গাজী গিয়াস উদ্দিন

কবি ও কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান এর কথা দিয়েই শুরু করি। জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর ছোটগল্প গ্রন্থ “ঘরজামাই “ সম্পর্কে তিনি বলেছেন,

“অসাধারণ এক ক্লাইমেক্সের গল্প ঘরজামাই। আশা করি সহজ সরল এবং মেদহীন ভাষায় রচিত প্রতিটি গল্প সুধী পাঠকমহলে সমাদৃত হবে”।

দশটি গল্পের সমাহার ‘ঘরজামাই ‘। প্রথম গল্প ‘প্রবাসের চিঠি ‘। কাশেম বনাম জোহরা - এলিসা ত্রিমাত্রিক প্রেমের গল্প। কাশেম- জোহরা গভীর প্রেম ও বিয়ের মাঝে এলিসার ধর্মান্তরিত হয়ে বাধ্যগত বিয়ে কাশেমের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। অপরদিকে জোহরা বিরহের অতলে হারিয়ে যায়। গল্পটির সৌন্দর্য - এটি সাদামাটা আর দশটি গল্পের মতো। ইসলাম ধর্মের গুণাবলী চরিত্রের সংলাপে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কাহিনির গাঁথুনি ও সন্নিবেশনাও সুন্দর। ভাষা ঝরঝরে। নাটকীয় সংলাপ নেই। প্রেমের খানিক বিপর্যয় পাঠকচিত্তকে ব্যথিত করে। গল্পের রেশ পাঠক বহন করা সার্থকতার গুণ। কতো নায়কের প্রবাস জীবন কতো নায়িকার হৃদয় ভাঙে। গল্পের যবনিকা তুলে ধরছি:

“অনেকদিন পর জোহরা আকাশের দিকে তাকালো। হালকা সাদা মেঘগুলো পাখির মতন উড়ছে। আচ্ছা, মেঘগুলোর কি ডানা আছে? সেই মেঘগুলো কি জোহরাকে তাদের দুটি ডানা ধার দেবে? (মনে অতৃপ্তি রবে..... শেষ হয়ে হইল না শেষ - রবীন্দ্রনাথ) ।

‘আদর আলীর জ্বর’। এ গল্পে গৃহকর্তার প্রতি স্ত্রী ও সন্তানদের অসদাচরণ ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি মা ও সন্তানের সহানুভূতির শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে। গৃহকর্ত্রীদের মোবাইল আসক্তি এবং নতুন প্রজন্মের সন্তানদের অতি ও অন্ধ বন্ধুপ্রীতির কারণে পিতামাতার সাথে দূরত্ব সৃষ্টির মতো পারিবারিক নানা সমস্যা উঠে এসেছে। ব্যতিক্রম শিক্ষকের ব্যাপারে ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা এবং নিজের কর্মজীবনে সাফল্যের বিষয় তুলে ধরতেও গল্পকার ছাড়েননি।

চাকরিজীবী দাপুটে স্ত্রীর দুর্ব্যবহারের অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘শহর আলীর একদিন - প্রতিদিন ‘ গল্পটি শুরু। স্ত্রী সখিনার মেজাজ প্রকাশে গল্পকারের বর্ণনা ঃ “ হিজাবের একপাশ টানতে টানতে হাই হিলের কড়া শব্দ বাতাসে ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে গেল”। অপর সবার জন্যে মিষ্টভাষী সদয় সদাচরণকারি স্ত্রীরা একমাত্র স্বামীর প্রতি কেন দাম্পত্য জীবনের এক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রূঢ় আচরণ করেন। এ বিষয়ে গল্পকারের প্রশ্ন ঃ “ কিন্তু কেন? মহাবিশ্বের অনেক রহস্যের মতন এটিও শহর আলীর নিকট অন্যতম প্রধান রহস্য “।

একজন কবি- শিক্ষক পরিবারে পত্নীশাসনে কতটুকু জিম্মি ও অতিষ্ঠ। কতটুকু নিত্য গাধা খাটুনি খেটে দিশেহারা। তার করুণ হতাশ্বাস : “ সারাদিনের ক্লান্তিরা যেন শহর আলীর সমস্ত শরীর জুড়ে কোরাস গাইছে “।

