কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি-লেখক। সাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা, দ্রোহ-বিদ্রোহ প্রতিবাদ নিয়ে আসার কাজটি তিনি করতে পেরেছেন। তিনি মনুষ্যত্বের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছেন। কালের বিচারে দেখতে পাওয়া যায় তার এ কাজ এ সংগ্রাম ও বিদ্রোহ বৃথা যায়নি। তার ফল এ মাটিতেই ফলেছে। যে কোন বিচারে তিনি যুগান্তকারী একজন মহান লেখক ও সাধক। নজরুল কবি হিসাবেই আমাদের কাছে সমধিক খ্যাত।
বড় কবিরা শুধু কবিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি সাহিত্যের আন্যান্য শাখায়ও তারা পদচারণা করেছেন। কবি নজরুল ইসলামও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় বিচরণ করেছেন। নজরুলের এসব রচনাবলীর মাঝে আছে- গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কথিকা, সম্পাদকীয়, পত্র-সাহিত্য ও অভিভাষণ। গবেষকদের মতে কবি নজরুলের কবিতা ও গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি সংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় সমান। নজরুলের ৪২ টি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি ৪১ টি গদ্যগ্রন্থ রয়েছে।
অনেক কথাসাহিত্যিক কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু পরে হয়েছেন নামকরা কথাসাহিত্যিক। নজরুলের জীবনেও এ রকমটা দেখা যায়। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শুরু করেন গদ্য দিয়ে। নজরুলের প্রথম দিককার কবিতার চেয়ে গল্প বেশি জনপ্রিয় ছিল। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে মে মাসের ‘সওগাত পত্রিকায় ছাপা হয়।
২. উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার সুষ্পষ্ট কিছু না বলে একটি কমপ্লেক্স বাক্য বলেছেন। তিনি বলেন, the novel as an “invented prose narrative of considerable length and a certain complexity” উপন্যাস “যথেষ্ট দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট জটিলতার উদ্ভাবিত গদ্য আখ্যান”। খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলফ এবং জেমস জয়েস উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেননি। ভার্জিনিয়া উলফ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী আধুনিকতাবাদী লেখকদের একজন। ভার্জিনিয়া উপন্যাসকে “সকল ফর্মের মধ্যে সবচেয়ে নমনীয়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। Virginia Woolf did not explicitly provide a single, definitive definition of a novel. emphasizing its flexibility and ability to transcend conventional structures. She described the novel as “this most pliable of all forms,” James Joyce didn’t provide a formal definition of a novel, but his work and critical essays offer insights into his understanding of the form সবার ভাবনাতেই একটা কথা পরিষ্কার। আর তা হচ্ছে তারা ফ্রেক্সিবিলিটি ও প্রথাগত কাঠামো ভেঙ্গে ফেলার উপর জোর দিয়েছেন।
প্রথার বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষায় যারা উপন্যাস লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম তাদের মধ্যে একজন। তিনি কবি এবং সঙ্গীতসাধক ও সুরকার হিসেবে যতটা আলোচিত প্রশংসিত উপন্যাসিক হিসেবে ততটা পাননি। তার কথাসাহিত্য নিয়ে গবেষণা আলোচনা সমালোচনা পর্যাপ্ত নয়। এগুলো নিয়ে আরো গবেষণার অবকাশ রয়েছে।
৩. কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি মাত্র উপন্যাস রয়েছে। এসব উপন্যাস প্রথাগত উপন্যাস না হয়ে হয়ে উঠেছে নজরুলের নিজস্ব ধারার উপন্যাস। তিনি যখন উপন্যাস লেখেন তখন উপন্যাসের ক্ষেত্রে অনেক বিবর্তন হয়েছে। জাতীয় জীবনের অনেক কথা কবিতায় বলার পর নজরুল উপন্যাসেও কিছু বলার চেষ্টা করেন। এসব উপন্যাসে আমরা বিভিন্ন চরিত্রের আবরণে নজরুলের জীবনচিত্রই পাই। আধুনিক উপন্যাস মানেই আত্মজৈবনিক। সে নিরিখে এসব উপন্যাসে সে জীবনার্থ পাওয়া যায় তা উপন্যাসকারের জীবনার্থ। যা হয়ে ওঠে ইতিহাসনিষ্ঠ।
