আহমেদ খায়ের
চব্বিশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনের শুধু নয়, সুদীর্ঘ তিপ্পান্ন বছরের ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন অবসানের দ্বার উন্মোচন হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র জনতার সাথে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ধর্ম, বর্ণ, বয়স, জাত-পাত, মতাদর্শ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে এসেছিলো। শহরের অলিগলি থেকে গ্রামের প্রতিটি আনাচে কানাচে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ঢাকা টু চট্টগ্রাম রোডের কিছু স্পট যেমন- যাত্রাবাড়ী-কাজলা-শনিরআখড়া, সাইনবোর্ড-মাদরাসারোড এবং চিটাগাংরোড-কাঁচপুর বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানকার আন্দোলনও ছিলো উল্লেখযোগ্য।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের পরও যাত্রাবাড়ী থানা থেকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র (সম্ভবত এসএমজি সহ অন্যান্য অস্ত্র) মুহুর্মুহু গুলী ছোড়া হয়। আমি আন্দোলনে দেখেছি গুলীতে নিহত রক্তাক্ত কিশোর-যুবকদের নিথর দেহগুলো ভ্যানে করে নিয়ে যেতে, রাস্তায় রক্তের ধারা বয়ে যেতে। যাত্রাবাড়ীর দখল নিতে মাগরিব গড়িয়ে যায়। জুলাই আন্দোলন, বিশেষত এ অঞ্চলের তৎপরতার উপর একটা পান্ডুলিপি দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছিলো আমার। ব্যস্ততার কারণে গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। ইতোমধ্যে একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫ চলে এলো। শেষ দিন একটু মেলায় উঁকি দিতে গেলাম। সন্ধ্যার দিকে আইসিএস পাবলিকেশনের প্যাভিলিয়নের সামনে হঠাৎ অনেকদিন পর আজিজ হাকিম ভাইয়ের সাথে দেখা। বেশ কিছুদিন একসাথে শীতলক্ষ্যা সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের সাথে কাজ করেছি আমরা। হালকা গড়ন কিন্তু দীর্ঘদেহী কৃষ্ণ বর্ণের এ বন্ধু পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছেন। তার গীতি ও ছড়া নির্মাণের হাত ভালো, চলচ্চিত্র নির্মাণেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। কিশোর চলচ্চিত্র পাতার বাঁশি, মহামায়া সহ বেশ কয়েকটি নির্মাণ তার হাতে হয়েছে। আমি সেগুলো দেখেছি এবং একজন তরুণ নির্মাতার হাতের প্রশংসা করেছি। সাম্প্রতিক ফেসবুকে তার একটি বইয়ের প্রচারণা ভাসছে- “কাজলা ওভারব্রিজ” শিরোনামে। আমার জানামতে এ পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী-কাজলা অঞ্চলের আন্দোলন নিয়ে এটা প্রথম কোন উপন্যাস।
আমার হাত ধরে টেনে নিলেন একটা স্টলের সামনে। একটা বই নিয়ে মোড়ক উল্টে ঘচাঘচ কিছু লিখলেন ক্যালিগ্রাফিক স্টাইলে।
তারপর হাতে একটা কাজলা ধরিয়ে দিলেন, মানে ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো সেই বই।
আমার বর্তমান নিবাস সাইনবোর্ড। যেতে যেতে বাসে বইটা প্রায় এক তৃতীয়াংশ পড়ে ফেললাম।
বাকিটা পরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শেষ করেছি।
বিপ্লবের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় একটা উপন্যাস লেখা হয়ে প্রকাশনীর গলিঘিঞ্জি পার হয়ে জাতীয় গ্রন্থমেলার আঙিনা হেঁটে এখন সে বই পাঠকের মগজে পৌঁছে গেছে। খুব দ্রুত সময়ে হলেও বইটা কিন্তু মন্দ হয়নি। অবশ্য পড়া শেষে মনে হয়েছে যদি লেখক আরো সময় নিতেন বইটা আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, সমকালীন রাজনীতি, আর্থ সামাজিক অবস্থা, ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ আরো পষ্ট হতে পারতো। তাছাড়া আন্দোলন চলাকালীন যাত্রাবাড়ী-কাজলার আরো কিছু চুম্বক ঘটনা আছে সেগুলোও আসতে পারতো। কথাসাহিত্যে এর আগে তার কোন সম্পৃক্ততা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে বইটি পড়ে মনে হয়েছে এ শাখায় তার আগে থেকে বিচরণ আছে। গল্পের কিছু কিছু জায়গায় পাঠকের মনে দাগ কাটার মতো সিন আছে। সিন বলছি এজন্য যে, গল্প বা উপন্যাস পড়ার সময় পাঠকের কল্পনার জগতে ধারাবাহিক চিত্রকল্প তৈরি হয়, যা একটা মুভির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী বলে আমার মনে হয়। মুভিতে পরিচালক কিছু চরিত্র নির্ধারণ করেন, যা দর্শকদের পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু কল্পনার স্বাধীনতা আছে, পাঠক নিজের মতো করে চরিত্রগুলো তার মানসপটে এঁকে নিতে পারেন।
গল্পটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন যুবকের। (সম্ভবত) লেখক নিজেকেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে তুলে ধরেছেন। কীভাবে ভয়-আতঙ্ক এবং নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে একটি যুবক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
কী কী ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আন্দোলনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। শিশু-কিশোর, নারীসহ সব ধরনের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। পুলিশের আগ্রাসন, সেনাবাহিনীর ভূমিকা। আন্দোলনের স্পটের ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি মোটামুটি উঠে এসেছে তার গল্পে।
যারা সরাসরি আন্দোলন দেখেননি তারা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন। আর যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন তাদের কাছে মনে হবে যেনো নিজের গল্পই নিজে পড়ছেন।
আমি এ বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। বইপ্রেমীদের বইটি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে।