জহুর মুনিম
‘অভিযুক্ত অন্ত্যমিল’ তোরাব আল হাবীব-এর ছড়ার বই। বেরিয়েছে দু হাজার পঁচিশের মার্চ মাসে।
বইয়ের নাম ‘অভিযুক্ত অন্ত্যমিল’। মানুষের মতো কি অন্ত্যমিলও অভিযুক্ত হতে পারে? হতে পারে! অন্ত্যমিল বলে এখানে ছড়াকে বোঝানো হয়েছে। ছড়া যদি ক্ষমতাবান খারাপ মানুষের বিরুদ্ধে যায়, তবে সেই ছড়া অভিযুক্ত হতে পারে, ছড়াকার অভিযুক্ত হতে পারেন; যেমনটা হয়েছিলেন বইটির লেখক তোরাব আল হাবীব নিজে। ফ্ল্যাপে প্রকাশক বলছেনÑ
শুধুমাত্র ছড়া লেখার অপরাধে দীর্ঘ ৫৪দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যাপন করতে হয়েছে তাঁকে।
ছড়াকার তোরাব আল হাবীব তাই প্রতিবাদ করে খোঁচা মেরে বলেছেনÑ
চোখ আছে তাই বলে সবকিছু দেখবে?
প্রতিবাদী কথাগুলো ফেসবুকে লেখবে?
না না ভাই এই কাজ
ভুলে কভু করো না
জেনেবুঝে জেলে পচে একা তুমি মরো না।
তবে বাধা কখনোই প্রকৃত লেখককে থামাতে পারে না। এজন্য তোরাব আল হাবীব-এর কলমও থামেনি। বের করেছেন ‘অভিযুক্ত অন্ত্যমিল’। আশি পৃষ্ঠার এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি ছড়ায় আছে বিদ্রোহ। প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের শুরু হয়েছে মনিরুজ্জামান পলাশ-এর প্রচ্ছদ থেকে। প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে একটি প্রতিবাদী হাত শিকল ছিঁড়ে আন্দেলনরত! রক্তাক্ত হাতটি তবুও ক্লান্ত হচ্ছে না।
ছড়া-পাঠে যাওয়ার আগে চোখে পড়ে অভিনব উৎসর্গ-পাতা। বইয়ে সাধারণত উৎসর্গ করা হলেও এখানে করা হয়েছে ভর্ৎসনা।
বইটির প্রথম ছড়া ‘ভয়হীন হিমালয়’। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নিবেদিত ছড়াটির প্রথম স্তবকÍ
আমাদের শহীদেরা আমাদের প্রাণ
চারিদিকে ছড়িয়েছে জান্নাতি ঘ্রাণ
শিশু-যুবা বৃদ্ধরা
পেতে দিয়ে বুক
রাজপথ করে আহা লাল টুকটুক।
ছড়াকার যেখানে দুর্নীতি দেখেছেন, তার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছেন। তার সুন্দর উদাহরণ হিসেবে আমরা ‘আস্তাকুঁড়ে দেশ’ ছড়াটা দেখতে পারি। বিচার-বিভাগে দুর্নীতি দেখে লিখছেনÑ
বিচার বিভাগ পক্ষপাতে
জর্জরিত
সরকারিদল এবং তাদের চর জড়িত
বিচার বিভাগ ফরমায়েশি
রায় দিয়ে দেয়
প্রভুর কথায় আস্ত মাথা, পায় দিয়ে দেয়।
বক্তব্যের সাথে-সাথে চমৎকার অন্ত্যমিলও এখানে লক্ষণীয়।
শিক্ষা-বিভাগ নিয়ে বিগত সময়ে কম সমালোচনা হয়নি। তোরাব আল হাবীবও ছয় লাইনে তাঁর বক্তব্য দিচ্ছেন-
শিক্ষা বিভাগ তিড়িং বিড়িং
নাচের তালে
বাঁদুড় হয়ে ঝুলে আছে গাছের ডালে
শিক্ষা এখন ফেরিওয়ালার
চুড়ি বেচে
বিদ্যালয়ের মোড়ে মোড়ে মুড়ি বেচে।
নির্বাচন নিয়ে বিগত সময়ে কী হয়েছে, তা কে না জানে। নির্বাচন নিয়ে ছড়াকার ‘হায়রে দেশ’ ছড়ায় বলছেন-
খেল তামাশার নির্বাচনে
কে জরিপে আসবে?
ভোটের শেষে সব আসনে আম্বালীগই হাসবে।
দেশের বিভিন্ন বিভাগে যারা দুর্নীতি করছে, ছড়াকার ‘ধরা খেলে গণ্ডগোল’ ছড়ায় তাদের সতর্ক করতে বলছেন-
করছো যখন দুর্নীতি আর
করছো যখন লুট
মাটির তলে সর্প-বিচ্ছু
কামড়াবে কুটকুট।
আচ্ছা, এই যে ছড়া দিয়ে এত প্রতিবাদ করা হয়, ছড়া কি শুধুই প্রতিবাদী? ছড়া কি শুধুই সত্যের পক্ষে? তোরাব আল হাবীব-এর এ ব্যাপারে মতামত কী দেখতে পারি ‘ছড়ার জাত’ ছড়ায়-
ছড়ার ভাষায় আঘাত লাগে
ছড়ার ভাষায় কষ্ট
মাঝে মাঝে হয় ছড়ারা চরম পথভ্রষ্ট
ছড়া আঁকে ডান ও বামের আলগা রেখা পষ্ট।
ছড়া পথভ্রষ্ট হয় কেন? কীভাবে? তা জানতে পড়তে হবে তাঁর ‘জাত নির্ণয়’ ছড়াটি। বলছেনÍ
কিছু কিছু ছড়াকার মদ্যপ আর কিছু পাকনা
সময়ের ব্যবধানে খুলে দেয়
মোনাফেকি ঢাকনা
কিছু কিছু ছড়াকার বেদ্দপ আর কিছু জঙ্গি
অগাবগা খ্যাতি পেয়ে হয়ে যায়
বেজাতের সঙ্গী।
এমন ছড়াকার যারা, তাদের উদ্দেশ্য করে সুন্দর কিছু বার্তা দেওয়া হয়েছে ‘শপথ চাই’ ছড়ায়। শুরু এমন-
তোমার ছড়া ত্যালত্যালা আর
তোমার ছড়ায় ঘি
ছিঃ ছড়াকার ছিঃ
আনুকূল্য পাবার আশায় ভুলছো কেন নীতি?
চাটাচাটি বাদ দিলেও পাবে পরিচিতি।
লেখায় যদি বার্তা থাাকে
ভিন্নতা পায় সৃষ্টি
কাড়বে সবার দৃষ্টি
করবে কেন পদলেহন নেই কি মেরুদণ্ড
ভালো মানুষ খ্যাতির নেশায় সাজলে বুঝি ভণ্ড!
তোরাব আল হাবীব-এর ছড়া আন্দোলন করুক। তাঁর ছড়া মানুষের বিবেক জাগাক। পাপড়ি থেকে প্রকাশিত বইটি হোক বিপ্লবীদের হাতিয়ার।