গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলির স্মৃতিস্মারক

মুমতাহিনা রিবু

কবি, ও কলামিস্ট জসিম উদ্দিন মনছুরির গল্পগ্রন্থ “আন্দোলন অথবা কুড়ি আর চারের যোগফল”২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকেন্দ্রিক ছোটগল্পের অনন্য সমাহার। এ গল্পগ্রন্থে ১৪টি গল্প স্থান পেয়েছে। আঙ্গিকে ছোট হলেও গল্পগুলির বিশেষত্ব অসাধারণ। গল্পগুলিতে স্থান পেয়েছে গ্রামীণ সমাজ থেকে শুরু করে শহরে জীবন ও আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলির চমৎকার আলেখ্য। গল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুরুর ঢংটা অসাধারণ। আমরা জানি ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আকস্মিকভাবে গল্প শুরু হয়ে পাঠক যখন গল্পের মধ্যে ডুবে যান তখন গল্পের শেষটা হয়। পাঠকের আরো কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে। ছোট গল্পের সংজ্ঞায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন,

ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখকথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু -চারিটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা,

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।

অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে হইলো না শেষ।

এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলিতে জসিম উদ্দিন মনছুরি গল্পের শুরু ও শেষে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তাঁর গল্পগুলি হয়েছে উঁচুমানের। ভাষার দক্ষতা, গল্পের প্লট, চরিত্র নির্মাণ, বিষয় নির্বাচনে তিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প মহাপ্লাবন। গল্পে তিনি ভিনদেশের আধিপত্যবাদকে তুলে ধরেছেন। শুষ্ক মৌসুমে উজানে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি বঞ্চিত করা এবং বর্ষা মৌসুমে নদীর বাঁধ কেটে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারা স্বভাবটা প্রতিবেশী দেশের আজন্ম স্বভাব। তিনি মহাপ্লাবন গল্পে এসব বিষয়কে অতি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন। গল্পটি ভাষাগত দক্ষতা, চরিত্র নির্মাণ, বিষয়ের বিশেষত্বে চমৎকার গল্প হয়ে উঠেছে। ‘কিস্তি’ গল্পে দরিদ্র মানুষেরা ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয় তার চিত্র চমৎকারভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। এ গল্পে আঞ্চলিক ভাষার ডায়লগ গল্পকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলি যেভাবে এনজিওর শোষণের শিকার হয় সেই চিত্রটা এখানে লেখক শিল্প সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। গল্পের প্রধান চরিত্র কাজল মাঝির রূপকে কিস্তির বেড়াজালে আক্রান্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সীমাহীন দুর্দশার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিস্তি দিতে না পারায় কাজল মাঝির বউ শেফালির দেহ বিলিয়ে দেওয়ার চরম বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তিনি। ‘মাছিবুনু’ গল্পে দেশবিরোধী চুক্তি করে দেশের সার্বভৌমত্বকে বিলিয়ে দেয়ার চরম বাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে। তথাকথিত স্বৈরাশাসক দেশের জনগণের সাথে প্রতারণা করে দেশবিরোধী চুক্তি করে। চুক্তির বিষয়গুলি জনগণের আড়ালে রাখা হয়। যাতে দেশের জনগণ বুঝতে না পারে চুক্তির দেশ বিরোধী ধারাসমূহ। দেশের খেয়ে পড়ে দেশ বিরোধী চুক্তি নিতান্তই দুঃখজনক বটে। যার ফলে স্বৈরাচারকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়। স্নেহ’ গল্পে ছেলের প্রতি বাবার অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসার স্বর্গীয় রূপ তুলে ধরা হয়েছে। কর্মজীবী ছেলের যেখানে বাবাকে ভরণ পোষণ দেওয়ার কথা । কিন্তু বাস্তবতার কারণে ছেলে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কর্মের কারণে ছেলেকে কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকতে হয়। বাবা ছিল অতি সাধারণ জীবন যাপন করা স্কুল মাস্টার। অবসর জীবনে নাতি-নাতনিদের সাথে খেলা করে জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু‘ ছেলে নাতি-নাতনিদের নিয়ে দূরে থাকায় তার মনের মধ্যে এক প্রকার যন্ত্রণা বিরাজ করে। ছেলে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য নির্বাচিত হলে বাবার কাছে দোয়া চাইতে আসে তখন বাবা খুশি হয়ে ছেলেকে ১০০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে শহরের রাস্তা ধরেনি ততক্ষণ পর্যন্ত রাস্তার ধারে বাবা অপেক্ষ্যমাণ থাকে এবং রুমাল বের করে অশ্রু মুছতে থাকে। এভাবেই বাবা ছেলের অকৃত্রিম ভালবাসার কথা নিয়ে স্নেহ গল্পটি সাজানো হয়েছে। ‘জলের কান্না’ গল্পে পানির অপব্যবহার ও কল দিয়ে পানি উত্তোলন করার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জলের হাহাকারের কথা অনিন্দ্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে অতিপ্রাকৃতির বিষয় রয়েছে। মানুষ যেখানে অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। দেখা যায় সেখানে পানির হাহাকারে মৃত্যুবরণ করছে। পানির জন্য মানুষের যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা তারই আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে জলের কান্না গল্পে। ‘শিরোনামহীন মুক্তিযোদ্ধা’ গল্পে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অমূল্যায়ন করে কপট মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান - শ্রদ্ধায় লেখক ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা কাহিনী বর্ণনা করেছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সনদের জন্য দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধরা আড়াল হয়ে গেল কথিত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। ‘কালো টাকা’ গল্পে সরকারি আমলা ও কর্মচারীদের ঘুষের লেনদেনের মাধ্যমে দফারফা করার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। সরকারি চাকরি নিতে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়। চাকুরিতে নিয়োগ পেয়ে তারা সেই টাকাগুলো তোলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তার খেশারত দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের। সরকারি অফিসের বাম হাতের লেনদেনকে তিনি কালো টাকা গল্পে অতি চমৎকারভাবে রুপায়ণ করেছেন। ‘তালাক’ গল্পে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কিভাবে সংসারে অশান্তি নেমে আসে; তালাকের পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে সংসার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এসব খুঁটিনাটি বিষয় তালাক গল্পে লেখক সফলভাবে তুলে এনেছেন। ‘রাজনীতির অপছায়া’ গল্পে রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির কারণে দেশে যেভাবে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে তার আলেখ্য লেখক তুলে এনেছেন। রাজনীতি হতে হবে সহনশীল ও মানবকল্যাণে। কিন্তু বর্তমানের রাজনীতি দোষারোপের রাজনীতি। রাজনীতির ছত্রছায়ায় দুর্নীতির চরম পর্যায়ের কথা রাজনীতির অপছায়া গল্পে লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘মায়ারাক্ষুসী’গল্পে পরিবারের মুরুব্বী দাদী - নানীদের নাতি-নাতিনদের প্রতি স্নেহ মমতার যে বহিঃপ্রকাশ তার চিত্র সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শত অন্যায় করলেও নাতি-নাত্নিরা দাদা-দাদির কাছে পরম আত্মীয় কিংবা পরম ভালোবাসার, স্নেহের। দুষ্টুমি করলেও মা বাবারা শাসন শাসন করতে পারে না।

