গাজী মো. আবু সাঈদ

কবিতায় মনের কথা প্রকাশ করা, হৃদয়ের আকুতি অন্যের মনে সংস্থাপন করা, সত্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সহজ কথা নয়, যিনি এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারছেন তিনিই কবি। এই সূত্রে জালাল খান ইউসুফীও একজন কবি। পুঁথিকাব্যে তার দক্ষতা অসামান্য। এই উপমহাদেশে একসময় পুঁথি-সাহিত্যে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য কবির বিচরণ লক্ষ্য করেছি আমরা। তাদের রচিত পুঁথিকাব্য তখন ঘরে ঘরে পঠিত হতো। তখন পুঁথিকাব্যই ছিল সামাজিক বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। রাত জেগে সেসব পুঁথির কাহিনী এবং সুর শুনতো অগণিত শ্রোতা। সেসব স্বনামধন্য কবিদের প্রতিনিধি হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন আজকের জালাল খান ইউসুফী। কেবল পুথিকাব্যেই নয়, আধুনিক কবিতায়ও নিজের হাতাকে পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। তার রচিত কবিতায় শিহরণ জাগানিয়া ভাব আছে, ছন্দ আছে, লিরিক আছে, আছে মুসলিম উম্মাহর আদর্শ এবং ঐতিহ্য। মাত্রাবোধেও পিছিয়ে নেই এই কবি। ২০২০ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত সিরাতুল মুস্তাকিম শিরোনামের কাব্যগ্রন্থটিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

সৈয়দ আলী আহসান তার মহানবী গ্রন্থের ভূমিকায় ইরান ভ্রমণের কথা লিখেছেন। ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থানকালে ইরানের বিখ্যাত পণ্ডিত জয়নুল আবেদীন রাহনুমার সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল তার। রাহনুমা সাহেব কেবল পণ্ডিতই নন, ইরানের একজন বিখ্যাত লেখকও। তিনি তার রচিত ‘পয়গম্বর’ নামক গ্রন্থটি সৈয়দ আলী আহসান সাহেবকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন- ‘একজন সাহিত্যিক তার সাহিত্যচর্চায় যদি মহান রাসূলের জীবনকে অবলম্বন করে, তাহলে সে একই সঙ্গে পুণ্যবান এবং সফলকাম সাহিত্যিক হবে বলে আমি মনে করি। কেননা, এই জীবনটি এমন একটি জীবন সেখানে ঔদার্য আছে, সান্ত্বনা আছে, বরাভয় আছে এবং পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধতার জন্য দিক নির্দেশনা আছে। আমি এই গ্রন্থটি রচনা করে শান্তি পেয়েছি।’

রাহনুমা সাহেব তার কথায় একটুও বাড়িয়ে বলেননি। মুসলমান হয়ে আল্লাহ-রাসূলের চর্চা করলো না, ইসলামের কথা বললো না, সরলপথের দিশারী হলো না, তার সাহিত্যচর্চার কোন মূল্য আছে কি না এমন প্রশ্ন আমার অন্তরেও বিদ্যমান। আল্লাহর আরাধনা এবং রাসূল (সা.)-এর প্রশস্তি ব্যতীত কোন মুসলমান কবি সফলকাম হয়েছেন এমন নযীর বিরল। যিনি আল্লাহ এবং তার রাসূলকে নিয়ে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত হয়েছেন, তিনি অবশ্যই সফলকাম হয়েছেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের খ্যাতি বিশ্বজোরা। আল্লাহ-রাসূলের শাণে অগণিত রচনাই তাকে উক্ত আসনে সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছে। তার কবিতার উদ্ধৃতি এবং গান না গেয়ে আলেমরাও ওয়াজ মাহফিলে তাদের সুললিত বক্তব্য সম্পূর্ণ করতে পারেন না। আল্লাহ এবং তার রাসূলের শাণে কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন কবি ফররুখ আহমদও। কাব্যে ইসলামের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে ফররুখ ছিলেন একজন বীর সেনানী। তার সময়ে অনেক প্রতিভাধর কবির অভ্যুদয় ঘটেছিল, কিন্তু তাদের অনেকের নামই আজ ভুলে গেছে এদেশের মানুষ। কারণ, তাদের লেখার মধ্যে আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর বাণী ধ্বনিত হয়নি। ফলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তাদের সাধনা। ফররুখ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বলেছেন; ‘তার সমসাময়িক ও সহকর্মী কবিদের যাঁরা ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্যের রূপকার হিসেবে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারা বিশ্বাসের স্থির বিন্দুতে অবস্থান করতে না পেরে অনেকে ভিন্ন পথ নিয়েছেন, আবার অনেকেই ক্রমান্বয়ে কাব্য-দিগন্তে দূরবর্তী অস্পষ্টতায় বিলীন হয়ে গেছেন।’

