তাজ ইসলাম
ড. আশরাফ পিন্টুর বাংলা সাহিত্যের
প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের ছড়া,
কবিতা, গল্প, নাটক বিষয়ের ওপর লেখা বইয়ের নাম বাংলা ‘‘সাহিত্যের বিবিধ রতন’’। তিনি পাঁচটি অধ্যায়ে বইটি বিনস্ত করেছেন। অধ্যায়গুলো হলো : প্রথম অধ্যায়- ছড়াসাহিত্য, দ্বিতীয় অধ্যায়-কাব্যসাহিত্য, তৃতীয় অধ্যায়-কথাসাহিত্য, চতুর্থ অধ্যায়- নাট্যসাহিত্য ও পঞ্চম অধ্যায়Ñবিবিধ।
আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক, এবং সাংবাদিক। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। কবি আল মাহমুদ বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও অনেক গল্প ও ছড়া লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য দুটি ছড়াগ্রন্থের নাম “পাখির কাছে ফুলের কাছে” ও একটি পাখি লেজঝোলা”। তাঁর ছড়ায় ফুটে উঠেছে শিশুমনস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিক। “ ড আশরাফ পিন্টু সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আলোচ্য বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ছড়াসাহিত্যকে। ছড়াসাহিত্যের আলোচনায় বাংলা ভাষার স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের ছড়াসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
আল মাহমুদ প্রসঙ্গের সূচনায় বলেছেন এসব কথা। সংক্ষিপ্ত পরিসরে আল মাহমুদের ছড়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। ছড়ায় আল মাহমুদের শক্তির বিশ্লেষণে তাকে উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক লেখেন,” শুধু বিষয়বস্তু নয়, উপমা-চিত্রকল্পেও আল মামুদের মুন্সিয়ানা লক্ষণীয়। “কবি বল মাহমুদকে আল মামুদও বলা হয়। তবে যতটুকু ধারণা করা যায় এখানে আল মামুদ শব্দটি প্রিন্টমিসটেক। যা অনাকাক্সিক্ষত। আর যদি ইচ্ছাকৃত হয় তবে তা অনভিপ্রেত। কবিতা লিখলে কবি। কবিকে কবিতা লেখক বলাটা শোভনীয় শব্দচয়ন মনে হয় না। আল মাহমুদকে পরিচিত করতে ছোটগল্প লেখক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠকের সচেতন মন এমন শব্দচয়নকে ইতিবাচকভাবে নিতে সংকোচবোধ করে। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। কেবল ছোটগল্পের বেলায় ছোটগল্প লেখক! যুতসই ছিল ছোটগল্পকার শব্দই। ছোটগল্প লেখক শব্দটি নিয়ে পাঠক মন একটু ভাবনা বা দ্বিধায় আচ্ছন্ন হয়।
ছড়াসাহিত্য আলোচনায় আলোকপাত করা হয়েছে ছড়ার আরেক প্রখ্যাতজন ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানের ছড়াকীর্তি নিয়ে।” সাজজাদ হোসাইন খান একজন আধুনিক সমাজসচেতন ছড়াকার। “ড. আশরাফ পিন্টু বিশ্লেষণ করেছেন “ সাজজাদ হোসাইন খানের ছড়া : ইতিহাস ও লোকচেতনা”।
ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইংরেজরা নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার পতন ঘটায়। তারপর দখল করে এ দেশ। চরম জুলুম নির্যাতন চালায় এদেশের কৃষক জনতার উপর। এক সময় বিক্ষুব্ধ হয় জনতা। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে গর্জে উঠেন কালের মহানায়কগণ। তিতুমির তাদের একজন। দ্রোহ করেন তিনি। সাজজাদ হোসাইন খান ইতিহাসের সেইসব দৃশ্যপট চিত্রায়ণ করেন তার ছড়ায়। তিনি তার ছড়ায় লিখেন,”দুর্গ বাঁশের গড়ে/ ভীষণ লড়ে লড়ে/ বীর সে তিতুমির/ গোলাপ হয়ে ঝরে।/ (তিতুমির: নীল সবুজের হাট)।”
সাজজাদ হোসাইন খান এভাবেই তার ছড়ায় ইতিহাস, ইতিহাসের নায়ক, ঘটনা, বিষয়কে উপজীব্য করে লিখে যান ছড়া। তার ছড়ায় থাকে লোকচেতনা। ড. আশরাফ পিন্টু তার প্রবন্ধে তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন।
এ পর্বে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধের শিরোনামÑ ‘‘রবীন্দ্রনাথের ছড়া: লৌকিকতা ও শিশু মনস্তত্ত্ব”। “নজরুলের “ঝিঙেফুল”: লৌকিকতা ও শিশু মানস” শিরোনামে বিবৃত হয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম ও তার ছড়া সাহিত্য। ছড়া সাহিত্যের আলোচনায় আলোচিত হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান, তার ছড়া, ছড়ায় লৌকিকতা ও তার প্রতিবাদীচেতনা। ছড়ায় একুশ, মুক্তিযুদ্ধ ও লিমেরিকের নানা বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন গ্রন্থকার।
