সুমন রায়হান

মহিউদ্দিন আকবর শুধুমাত্র একজন বড় মাপের কবি নন, তিনি ছিলেন এক মহান হৃদয়ের মানুষ। স্মারকটিতে তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকরা শুধু স্মৃতিচারণ করেই ক্ষান্ত হননি- তারা হৃদয়ের অকৃত্রিম ভাষায় তুলে ধরেছেন, তিনি কতটা মহৎ ও মহান মানুষ ছিলেন তার বিবরণ। জীবনে অনেক স্মারকগ্রন্থ দেখেছি, পড়েছি কিন্তু কোনোটি পুরো পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে কবি মহিউদ্দিন আকবর স্মারকটি হাতে পাওয়া মাত্র দু’দিনেই শেষ করে ফেলেছি। স্মারকে অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখাতেই উঠে এসেছে তাঁর সহজ-সরল, নিরহংকার ও মহৎ জীবনের চিত্র। লেখাগুলো এতটাই আন্তরিক ও প্রাণবন্ত মনে হয়েছে যে, কোথাও কোনো লেখায় কৃত্রিমতা খুঁজে পাইনি- সব লেখাই হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন। এমন একটি নিবেদিতপ্রাণ মানুষের স্মরণে প্রকাশিত এ স্মারক নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য একটি মূল্যবান দলিল।

মহিউদ্দিন আকবর কবিকে চেনেন না জানেন না এমন কেউ যদি স্মারকটির সূচিপত্রটুকুও পড়েন- নিশ্চিত তিনি কবি ও কবির সাহিত্য সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে যাবেন। আর পুরো স্মারকটি পড়ে পাবেন একটি স্বর্গীয় অনুভূতি। মনে মনে ভাববেন- আহা বর্তমানে এমন ভালো মানুষ কি হয় নাকি?

স্মৃতি থেকেই স্মারক। তাই অধিকাংশ লেখাই প্রেমপ্রীতি ও সুখস্মৃতিচারণ মূলক। যার মাধ্যমে আমরা মহিউদ্দিন আকবরকে চিনতে পারি। বিশিষ্ট ছড়াকার আ. শ. ম বাবর আলী দুঃসহ স্মৃতির কাতরতায় প্রবন্ধে লিখেছেন - ‘মহিউদ্দিন আকবরের মতো একজন নিরেট ভালো মানুষের শ্রদ্ধা আমি চাইনি, আমি চেয়েছিলাম বন্ধু হয়ে ভালোবাসা পেতে। কারণ, তার মতো একজন বন্ধুবৎসল মানুষকে বন্ধু করে পাওয়া অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। মহিউদ্দিন আমাকে সে সৌভাগ্যের অংশীদার করেছিলেন।’ সময়ের বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম, সম্পর্কের শুরুর স্মৃতিচারণ করলেন এভাবে- ‘আমাদের পারস্পরিক পরিচয়ের সেতুবন্ধন ছিল অনুশীলন সংঘ। আমার বয়সের ভেদ রেখা ছিদ্র করে আমাদের বন্ধুত্বের স্থায়ী মঞ্চ তৈরি হল।’ একান্ত বন্ধু কবি ও গবেষক নাসির হেলাল বলেন, ‘অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত, রুচিশীল, ধর্মনিষ্ঠ, হৃদয়বান, আকাশের মতো উদার ছিলেন কবি মহিউদ্দন আকবর।’

পয়ত্রিশ বছরের কবিবন্ধু হাসান আলীম লিখেন, ‘মহিউদ্দিন আকবর একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার দেশপ্রেম ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি আপাদমস্তক পরহেজগার মুত্তাকী ও খাঁটি মুসলিম, খাঁটি বাঙালি ছিলেন।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন অধিকাংশ লেখক। তাদের মধ্যে অন্যতম আবু সাইদ কামাল, আলমগীর খোরশেদ, আমিনুল ইসলাম মামুন, আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন, ইবরাহীম বাহারী, ওমর বিশ্বাস, কামরুজ্জামান, কামাল সিদ্দিকী, জহির উদ্দিন বাবর, মুস্তফা ইসলাহী, মুনীরুল ইসলাম প্রমুখ। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি কবির সাহিত্যকর্ম নিয়ে লিখেছেন সুলতানা রিজিয়া, সিরাজুল ফরিদ, মুহাম্মদ ইসমাঈল, মনসুর আজিজ, ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ, ড. শহীদুল্লাহ আনসারী, ওয়াহিদ আল হাসান, আনিসুল ইসলাম সানি, প্রফেসর মো. আমির হোসেন, আব্দুস সালাম চৌধুরী। কবির সাহিত্যকর্ম নিয়ে আরো বেশি লেখা আসা প্রয়োজন ছিল।

মুহম্মদ নূরুল হুদা, রেজাউদ্দিন স্টালিন, জাকির আবু জাফর, নয়ন আহমেদ, ড. মুহাম্মদ জমির হোসেন, তাজ ইসলাম, নূর আল ইসলামের কবিতা স্মারকটিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে।

সময়ের সেরা ছড়াকারদের ছন্দ ছড়ায়ও মুখরিত হয়েছে স্মারকগ্রন্থের বেশ কিছু পাতা। রচনা করেছেন প্রেম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বোধের অসাধারণ সব পঙক্তিমালা। সকলের নাম উল্লেখ করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দু:খিত। পরিবারের লোকদের স্মৃতিচারণ রেখেছেন সংক্ষিপ্ত পরিসরে, শেষের দিকে। যার ছবি মানুষের হৃদয়ে- তার ছবির এলবাম দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করতে চাননি সম্পাদক জালাল খান ইউসুফী। তাই প্রয়োজনীয় সব লেখায় সাজিয়েছেন গ্রন্থটি। পাঠকের তুমুল আগ্রহের মাঝেই শেষ করেছেন স্মারক। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩৬। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মনিরুজ্জামান পলাশ।

কবি মহিউদ্দিন আকবর ছিলেন একজন সব্যসাচি লেখক একজন মহৎপ্রাণ মানুষ। আল্লাহ তার নেক কর্মকে কবুল করে বেহেস্ত নসিব করুন, আমীন। পুঁথিসম্রাট কবি জালাল খান ইউসুফীকে ধন্যবাদ এমন একটি সাহিত্যমান সমৃদ্ধ স্মারক আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।