শাসন করলে তাদের উদ্ধারে দাদা দাদীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দাদা-দাদির স্নেহ মমতার কারণেই নিষ্পাপ শিশুরা অতি আদরে বাঁদর হয়ে ওঠে। দাদা দাদীর অতি আদরের কারণে অনেকের জীবন বিনষ্ট হয়ে ওঠে। এই স্নেহ মমতা অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া ‘হাড়ের ঘরখানি’ গল্পে তথাকথিত জীবন তো মানুষকে বন্দি রেখে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার নিকৃষ্ট পাঁয়তারার কথা বর্ণিত হয়েছে। তথাকথিত আয়নাঘরের প্রতিছবির রূপায়ণে এই গল্পটি যেন আয়না ঘরের প্রতিছবি।

‘আন্দোলন অথবা কুড়ি আর চারের যোগফল’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি আঙ্গিকে ছোট হলেও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে অনেকটা শিক্ষনীয় বিষয়বস্তু রয়েছে। ভাষাদক্ষতা, প্লট, চরিত্র নির্মাণ, বিষয় ভাবনায় গল্পগুলো কালোত্তীর্ণ হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। গল্পগুলেঅতে গ্রামীণ সভ্যতা- সংস্কৃতি, শহরে জীবনের কৃত্রিমতা, ভিনদেশের আধিপত্য, রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্বে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ, ঘুষের লেনদেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্বীকার এসব বিষয় লেখক দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পগ্রন্থ’টি প্রকাশ করেছেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গলুই, ৬৪ পৃষ্টার বইটিতে ১০০ গ্রামের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০ টাকা। প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০২৪। রকমারি ডটকম ও বাতিঘরসহ দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।