বইটি তিনি সাজিয়েছেন মোট পাঁচটি পর্বে। পঞ্চম পর্বে আছে মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে মুসলিম কবি ও শাসকদের অবদান বিষয়ক খুঁটিনাটি বিষয়। আরাকান রাজসভায় বাংলাসাহিত্য। এই পর্বে বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানস না এনে পৃথক পর্বে রাখা যেত। অবশ্য এ পর্বের নাম যেহেতু ‘বিবিধ’ তাই থাকতেই পারে। ড. আশরাফ পিন্টু সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়কে হাজির করেছেন তার পাঠকের সামনে।
রবীন্দ্র সাহিত্যের নানাদিক, বিদ্রোহীচেতনায় ওমর খৈয়াম ও নজরুলের সাদৃশ্যের চিত্রের চিত্রায়ণ, পল্লীকবি জসীম উদদীন’র ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ কাব্যোপন্যাসের লোক-ঐতিহ্যের বয়ান বিশ্লেষিত হয়েছে তার আলোচনায়।
ফররুখ আহমদ, সাত সাগরের মাঝি, কবি ও তার কবিতা, কবিতার রূপকের ব্যবহার, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় প্রতিবাদী চেতনা, কবি বন্দে আলী মিয়ার কবিতা, কবিতায় লোকজ উপাদানের সমাহার সব নিয়েই আলোচনা করেছেন আশরাফ পিন্টু। তার আলোচনায় বিষাদসিন্ধু, ও এই কিতাবের শতবর্ষের পাঠ ও পাঠ মূল্যায়ন, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার জিজ্ঞাসার উত্তর অন্বেষণ করেছেন তিনি।
নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন। তিনি অবহেলিত। কেন সেই মহান সাহিত্যরত্ন আজ অবহেলিত? বিভূতিভূষণের গল্পের বিষয়, বিষয়ের বৈচিত্র্য শাহেদ আলীর গল্প, গল্পের চরিত্রের জীবনালেখ্য,শওকত ওসমান, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সরদার জয়েন উদদীনের গল্প, হুমায়ূন আহমেদ, সিকান্দার আবু জাফরসহ বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার তার আলোচ্য বিষয়। লেখক আশরাফ পিন্টুর আলোচ্য বিষয় বিস্তর, কিন্তু আলোচনার পরিধি সংক্ষিপ্ত। বিষয় অধিক হয়ে গেলে আলোচনা সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অনেক সময় আলোচনা কেবল টাচ বা ¯পর্শ করার মতো হয়। বিস্তারিত বয়ান করে হয়ে ওঠে না। অথচ প্রতিটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা যোগ্য। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বিদগ্ধ পাঠকের মনে এক রকম অতৃপ্তিকে উস্কে দেয়।
“সাত সাগরের মাঝি”Ñ কে ভালো ভাবে বুঝতে হলে, এর রস আস্বাদন করতে হলে এ গ্রন্থের নামকবিতার পরিপূরক কবিতাগুলোও আত্মস্থ করতে হবে। কারণ একক ভাবে’ সাত সাগরের মাঝি’( নামকবিতা) খণ্ডিত, কিন্তু ‘সিন্দাবাদ’, ‘বার দরিয়ায়’, ‘দরিয়ায় শেষরাত্রি’, ‘পাঞ্জেরি’ ইত্যাদি কবিতা মিলেই পূর্ণাঙ্গ ‘সাত সাগরের মাঝি’। এইভাবে পাঠ ও পাঠকের যোগসূত্র, পাঠের পূর্ণতার দিক নির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হন লেখক। লেখক ও কবির আশাবাদ একীভূত হয়। এবং আশাবাদ ব্যক্ত হয়, “ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশি রাতের মখমল অবসাদ/নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ। (সিন্দাবাদ)”।
আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় সবচেয়ে বেশি কাব্যরচনা করেন মহাকবি আলাওল। আলাওলের মৃত্যুর পরও সে ধারা অব্যাহত থাকলেও তার মতো উৎকৃষ্ট কাব্য কেউ রচনা করতে পারেনি। এদের মধ্যে আবদুল করিম খন্দকার নামে একজন কবির নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘দুল্লা মজলিস’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। ‘এসব অজানা তথ্য বা বিস্মৃত তথ্য পুনঃপাঠের জন্য অতীব জরুরি ড. আশরাফ পিন্টুর এই বইটি। আশরাফ পিন্টুর বইয়ের নাম “বাংলা সাহিত্যের বিবিধ রতন”। বইখানা জলকথা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০২১ বিজয়ী। গ্রন্থিত সবগুলো প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে দেশের প্রথম শ্রেণীর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত। কালজয়ী সব সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের নিয়ে লেখা এসব প্রবন্ধ সাহিত্য বোদ্ধাদের জন্য পাঠ করা অবশ্যই জরুরি। বইটির বহুল প্রচার হোক, এ আশা সকলের।
বাংলা সাহিত্যের বিবিধ রতন
লেখক : ড. আশরাফ পিন্টু
প্রকাশনী : জলকথা
প্রচ্ছদ : আসাদ জোবায়ের
প্রকাশকাল : মার্চ, ২০২১
পৃষ্ঠা : ১২৮, মূল্য : ২৩০ টাকা।