পরবর্তী গল্প ‘ ছমিরন বিবির কুশলাদি ‘। ভূমিকার বক্তব্য জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবতা। ভাব ভাষা ও বর্ণনা শিল্প - দর্শন সহযোগে দারুণ উপমাত্মক। পারিবারিক অতীত ঐতিহ্যের স্মারক অসাধারণ এক গল্প। শিক্ষনীয়ও বটে। কাহিনির পরতে পরতে রয়েছে পারিবারিক নানা মিথস্ক্রিয়া। বৃদ্ধ মায়ের যত্ন আত্তিতে নিবেদিত পুত্রের জননী সেবার পরাকাষ্ঠা। অপরদিকে তারই উদাসীন সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের বৈরী আচরণ। সব মিলে মূগ্ধকর গল্প।

‘ও নেগেটিভ ব্লাড’ এ গল্প আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে। পরবর্তী গল্প ‘ ছায়ার বাসর ঘর’। এ গল্পে একটা মরমি সুর সূক্ষভাবে খেলা করে। মানবজীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব, অতৃপ্তি ও বঞ্চনার বৈচিত্র্য এ গল্পের কাহিনি জুড়ে সক্রিয়। পাষাণী নারী বাসরঘরে স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করে। দূরে সরে যাওয়া অভিমানী স্বামীর প্রতি অনুশোচনা নিয়ে প্রতীক্ষায় আয়নাঘরে বন্দিনী সে নারী। গল্পটা বেশ চমকপ্রদ।

‘ লাল শাড়ি ও একটি পুতুল ‘-এ ছোটগল্পে ভাবাবেগ পরিস্ফুটন এবং কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে এ গল্পকারের মুন্সিয়ানা আছে। গল্পের দীর্ঘ অবতরণিকায় ভাব- কাব্যিকতার গভীরতা দেখতে পাই। মুশকিল হচ্ছে, সমৃদ্ধ শুভ আরম্ভের পর হঠাৎ সাদামাটা আটপৌরে বাক্যবন্ধে

এসে হোঁচট খেতে হয়। ভাষা মানের ধারাবাহিকতা অটুট থাকলে তথা ভারসাম্য থাকলে ভালো লাগতো। এ গল্পের মানব মানবীর দাম্পত্য জীবন ও ভালোবাসার প্রকাশ ব্যতিক্রম। অদ্ভুত - অস্বাভাবিক কিছু মিলন - বিরহের চিত্র।

‘বাইন তালাক’ গল্পটিতে অসাধারণ নাটকীয় মোড় আছে। ক্লাইমেক্স আছে। পাঠক মন জয় করার মশলা আছে। এ গল্পের যুৎসই ভাষাটাও মনকাড়া - মানানসই। ‘ চিরকুমার সংঘের সভাপতির বিয়ে ‘ কাহিনির বিষয়বস্তু অনেকটা হালকা। শুধু কিছু উপমাত্মক বাক্যে নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়।

সর্বশেষ গল্প ‘ঘরজামাই ‘ এর কাহিনীর শেষের দিকটাই ভালো হয়েছে। জসীম উদ্দীন মুহম্মদ একজন কবি ও প্রাবন্ধিক। সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। সাহিত্য স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ৪৭ টি পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত একটি উপন্যাস এবং আরো দুটো গল্পের বই রয়েছে। তাঁর এ গল্প বইটিও পাঠকপ্রিয় হবে বলে আমি আশাবাদী। গল্পগুলো পড়ে আমি বেশ আনন্দ পেয়েছি। বেশির ভাগ গল্পই পাঠক টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো।

তবে গল্পকার কয়েকটি গল্পে পুরুষবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। পুরুষ সমাজের সমস্যা ও তাদের দুঃখকষ্টের কাহিনিতে ভরপুর এসব গল্প। নারীর সুখদুঃখ, ভাব- বাসনার কথা সমভাবে অনুপস্থিত। হয়তো এসবই গল্পগুলোর ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য।

সর্বোপরি আমি এ গল্পের বইয়ের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।

ঘরজামাই (গল্পগ্রন্থ)

লেখক : জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

প্রকাশক: প্রহেলিকা

প্রকাশকাল : ২০২৫

মূল্য - ২০০ টাকা।