DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

বই

ধ্যানমগ্ন পৃথিবীর কবিতা

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বাংলাভাষী বাঙালির পরিচয় তার ভাষাগত সচেতনতা বোধ, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চৈতন্য ও স্বাধীনতার মহান সংগ্রামে সত্য- প্রেম-পবিত্রতার জারক রসে জারিত বাঙালির জীবন সাধনারই ত্রয়ীভাব কেন্দ্রের মৌলপ্রেরণাজল যা

Printed Edition
dsfsd

ড. উৎপল তালুকদার

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বাংলাভাষী বাঙালির পরিচয় তার ভাষাগত সচেতনতা বোধ, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চৈতন্য ও স্বাধীনতার মহান সংগ্রামে সত্য- প্রেম-পবিত্রতার জারক রসে জারিত বাঙালির জীবন সাধনারই ত্রয়ীভাব কেন্দ্রের মৌলপ্রেরণাজল যা বাঙালি সমাজের আত্মমননের, আত্মপ্রকাশের এবং আত্মবিকাশের আন্তরিক সাধনা। অহংকার করার মতো বাঙালির আছে অনেক কিছু কিন্তু উদারনৈতিক বাঙালি মনন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতো বলেই বার বার প্রতারিত হয়েছে দাঁতাল আর্য আর রয়েল আর্যদের খপ্পরে পড়ে। ফলে আর্যসেন, রয়েল লর্ড এবং আশরাফ শ্রেণির দ্বারা বারবার নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়ে সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। হারিয়েছে ভাষাভাব, সাহিত্যবোধ এবং প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বাধীনতার চৈতন্য প্রাণ। বাঙালির ইতিহাসে এই ট্রাজেডির যেনো শেষ নেই। কেবলই ফিরে ফিরে আসে আর হত্যা করে বাংলা ভাষীর মন-প্রাণ-বোধ। বারবার গুম করা হয়েছে বাঙালির ভাষা-সাহিত্য আর স্বাধীনতাবোধ। মজলুম বাঙ্গালি তবু ভেঙে পড়েনি, নিঃশেষ হয়ে যায়নি বরং দ্রোহী কোন মুখো তাদের দাঁড়াতে দেখেই পালাতে বাধ্য হয়েছে লক্ষণ সেন-ক্লাইভ-ব্যাটেন ও শেখ হাসিনা। নেতানিয়াহুর রোল মডেল বড় আপা হয়েও হাসিনা আজ দেশ ছাড়া।

০২. রাজনৈতিক সংস্কৃতির রোল মডেলগণ সব সময়ই জনমানব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক মহাপ্রতাপময় আলিশান পৃথিবী সাজিয়ে নেয়। ফলে তারা যখন তাদের রচিত স্বর্গে বিমুগ্ধ বিমুঢ় জীবনযাপন করে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে স্বৈরাচারী ইবলিশ হয়ে ওঠে। এ জাতীয় স্বৈরাচারী ইবলিশগণ আজ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কারণ বন্দুকের নল নয় মানুষই ক্ষমতার আধার; মানুষই শেষ পর্যন্ত ধ্যানমগ্ন পৃথিবীর গড়তে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়, প্রাণ ঢেলে দেয়, স্বৈরাচারীর ঔদ্ধত বুলেটের মুখে। কিন্তু স্বপ্নহারা হয় না কখনও। স্বপ্নই মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখে, পথ দেখায় আলোকিত সুন্দরের দিকে, আর তখনই খুলে যায় সম্ভাবনার সোনালি দুয়ার। এই মহাসত্য সৃজনশীল মানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝতে চায় না। উপলব্ধি করতে চায় না যে আমরা প্রতিশ্রুত সত্যের কাছে, সাহিত্যের কাছে এবং জীবনের কাছে। হারুন আল রাশিদ এই প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখেই সাহিত্য জীবনকে আর রাঙিয়ে চলেছে জীবন সত্যের আলোকে, আসলে যারা জীবন সত্যের প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখে জীবনকে রাঙায় তাদেরকে পালাতে হয় না রুদ্ররোষে, জন-মানুষের ক্ষোভের আগুনেও পড়তে হয় না কখনও। তবুও বিজয়রাজগণ অতি ইতিহাস লিখে লিখে তার ভাড়েই নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষার কথা ভুলেও মনে রাখেনা। সৃজনশীল নিরীহ সাহিত্যিক কবিগণ ইতিহাসের পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে বসে থাকে স্বপ্নপাড়ায়।