নজরুলের শেষ জীবন কেটেছে বাংলাদেশে আর মৃত্যুও এখানেই। তার মনের আকুতির সাথে মিলিয়ে মসজিদেরই পাশে তাকে কবর দেয়া হয়েছে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। সমালোচকরা বলেন, নজরুলের সাম্যবাদ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রকাশ উপন্যাসগুলোর বিভিন্ন চরিত্রের মাঝেও দেখা যায়। তাঁর চিন্তাধারার রিয়ার্সেল-গ্রাউন্ড তাঁর কথাসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কথাসাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি।’’
তারা আরো বলেন, কথাসাহিত্য নজরুল প্রতিভার বিশিষ্ট অবদান বিভিন্ন সংস্কৃতি-সমন্বয়ের সাধনা। উপন্যাসগুলোর কাহিনী ও চরিত্র নির্মাণে তিনি যে দার্শনিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, তা বৃহত্তর মানবজীবনকে উন্মুক্ত আকাশ পানে টেনে নিয়ে যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখতে কলম ধরেছেন। তার প্রমাণ সৃষ্টিশীল তিনটি উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’। সমালোচকরা আরো বলেন, নজরুলের তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র ‘বাঁধনহারা’র নুরুল হুদা, ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’র আনসার নজরুলের প্রতিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে যেন।
নজরুল চরিত্রের যে রোমান্টিকতা-স্বদেশিকতা-মানবতাবোধ রয়েছে তা এই তিনটি চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। সে কথা আগেই বলেছি।
৪. ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস নজরুলের অনবদ্য সৃষ্টি। এই উপন্যাসে যে সমাজবাস্তবতা ফুটে উঠেছে কালিক বিচারে তার মূল্য অনেক। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় “কুহেলিকা” উপন্যাসের প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। তার কিছুদিন পর নওরোজ বন্ধ হয়ে গেলে সওগাত পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। দেখা যাচ্ছে ৯৪ বছর আগে এটি প্রকাশিত হয়েছে। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও মতবাদ প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করেন সমালোচকরা। বিপ্লবী যুবক জাহাঙ্গীর চরিত্র দিয়ে সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতির সফল প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের রূপরেখা সমসাময়িক হলেও লেখক কাহিনী পরিচর্যা করেছেন নিজের মতো করে। এতে ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও প্রাণের স্পর্শের পাশাপাশি মিথ-কথনের প্রয়াস রয়েছে।
রাজনৈতিক উপন্যাসে আঙ্গিকগত দুর্বলতা থেকে যায়। কিন্তু কিছু চরিত্র এবং সামাজিক অবস্থান যেভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়-তার কিছু না কিছু মূল্য তো রয়েছেই। সেই নিরিখে এগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে।
কুহেলিকা উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটা রোমান্টিক গল্প পাওয়া যায়। উপন্যাসের কাহিনী একজন বিপ্লবীকে ঘিরে। তরুণ কবি হারুনের মেসে তার রচিত ‘নারী কুহেলিকা’ কবিতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাহাঙ্গীর একজন বিপ্লবী স্বদেশী দলের কর্মী। নারী সম্পর্কে তার ধারণা নেতিবাচক। সে মনে করে নারীরা মায়াবিনীর জাত। তারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পেতে রেখেছে। ফলে নারীরা গহণ পথের কণ্টক, রাজপথের দস্যু। উপন্যাসে প্রধান চরিত্র জাহাঙ্গীর ও তাহমিনা। শান্ত চুপচাপ একজন ছেলে থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীর। তাঁর ভালো লাগে আরেক বিপ্লবী তাহমিনাকে। বিপ্লবীদের জীবনেও প্রেম আসে এখানে তা প্রতিফলিত। দুজনের বিয়েও ঠিক হয়। কিন্তু তখনই তৃতীয় চরিত্র হিসেবে আসে চম্পা। উপন্যাসের শেষ অংশে তাঁর উপস্থিতি গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের ভাগ্যে কারাবরণ ঘটে। পুরো উপন্যাসে তাঁর জীবনে নানা টানাপোড়েন পরিলক্ষিত হয়।
