে উৎসাহিত করতে আরও বুদ্ধিবৃত্তিক কথা কামনা করে পাঠক।
‘আমাদের দেশে শিক্ষা যেমন কর্মমুখী নয় তেমন সব কর্মীরাও শিক্ষিত নয়।’ প্রথম অংশের সাথে পূর্ণ একমত হয়েও দ্বিতীয় অংশের সাথে দ্বিমত করা যেতে পারে। তবে লেখকের মত বা দৃষ্টি যদি শিক্ষিত বলতে কেবল একাডেমিক সার্টিফিকেটে আবদ্ধ থাকে তাহলে আর কথা থাকে না। কর্মীনবিশ হলে হয়তো তাকে শিক্ষিত বলা যায় না। দক্ষ কর্মী অবশ্যই শিক্ষিত। কেবলমাত্র দক্ষ বলে তাদের শিক্ষিত থেকে দূরে রাখা হয়। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নই কেবল শিক্ষিত নয়। নিরক্ষর লোকও দক্ষ এবং জীবনের শিক্ষায় তারা শিক্ষিত।
নাঈমুদ্দীন মূলত এটি বুঝাতে চেয়েছেন যে শিক্ষাকে, শিক্ষিতকে জীবনমুখী, কর্মমুখী শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। এ কথার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তার প্রবন্ধালোচনা ‘বাস্তবতার প্রেক্ষিতে- শিক্ষা ও কর্ম’ শীর্ষক আলোচনায়।
নাঈমুদ্দীন বিষয় হিসেবে নিয়েছেন সমাজের সচরাচর বিষয়গুলো। বাছাই করেছেন প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য ঘটা বিষয়। সত্য ও মিথ্যা চারপাশের পরিচিত প্রচলিত বিষয়। সত্যের আবরণে মিথ্যার মিশ্রণে বিভ্রান্ত মানুষ। মিথ্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের বুঝতে হবে মিথ্যার কুফলে সমাজ, ব্যক্তি রাষ্ট্রে কি কি পরিণাম আসতে পারে। বৃদ্ধি করতে হবে নৈতিকতা। তবেই মিথ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে আমরা আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হব সত্যকে। নিজেরা সত্যের পক্ষে থাকলে প্রজন্ম গড়ে ওঠবে সত্যের সেনানী হয়ে।
‘কবিদের কবিতা ও তাদের মর্যাদা’ শীর্ষক আলোচনায় কিছু বানান বিভ্রাট প্রথমেই লেখার সৌন্দর্যকে ব্যহত করে। ‘কবিরা লেখেন এক দৈব শক্তির বলে।’ দৈব শক্তি কী? দৈব শব্দের উৎপত্তি বা বুৎপত্তি দেবতা সংশ্লিষ্ট। প্রবন্ধকার নাঈমুদ্দীন তার প্রবন্ধগ্রন্থ সাজিয়েছেন নিজের বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল থেকে। সেখানে এমন শব্দ চয়ন বেমানান। এমনটা হয় অসতর্কতা জনিতকারণে। শব্দ সংস্কৃতির আগ্রাসনে, বিরুদ্ধ সংস্কৃতির দাপটে কাবু হন বহুজন। ছোট ছোট এমন অনেক বিষয়ে চোখ-কান খোলা রেখেই সামনে আগাতে হয় একজন লেখককে। কবি ও কবিতার কথা বলতে গিয়ে লেখক কবি কবিতা, প্রকাশক ও লেখক সমাজের ভিতর বাহিরের অনেক অজানা কথা তুলে ধরেছেন। তবে লেখাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হত যদি লেখার বিষয় হত কবি ও কবিতার সৃজনশীলতা নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনা করলে। ‘লেখক ও পাঠকের সম্পর্ক’ ‘সাহিত্যের উপাদান’ ‘জ্ঞান ও অজ্ঞতা’ শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ গ্রন্থিত হয়েছে উক্ত কিতাবে।
মোট ১৬ টি প্রবন্ধে সাজানো তার বইটি। বইটির প্রকাশক টইটই প্রকাশন। প্রকাশ হয়েছে ২০২৪ এর একুশে বইমেলায়। বইটির মূল্য ধার্য করা হয়েছে ৩০০ টাকা। বাজারমূল্য চড়া বলেই হয়তো এর দাম একটু বেশি।
বইটির বহুল প্রচার হবে পাঠক সুহৃদের হাতে হাতে পৌছে গেলে। সর্বত্র ছড়িয়ে যাক লেখক আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীনের বই ‘প্রেম ও শাসন’। আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৫ সালে। ইতোমধ্যে তার বহু বই প্রকাশ হয়েছে।
লেখালেখি করেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। ছড়া, কবিতা, গান, গজল লিখেন তিনি। এটি তার প্রবন্ধ গ্রন্থ। লেখক জীবন তার সম্বৃদ্ধ হোক, পাঠক প্রিয় হয়ে সরব থাকুন এই কামনা আমাদের নিরন্তর।