খোরশেদ মুকুল

রাসূলের জীবন আদর্শ মানো আল্লাহর জিকির হৃদয়ে আনো। আখেরাত আশায় দৃঢ় হও সব ঈমানের পথে যেনো থাকি রব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাত চর্চা মানবতার জন্য নূরের আধার। তাঁর জীবন কেবল ইতিহাসের গল্প নয়, বরং শাশ্বত শিক্ষার অফুরন্ত ভাণ্ডার। তিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন, যাঁর প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি সিদ্ধান্ত আর প্রতিটি আচরণে আল্লাহর হুকুমের সৌন্দর্য ঝলমল করত। সিরাত অধ্যয়ন আমাদের শেখায়, কীভাবে বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হয়, কীভাবে নৈতিকতাকে পরিশুদ্ধ করতে হয়, আর কীভাবে দুনিয়ার কঠিনতম সমস্যার মাঝে থেকেও শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায়। আজকের দুনিয়ায় যখন অস্থিংরতা, বিভাজন, অবক্ষয় আর মতবাদের ভেল্কিবাজি ঘিরে ধরেছে মানবসমাজকে, তখন রাসূলের সা. এর সিরাত আমাদের সামনে খুলে দেয় আলোর পথ। তাঁর দয়া আমাদের শেখায় ভালোবাসা, তাঁর সাহস শেখায় সংগ্রাম, আর তাঁর নেতৃত্ব শেখায় ঐক্যের শক্তি। সিরাত চর্চা তাই শুধু অতীতকে জানা নয়, বরং বর্তমানকে আলোকিত করা এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে নেওয়া। রাসূল সা. এর সিরাত আমাদের জন্য এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস, যেখানে মানুষ খুঁজে পায় জীবনের সৌন্দর্য, সমাজ খুঁজে পায় ন্যায়বিচার, আর উম্মাহ খুঁজে পায় ঐক্য ও মুক্তির পথ। আর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাসূল সা. এর আদর্শই হতে পারে একমাত্র পথ ও পাথেয়। তাই আমাদের উচিৎ সিরাত পাঠের পাশাপাশি সিরাতের শিক্ষা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

সিরাত পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং সিরাতের আলোকে মানব জীবন গড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা প্রতি বছরের মতো এবারও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমতে মাহে রবিউল আউয়াল উপলক্ষে সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংখ্যা পাঠকদের সামনে হাজির করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন। দেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামার পাশাপাশি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক আর নানা পেশার মানুষের ৪৬টি প্রবন্ধ-নিবন্ধে সজ্জিত সোনার বাংলার এই সিরাতুন্নবী সা. সংখ্যা। তাঁদের মধ্যে রয়েছে, প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ, অধ্যক্ষ মাওলানা আ.ন.ম আবদুশ শাকুর, আবদুল হালীম খাঁ, ড. ইকবাল কবীর মোহন, অধ্যাপক ডা. কর্নেল (অব.) জেহাদ খান, অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম, শামসুজ্জামান মতীন, ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া, নাসির হেলাল, শহীদ সিরাজী, মুফতি, মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, এইচ এম জোবায়ের. ড. মো. আরিফ বিল্লাহ, নূরুন্নাহার নীরু, ফজল মুহাম্মদ, মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, মাওলানা হাফেজ কাজী মারুফ বিল্লাহ্, আবদুল বাছেত মিলন, নাসীমুল বারী, জিয়াউদ্দিন সরদার, শাহানারা স্বপ্না, এ কে এম রফিকুন্নবী, শেখ মনিরুল ইসলাম, আব্দুল ওয়াদুদ সরদার, অধ্যাপক আশরাফ জামান, ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান, এস. এম. রুহুল আমীন, গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী, মুহাম্মদ নূরে আলম, বদরুল ইসলাম মুনীর, এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী, আবেদুর রহমান, মুহাম্মদ ইসমাঈল, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক, ওবায়েদ ইবনে গনি, জাকারিয়া আল হোসাইন, আনোয়ার হোছাইন, সাকী মাহবুব। এছাড়া কবিতা লিখেছেন সোলায়মান আহসান, মোশাররফ হোসেন খান, শরীফ আবদুল গোফরান, মাসুম সায়ীদ, জাকির আবু জাফর, মুর্শিদ-উল-আলম, রফিক মুহাম্মদ, মুহাম্মদ রেজাউল করিম, ওমর বিশ্বাস, আলতাফ হোসাইন রানা, আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন প্রমুখ।