চরিত্রগুলো হলো-জাহাঙ্গীর - বিপ্লবী স্বদেশী দলের কর্মী, হারুন - তরুণ কবি, প্রমত্ত - হিন্দু বিপ্লবী, চম্পা, তাহমিনা (ভুণী), ফিরদৌস বেগম। উপন্যাসের সূচনাটি বেশ আকর্ষণীয়। এভাবে শুরু-
নারী লইয়া আলোচনা চলিতেছিল। তরুণ কবি হারুণ তাহার হরিণ-চোখ তুলিয়া কপোত-কূজনের মতো মিষ্টি করিয়া বলিল, ‘নারী কুহেলিকা। যেস্থানে আলোচনা চলিতেছিল, তাহা আসলে ‘মেস’ হইলেও, হইয়া দাঁড়াইয়াছে একটি পরোমাত্রায় আড্ডা। [ কুহেলিকা, পৃষ্ঠা-১]
বিপুল কবিখ্যাতির কারণে নজরুলের লেখা উপন্যাসগুলো বহুল পঠিত হয়। আজও পঠিত হচ্ছে। ১৯২৭ সালে বের হয় বাঁধনহারা, ১৯৩০ সালে মৃত্যুক্ষুধা আর কুহেলিকা বের হয় তার পরের বছর।
বিশেষ করে তার ‘কুহেলিকা’ এখনো পাঠকের অধিক আগ্রহের বিষয়। এ উপন্যাসটি ‘বিপ্লবী উপন্যাস’ও বলেছেন অনেক সমালোচক।
নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের পথের দাবী-র প্রভাব লক্ষ্য করেছেন সমালোচকেরা। তারা বলেন, ‘কুহেলিকা’র চরিত্রের সঙ্গে পথের দাবীর সব্যসাচীর চরিত্রের মিল স্পষ্ট। প্রমত্ত চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে নজরুলের স্কুল-শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটকের প্রভাব রয়েছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘সিয়ারসোল স্কুলে পড়ার সময় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক বিপ্লববাদে নজরুলকে প্রভাবিত করেন। পরবর্তী জীবনে বিপ্লববাদীদের প্রতি নজরুলের যে আকর্ষণ তার সূত্রপাত এখান থেকেই। নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিপ্লবী স্কুল শিক্ষক প্রমত্ত চরিত্রে নিবারণ চন্দ্র ঘটকের ছায়া পড়েছে।’’
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহাঙ্গীর একজন বিপ্লববাদী। আগেই উল্লেখ করেছি জাহাঙ্গীরের গুরু প্রমত্তের মাঝে অনেক গবেষক নজরুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটকের ছায়া দেখার কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ বারীন্দ্র ঘোষের কথাও উল্লেখ করেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র সব্যসাচীর সাথে প্রমত্তের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে।
নজরুল সাহিত্যে বাস্তব থেকে অনেক চরিত্র পরিগ্রহণ করেছেন। কবিতা-উপন্যাস সকল ক্ষেত্রেই। ‘কুহেলিকা’র ক্ষেত্রে প্রমত্ত চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে নজরুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটক, বারীন্দ্র ঘোষ এবং শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সব্যসাচী প্রসঙ্গ আসে। সব্যসাচী চরিত্রটিও বাস্তব থেকে শরৎচন্দ্র গ্রহণ করেছেন।
৫. নজরুলের উপন্যাসের চরিত্রগুলো, কুহেলিকার সবগুলো চরিত্র সেই সময়ের সমাজচিত্র ধারণ করে, গড়ে ওঠে একেকজন রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে। এতে করে শত বছর আগেকার সমাজবাস্তবতা ধরা দেয় পাঠকের সামনে। এর সাহিত্যিক মূল্য যেমন আছে তেমন এর ঐতিহাসিক মূল্যও কম নয়। তার কথাসাহিত্য পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে একটি কাল, একটি সময় পাঠকের সামনে পরিস্ফুট হয়। এর মূল্য অপরিসীম।
তবে কথাসাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের সৃষ্টিগুলো ভালো অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে এমনটা বলা যাবে না। এ বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনা গবেষণা কম, সে কথা আগেও বলেছি। অনার্স মাস্টার্সেও নজরুলের সাহিত্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পড়ানো হয় না বলে অভিযোগ। ফলে অনেক দিক অনালোচিত থেকে গেছে। তার উপন্যাসগুলো নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।