০৩. হারুন আল রাশিদও মূলত একজন সৃজনশীল স্বপ্নদ্রষ্টা ছড়া শিল্পী। শুধু ছড়াকার নয় বরং আরো একটু বেশি যাকে ছড়ার তথাকথিত সীমানা পেরিয়ে যায় অবলীলায় এবং অন্য একমাত্রা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় স্বমহিমায় শিল্পের নন্দন কাননে। মূলত এখানেই হারুনের ছড়ার মুন্সিয়ানা; এখানেই ওর ছড়া অন্যদের ছড়া সমগ্র থেকে ভিন্নতর। ওর ছড়া বইয়ের নামগুলোও অন্য এক দ্যোতনার পরিচায়ক বলেই মনে হয়। যেমন - ক. মুদ্রাদোষ -১৯৯৯, খ. একলা পাখি - ২০০১, গ. দুঃখ করো না কান্না করো না মেয়ে -২০১৯, ঘ. পানির ভিতর বাংলাদেশের গন্ধ লেগে আছে -২০২০ ইত্যাদি। সারা কবিতার ক্ষেত্রে ওর যেমন সুনাম সুখ্যাতি তেমনি প্রথম গদ্য কবিতার বই হিসেবে ধ্যানমগ্ন বিকল্প পৃথিবীও বোদ্ধা সমালোচকদের সুনজরকে সঙ্গে নিয়ে পাঠক পাঠিকাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছে বলেই আমাদের বিশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছে। এই বক্তব্যে কোন প্রকার নাটকীয়তা নেই। নেই কোন দ্বিধা- সংকোচ। এ কথা দায়িত্ব নিয়েই বলা যায় যে সাহিত্য সাধনার বন্ধুর পথে বকের মত মনোনিবেশে হারুনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। কোন ক্লান্তি, কোন পিছু ডাক ওকে দাবায় রাখতে পারেনি আজও। যদিও দেশ থেকে দেশান্তরে চলমান আজ মহাক্রান্তিকাল।

০৪. ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ- সংস্কৃতি, আঞ্চলিক- আন্তর্জাতিক মনে ও মননে সক্রিয় এখন মহা ক্রান্তিকাল। এই বিবস্ত্র মহাসংকট উত্তরণে নিরীহ একজন কবি হিসেবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে হারানো উপস্থাপন করেছে ধ্যানমগ্ন বিকল্প পৃথিবী। গদ্য কবিতাময় এই বিকল্প পৃথিবীর মধ্যে পাবেন ৭০টি কবিতা যা পাঠ করার পর বোধের বারান্দায় রোদের উষ্ণতা পাবেন পাঠক পাঠিকা। বইটি প্রকাশ করেছে সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থা এবং চোখ জুড়ানো প্রচ্ছদ এঁকেছেন ফরিদী নুমান, যদিও প্রচ্ছদ ফ্লাপে শিল্পীর নাম ছাপা হয়েছে মাসুম বিল্লাহ। মূলত সামাজিক ক্রান্তিকালের ছাপ এখানেও দেখা যায় - যা অমার্জনীয়। বিষয়টির প্রতি প্রকাশনা সংস্থার আরও একটু সতর্কতার দাবি রাখে। এজাতীয় অসতর্কতার কারণ এই দেশে, সমাজে, ধর্ম-সংস্কৃতিতে বিষাক্ত ছোবল থেকেই যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে কবি উচ্চারণ করেন-

ক. আমাদের আহ্বান ছিল -

প্রতিটি মহাদেশে

পর্যায়ক্রমে সভ্যতার পর্দা উন্মোচন।

(ধ্যানমগ্ন বিকল্প পৃথিবী , পৃষ্ঠা ০৭)

খ. আলোর ধারালো ব্লেড

কাটবে আঁধার

রাত হবে সবগুলো -

ভরা পূর্ণিমা।

( আলোর ধারালো ব্লেড, পৃষ্ঠা- ১৯)

গ.শুধু উপাদানগুলো চাই

নিরেট প্রেমস্নাত

নতুন রোদের নির্যাস।

(নতুন রোধের নির্যাস, পৃষ্ঠা- ২১)