আশার কথা, কবি জালাল খান ইউসুফী আল্লাহ এবং তার রাসূলকে বক্ষে ধারণ করে নিয়েছেন শুরুতেই। পুঁথিকাব্য নিয়ে আবির্ভূত হলেও বিশ্বাসের স্থিরবিন্দু থেকে বিস্মৃত হননি তিনি। তার রচিত ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ অবশ্যই সাফল্যের পরিচায়ক। গ্রন্থটির ছত্রে ছত্রে, পরতে পরতে রয়েছে আল্লাহ এবং তার রাসূলের শানে হামদ এবং নাত। রয়েছে রাসূল (সা.)-এর প্রধান সাহাবা চতুষ্টয়ের গুণগান; রয়েছে ঈমানের কথা, মানবিকতার কথা, মুসলিম মিল্লাতের আমরণ সংগ্রামের কথা। আল্লাহকে স্মরণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন;

“সাদ্দাদ ফেরাঊন কারূনের গর্ব

হাইয়ূল কাইউম করে দেন খর্ব।

পণ কর তার সাথে ধরব না পাল্লা,

নেই তার সমুতুল তিনি এক আল্লাহ।”

(তিনি এক আল্লাহ)

ইউসুফীর লেখা এই পঙক্তি কয়টি পড়তে গিয়ে স্মরণে এসে গেল বিদ্রোহী কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’র কথা। সেখানে নজরুল লিখেছেন- ‘কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝিমাল্লা/দাঁড়ি মুখে সারি গান লা-শরীক আল্লা।’

রাসূল (সা.)-এর আগমনের পূর্বে আরবের সামাজিক অবক্ষয়ের ইতিহাস আমরা জানি। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাসকে জালাল খান ইউসুফী ছন্দাকারে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা সত্যি অনবদ্য। সেদিনের সেই আরব জাহানের নিষ্ঠুর দাসপ্রথা, গোত্রে গোত্রে মারামারি-যুদ্ধ, অসহায়ের উপর সবলের অত্যাচার, সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে জীবিত কবরস্থ করা সমস্তই পুংখানুপুংখুরূপে উঠে এসেছে তার ছান্দিক তুলিতে। রাসূল (সা.) ছিলেন রহমতের নবী, দয়ার সাগর; তার গুণাগুণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন পারস্যের কবি সুফী দরবেশ শেখ সাদীও। তারও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গেছেন তিনি। তিনি লিখেছেনÑ

“কে এই মহান কে এই মানব জানো কী তোমরা ভাই?

এই মানুষের সমতুল আর জগতে যে কেউ নাই।

সব কাজে তার শুদ্ধতা ছিল কোথাও ছিল না ভুল,

তিনি আমাদের পথের দিশারী মুহাম্মদ রাসূল।”(সা.)

(হযরত মুহাম্মদ (সা.)

গ্রন্থের তৃতীয় কবিতাটির নাম ‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’। এখানে আরবের সেই বিখ্যাত গারে সাওরের কথা বলা হয়েছে। হিজরতকালে রাসূল (সা.) যখন মক্কা থেকে মদীনায় যাচ্ছিলেন, তখন তার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। যাত্রাকালে মক্কার দক্ষিণে সাওর নামক একটি পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। হযরত আবু বকর (রা.) কেবল গুহার সঙ্গীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাসূল (সা.)-এর আজীবনের বন্ধু-বিশ্বস্ত সহচর। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি তার একনিষ্ঠতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনিই সর্বপ্রথম দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন মেরাজের কথা। এজন্য তাকে সিদ্দীক খেতাবে ভূষিত করেছিলেন রাসূল (সা.)। এছাড়াও নিজের সমস্ত ধন-সম্পদ ইসলামের খেদমতে দান করে যশস্বী হয়েছিলেন তিনি। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতেই কবিতাটি রচনা করেছেন জালাল খান ইউসুফী। এই রচনায় যথেষ্ট মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেনÑ

“হাবশী গোলাম আজাদ করেন বিলিয়ে নিজের ধন,

জীবন যৌবন বিলিয়ে কেনেন আল্লা’ নবীর মন।

নবী ও প্রভুর কথাকে যিনি

মেনে চলেছেন সর্বদা তিনি

‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’ বলেই কোরানিক বর্ণন।”

ইসলামের অন্যতম বীর সেনানী হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবকে নিয়ে তিনি লিখেছেনÑ

