তাজ ইসলাম
‘মায়ের মৃত্যু: আমার সমস্ত সুখ মাটির নিচে’ মাতৃ বিয়োগের হাহাকার কেঁপে ওঠে হৃদয়।
মা মারা গেলে সন্তানের বয়স যাই হোক মাতৃ বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয় সন্তান। বয়সের ব্যারিকেড ভেঙে সন্তান হয়ে যায় শিশু। বৃদ্ধ, প্রৌঢ় সন্তানও হয়ে পড়েন শিশু। হাসান আলীম বয়সে প্রবীণ, খ্যাতিমান কবি। তার বয়স ৬৮ বছর। কবির মা মারা যাওয়ার পর তার ভেতরে কান্নার ঢেউ ওঠে। বেদনার হাহাকারে হৃদয় ভাঙে নদীর ঢেউয়ে যেমন ভাঙে তীরবর্তী বাড়ির আঙিনা। হাসান আলীম তার সমস্ত দুঃখ, বেদনা, হাহাকার, শূন্যতার ধ্বনি প্রতিধ্বনি সমুহ প্রকাশ করেন কবিতায়। তিনি কবি, কবিতাই তার প্রকাশ মাধ্যম। সব না বলা কথা, মায়ের স্মৃতি, মায়ের অস্তিত্ব, মায়ের শূন্যতা,মা হারানোর মর্ম যাতনা সব প্রকাশ করেছেন কবিতায় শব্দ শব্দে। ছোট বড় প্রায় ৩২ টি কবিতা একত্র করে প্রস্তত করেন পাণ্ডুলিপি। এটি বই আকারে প্রকাশ করেন ২০২৪ সালে।
প্রকাশকের বয়ান মোতাবেক,
‘ এটি হাসান আলীমের একটি আলাদা মেজাজের কবিতা গ্রন্থ। তার জন্মদায়িনী মমতাময়ী মা জননীর মৃত্যুর পরপরই ধারাবাহিকভাবে প্রায় ৫০ টি শোকের কবিতা লেখেন। এ গ্রন্থটি ‘ মায়ের জন্য এলিজি’ শিরোনামে প্রকাশ হচ্ছে। মাতৃভক্ত মানব হৃদয়ের রক্তক্ষরণের বেদনা নির্ঝর অমিয় সুন্দর কাব্যগ্রন্থ এটি।’
হয়তো কবি ৫০ টি বা তারও অধিক কবিতা লিখেছেন। তবে এই গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৫০টি নয়। একেকটি কবিতার ভেতরে ভিন্ন রকম অনুভূতি, অন্যরকম চিন্তা, বেদনাও তার বিচিত্র রঙ, রূপ নানা বর্ণে হাজির। মা মারা যাওয়ার পর বয়স্ক হাসান আলীম হয়ে পড়েন অপ্রাপ্ত বয়সের শিশু। তিনি বলেন ‘ মাকে চিৎকার করে ডাকছি’। মায়ের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে লেখেন মাকে নিয়ে নানুবাড়ি যাচ্ছেন। পথিমধ্যে পড়েন ডাকাতের কবলে। তারা ডাকাতদের ধাওয়া করেন। মা নৌকায় থেকে যান।
‘ তারপর চলে আসি নৌকার নিকটে,/ মা’কে দেখি না নৌকায়/ আমার বুক ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে, মা মা তুমি কোথায় গিয়েছো?’
তার আগেই ‘ তেত্রিশ বছর চলে গেল’ ৬৮ বছর পেরিয়ে গেল, তবু সন্তানের নাকে লাগে
‘ মায়ের পিঠের ঘ্রাণ’। এক সময় মা চলে যান। মায়ের বয়স হয়েছে। সন্তানেরা বড় হয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একেক জন একেক স্থানে। মাতৃ বিয়োগের পর একজন সন্তান সত্যই অন্তর স্থলে অনুভব করে,’ আজ আমি মাতৃহারা চির- নিঃসঙ্গ’।
মা মারা যাবে, প্রতিটা মানুষই মারা যাবে। যার যখন হায়াত ফুরিয়ে যাবে, তিনি চলে যাবেন অসীমের উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ থাকবে। তবু নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সামনে।
‘ মা, তুমি কি জগত তারিণী’! মা কি জগত তারিণী? হাসান আলীম কবি, বিজ্ঞজন। তিনি তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ, অনুকরণীয় জনও। একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন থেকে যায়, মা কি জগত তারিণী হয়? হয় কি হয় না, সে সমাধানে আমরা যাব না। তবে অন্য বিশ্বাসে অনায়াসে তাদের মাকে অতি আবেগে জগত তারিণী বলতে ও মানতে শোনা যায়। হাসান আলীম অবশ্য মাকে জগত তারিণী বলেননি, বাক্যের শেষে রেখেছেন বিস্ময় চিহ্ন।
ফরিদা তার বোন। মায়ের মৃত্যুর পর মাতৃসম সে বোনের স্মৃতিও জাগ্রত হয়েছে কবি প্রাণে।
মূলত কবিতাগুলো মাতৃ বিয়োগ ও মাতৃপ্রেমে রচিত। আপাতত বিষয় এক হলেও এক থেকে চলে গেছে একাধিক পথে। যুক্ত হয়েছে বিচিত্র বিষয়। সবগুলো কবিতার সম্মিলনে প্রকাশ পেয়েছে একজীবন, মায়ের সমগ্র জীবনের সামগ্রিক চিত্র।
‘ আমি মায়ের বড়ো সন্তান,/ আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে বের হচ্ছে অস্পষ্ট হুদ হুদ/মা তুমি আমার অশ্রুতে আবারও পরিস্নাত হও।/ (মাকে মনে পড়ে)’।
কবিতাগুলো স্মৃতিময়, প্রীতিময়, বিরহ, বেদনার রঙে রঙিন। যে কোন মাতৃভক্ত পাঠক একটি কবিতায় ডুব দিলে মায়ের বিয়োগ ব্যথায় অশ্রুসিক্ত হবে নিজের অজান্তে।
কেবল একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে, কেবল মাতৃবিয়োগকে কেন্দ্র করে একটি কবিতা গ্রন্থ প্রথম বা একমাত্র না হলেও অনন্য কাজ বলা যায় নিঃসন্দেহে।
হাসান আলীমের এই পুস্তকটি একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে থাকবে এমন আশা করাই যায়। একজন হাসান আলীমের কাব্য জীবনের জন্যও এটি সৃষ্টির একটি রঙিন পালক। মাতৃভক্তিরও কাব্যময় নমুনা। আমরা আশা করি বইটি পাঠক নন্দিত হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স ২০২৪ সালে জানুয়ারি মাসে। মূল্য রেখেছে ৩০০ টাকা। চার ফর্মার বইয়ের কাগজ ও ছাপার মানও ভালো। প্রচ্ছদ শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। তবে মূল্যটা একটু বেশি। বেশি হলেও কম মূল্যে কিনতে যোগাযোগ করুন প্রকাশকের (০১৬৮৬৮৫০২৬৬) সাথে।