০৫. বারুদ পোড়া পৃথিবীতে মানুষকে স্বপ্নহারা - আলোহারা করার ষড়যন্ত্র জায়মান। বোমা রাজ, বিষগ্যাস সম্রাটরাই আজ গণতন্ত্রের রোল-মডেল। তথাকথিত মিডিয়া ও নষ্টদের প্রতাপের কাছে নতজানু প্রায়। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, কাঁদে মানবতা। পৃথিবীর দেশে দেশে চলমান প্রতাপ বিস্তারের বেআব্রু লড়াই, সৌরমণ্ডলেও এ লড়াই থেকে মুক্তি পাচ্ছে না যখন, তখন একজন সবুজ হৃদয়ের কবি নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারেনা। প্রকৃতিপ্রেমিক, প্রাণীকুলপ্রমিক কবির কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে অক্ষরের বারুদ।

ক. পরাক্রমশালী একশ পৃথিবীর সম্রাট

শিখানে - পৈথানে দৃশ্যহীন পাহারাদার

থোরাই-কেয়ার প্রতিবেশী যুদ্ধের দামামা।

(হিমালয় অস্তিত্ব, পৃষ্ঠা-২৩)

খ. বিকল্প রোদ ছড়িয়ে দিলাম

কেটে যাক তামাটে মনোভাব

বর্ধিত সময় উপহার দেবে

পুষ্পিত আনন্দ।

(জনম নিদ্রিত হোক, পৃষ্ঠা ২৫)

গ. সময়ের সিঁড়িতে বসে

উচ্ছলে বাজিয়ে যাব -

রোদের বেহালা।

(রোদের বেহালা, পৃষ্ঠা- ২৪)

০৬. কবি হারুন আল রাশিদ এর পোয়েটিক ডিকশন বিশ্লেষণ করলেই তার কাব্য সুষমা উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়। কবির ব্যবহৃত শব্দ ভাণ্ডার পাঠিকা-পাঠক বুঝে নেন নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে। সমালোচক তার বিদগ্ধ বিমুগ্ধতা নিয়েই বিশ্লেষিত করেন কবি ও কবিতা। উল্লেখ্য যে, কবি আল মাহমুদ এক বক্তৃতায় বলেন, আধুনিক কবিতা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে-জানতে হবে কবিকে। অর্থাৎ কবিকে না বুঝতে পারলে তাঁর কবিতা উপলব্ধি করা সহজ হবে না। কবি হারুনকেও একটু একটু করে বুঝতে গিয়ে যা বুঝেছি, তা হলো-মৌলিক সূত্রে বা কেন্দ্রীয় চিন্তায় অসামঞ্জস্য রয়েছে। তা না হলে বিকল্প পৃথিবীর ধ্যান তিনি করতেন না অর্থাৎ তিনি যে পৃথিবী বিনির্মাণের স্বপ্ন লালন করেন সেটাই তো আসল পৃথিবী। বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আলোকিত-আলোচিত এবং আলোড়িত এই কবির প্রতি সবিনয় প্রার্থনা থাকলো। কারণ তিনি তার কবিতায় বলেন, “জেগে থাকো শৈল্পিক ফর্মুলা “ (জনম নিদ্রিত হোক, পৃষ্ঠা -২৫)। এই শিল্পিত ফর্মুলা যিনি দিতে পারেন, যিনি বেহায়া আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেই, তার কাছে আমাদের প্রত্যাশাও কম নয়। নগ্নতা ছেড়ে, বারুদের ব্যভিচার ছেড়ে, রোল মডেল তকমা ছেড়ে মানুষের কাতারে এসে প্রেমিক মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্ন কবির মতো আমরাও লালন করি। আমরাও সুখ-শান্তি আর প্রশান্তিময় সবুজ পৃথিবীর জন্য ধ্যানমগ্ন সংগ্রামরত। বিপ্লবীর স্বপ্ন নিঃশেষ হবার নয়। কবি হারুন আল রাশিদ এর ধ্যানমগ্ন পৃথিবীও বরবাদ হবে না নেতানিয়াহু কিংবা হাসিনা সেনদের কারসাজিতে।

মোদি-ট্রামদের ষড়যন্ত্রও চলবে কিন্তু আমাদের প্রহরিযৌবনও সজাগ আছে থাকবেও অটল। কারণ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জাগিয়ে রাখার তারুণ্য এখনও সজাগ। তারা এখন চেতনার ঘরে ধ্যানমগ্ন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে টগবগ করে ফুটছে। কবি হারুনের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, দেখে নিও, পৃথিবী আস্থাভাজন হবে স্বমহিমায় (অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণে, পৃষ্ঠা- ৭৭)। ধন্যবাদ কবি হারুন আল রাশিদ জয়যুক্ত সফল হোক ধ্যানমগ্ন পৃথিবী’র।