প্রিয় হাবিব সা. এর সিরাতের উপর প্রশ্ন করা কিংবা ভালো-মন্দ বিচার করার প্রশ্নই আসে না। তবে বিষয় নির্বাচন ও বর্ণনাভঙ্গির কারণে অনেক বিষয় অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হয়, আবার কিছু বিষয় মানুষকে তেমন আকর্ষণ করে না। এটা সিরাতের দুর্বলতা নয়, বরং এটা লেখকের সীমাবদ্ধতা। এই সংখ্যায় বিচিত্র লেখার মধ্যেও এই দুই ক্যাটাগরির লেখা পাওয়া যায়। তবে বিষয় নির্ধারণে প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দর “সংস্কারের নান্দনিকতা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.” খুবই সমসাময়িক। সংস্কার নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হলেও দৃশ্যমান সংস্কার লক্ষণীয় নয়। রাষ্ট্র সংস্কারে ঐক্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক লিখেন, “সপ্তম শতকে হযরত মুহাম্মদ সা. বিশ্ববাসীর সামনে নতুন আশা, নতুন আকাক্সক্ষার বাণী নিয়ে হাজির হন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্য এবং সম্প্রীতি না থাকলে দেশের কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। ‘নিজে বাঁচ এবং অন্যকে বাঁচতে দাও’ নাগরিক জীবনে এ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন হযরত মুহাম্মদ সা.।” এছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে মুহাম্মদ সা. এর প্রিন্সিপাল নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। লেখক বলেন, “তিনি নবুয়্যত লাভের পূর্বেই ‘হিলফুল ফুজুল’ পুনর্গঠন করে সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

নবুয়্যত লাভের পরে মাক্কী জীবনে তাওহীদ, রিসালাত এবং আখিরাতের প্রচার-প্রসার ঘটিয়ে মানুষের অন্তরকে সংস্কার করেছেন। হিজরতের পরে মদীনা সনদের মাধ্যমে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং বিদায় হজের ভাষণের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন। তাঁর শাসিত রাষ্ট্রে নাগরিকরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তথা সব অধিকার ভোগ করেছেন।”

আলোচ্য সূচির মধ্যে আরেকটা বিষয় আপনাকে আটকাবেই, তা হলো শাহানারা স্বপ্নার লেখা “রাসূল সা. এর আদর্শের আলোকে পুত্রবধূর দায়িত্ব”। বিষয়টা যথেষ্ট আকর্ষণীয় হলেও এবং লেখার ধারাবাহিকতা ও প্যাটার্ন ঠিক থাকলেও সুন্দর উপসংহারের অভাবে লেখাটি তেমন মুগ্ধ করার মতো মনে হয়নি। তবে বিষয়টা সামনে এনে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক উন্মোচন করেছেন লেখিকা। আশাকরি এই বিষয়ে আরও সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ লেখা পাব ইনশাআল্লাহ।

সামগ্রিক বিচারে সিরাত চর্চার সমৃদ্ধ আয়োজন সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’র সিরাতুন্নবী সা. সংখ্যা। মো. হারুন-অর-রশিদের সম্পাদনায় এবং ইব্রাহীম মণ্ডলের নান্দনিক প্রচ্ছদে প্রকাশিত সংখ্যাটির মুল্য রাখা হয়েছে দুইশত টাকা।