“নাম তার খাত্তাব ছেলে তার ওমরে,

খ্যাতিমান বীর ছিল কুস্তি কি সমরে।

তার সাথে লড়বার বীর নেই মক্কা,

বীরদের বুক কাঁপে লড়লেই অক্কা।” (ইবনুল খাত্তাব)

এমনি করে হযরত ওসমান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.)-কে নিয়েও লিখেছেন। তারা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর অন্যতম সাহাবী, ‘সিরাতুল মুস্তাকিমে’র অন্যতম রাহবার। সেই রাহবারদের ছবি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অঙ্কন করেছেন কবি। গ্রন্থের মধ্যে যতগুলো কবিতা সংস্থাপন করা হয়েছে, প্রতিা কবিতার মধ্যেই রয়েছে ন্যায়ের কথা, ইসলামী আদর্শের কথা, সরল পথের দিকদর্শন। প্রতিা কবিতাই স্মরণ করিয়ে দেয় নৈতিকতার কথা, আখিরাতের কথা, হাশর দিনের ভয়াবহতা; যা অধিকাংশ মানুষই জীবদ্দশায় স্মরণ করতে চায় না। মানুষকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, এই জীবনের নিশ্চয়ই একদিন অবসান ঘটবে। আর অবসান ঘটলেই যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল এমন নয়, পরজনমে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির হতে হবে, সেখানে যাপিত জীবনের প্রতিা কাজের চুলচেরা হিসাব দিতে হবে। দুনিয়াতে জীবনটা কী করে কাটানো হয়েছে, যৌবন, ধন-সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, কোনটাই সেই হিসেব থেকে বাদ যাবে না। এই কথাটাই নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন জালাল খান ইউসুফী তার কবিতা “সেদিন বেশি দূরে নয়”। ত্রিপদী ছন্দে তিনি লিখেছেন-

“খেলেছিলে খেলা কেটেছিল বেলা

  • হেলায় হেলায় বেশ,

ভাবনিতো আর কোথায় তোমার

  • জীবনের হবে শেষ।

ভাবতো বন্ধু আর ক’টা দিন

  • খেলে যাবে এই ভবে

সকল কিছুর হিসাব তোমাকে

  • দিতেই হবে যে হবে।”
  • গ্রন্থের একটি মুগ্ধকর কবিতা ‘সোনার খাঁচা’। মানুষের দেহকে খাঁচার সাথে তুলনা করে রচিত হয়েছে অনেক গান এবং কবিতা। সেসব গান-কবিতা মানব অন্তরকে চিরকালই মহান আবিলতায় আবেষ্ঠন করতে সক্ষম হয়েছে। আধ্যাত্মিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেসব গান এবং কবিতায়। যেহেতু দেহ-খাঁচাকে ঘিরেই মানুষের জীবন। এই দেহ-খাঁচার ভেতর যে পাখিটা বিদ্যমান, সেটা কখনই কেউ দেখেনি, তার প্রকৃতিও কেউ জানতে পারেনি। দেহ-খাঁচার সৌন্দর্য এবং চলৎশক্তির মূল উৎসই সেই অদেখা পাখিটা। সেটার উপস্থিতি না থাকলে দেহ-খাঁচার কোন মূল্যই থাকে না। কবি জালাল খান ইউসুফী বলেনÑ

‘জীবন নামের সুখ পাখিটা সোনার খাঁচায় বন্দি,

খাঁচার সাথে পাখির সাথে কি জানি কি সন্ধি।

তাই না হলে বন্দি পাখি কেমনে থাকে মুক্ত?

পাখির জীবন খাঁচার সাথে কেমন যেন যুক্ত।’

অতীব সত্য কথা! এক নিদারুণ সত্য কথারই নবতর প্রকাশ। মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছাতেই যে খাঁচা এবং পাখির মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়েছে, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

গ্রন্থটিতে মোট পঁয়তাল্লিশটি কবিতা সংযোজিত হয়েছে। বিভিন্ন ছন্দে রচিত প্রতিা কবিতাই আধ্যাত্মিকতায় এক একটি হীরকখণ্ড। জালাল খান ইউসুফীর সিরাতুল মুস্তাকিম কাব্যগ্রন্থটি ইসলামের একটি অনন্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিশ্বাসীদের অন্তর অধিকতর পরিচ্ছন্ন করে তুলতে কবিতার বাণীগুলো পরশ পাথরের কাজ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী কবি মহিউদ্দিন আকবরের অঙ্কিত প্রচ্ছদে আরও সুষমামণ্ডিত করেছে গ্রন্থটিকে। হার্ডবোর্ডে বাঁধানো ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য মাত্র ২০০ টাকা। আমি গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।