নোমান সাদিক
কুরআনুল কারিম মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এটি শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য আলোকবর্তিকা। কুরআনের বিভিন্ন সূরা মুসলমানদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এর মধ্যে ‘আমপারা’ অংশটি সবচেয়ে বেশি পঠিত ও মুখস্থ হয়ে থাকে। নামাযে সবচেয়ে বেশি তেলাওয়াত হয় আমপারার সূরাগুলো। ছোট ছোট সূরার মধ্যে গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে আছে, যা একাধারে সহজবোধ্য আবার গভীরতাওপূর্ণ। এই অংশটিকে সহজভাবে মানুষকে বুঝিয়ে তোলার জন্য অনেকেই কাব্যানুবাদের আশ্রয় নিয়েছেন।
কাব্যানুবাদ বলতে বুঝায় মূল গ্রন্থের ভাব ও মর্মার্থ বজায় রেখে কবিতার রূপে অনুবাদ করা। কুরআনের মতো পবিত্র, অলঙ্ঘনীয়, ও গভীর ভাবসম্পন্ন একটি গ্রন্থের কাব্যানুবাদ নিঃসন্দেহে খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ। এতে যেমন কাব্যিক সৌন্দর্য থাকতে হয়, তেমনই থাকতে হয় ভাবগম্ভীরতা ও যথার্থতা। কাব্যিক আনন্দে মূল বার্তা হারিয়ে গেলে সেটি অনুবাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।বাংলা ভাষায় কুরআনের কাব্যানুবাদের ইতিহাস বেশ পুরনো। অনেকেই চেষ্টা করেছেন কুরআনের ভাব ও ভাষাকে ছন্দবদ্ধ রূপে প্রকাশ করতে। তবে আমপারার কাব্যানুবাদ বললে প্রথমেই আসে কাজী নজরুল ইসলামের কথা। তিনি তাঁর অসাধারণ কবিত্বের মাধ্যমে আমপারাকে ছন্দে রূপ দিয়েছেন। তাঁর ভাষা আবেগময়, ভাবপূর্ণ এবং কাব্যিকভাবে সমৃদ্ধ। তবে তাঁর কাব্যানুবাদ অনেক সময় সরল বোধগম্যতার চাইতে শিল্পগুণে পরিপূর্ণ, যা সাধারণ পাঠকের জন্য কিছুটা কঠিন হতে পারে।
এই জায়গাতেই হাসান আলিম-এর কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি কুরআনের কাব্যানুবাদ করেছেন সহজ ভাষায়, সাবলীল ভঙ্গিতে এবং সর্বোপরি যথার্থতা বজায় রেখে। তাঁর কাব্যানুবাদে নেই অতিরিক্ত অলংকার, নেই জটিল শব্দ বা বিমূর্ত ভাব। তিনি চেষ্টা করেছেন যাতে সাধারণ মানুষ অনায়াসে বুঝতে পারে কুরআনের বক্তব্য কী, আল্লাহ কী বোঝাতে চাচ্ছেন।
হাসান আলিম-এর অনুবাদে একটি বিশেষ দিক হলো তিনি ভাবার্থের সঙ্গে আপস করেননি। অনেক সময় দেখা যায়, কবিতা করার জন্য অনুবাদকরা ভাবের সঙ্গে খেলা করেন, ছন্দে মেলাতে গিয়ে মূল বক্তব্যের বিকৃতি ঘটে। কিন্তু হাসান আলিম সে পথে হাঁটেননি। তাঁর কাব্যানুবাদে ছন্দ ও ভাব দুটোই মিলে যায় এমনভাবে, যেন আলাদা করে কিছু যোগ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ধরা যাক একটি উদাহরণ
সূরা কাওসার:
> “আমি তোমায় দিয়েছি কাওসার নদী,
তাই তুমি নামায পড়ো তোমার প্রতিপালকের জন্য নিরবধি।
আর কোরবান দাও তাঁরই নামে।
তোমার শত্রু হবে নিশ্চিহ্ন, নিশ্চুপ।”
এই অনুবাদে দেখা যায়, অত্যন্ত সহজ এবং সরাসরি ভাষায় সূরাটির মূল মর্মার্থ প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে শব্দচয়ন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে একজন সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারে কী বলা হচ্ছে। অথচ এর মধ্যে কাব্যধর্মিতা বজায় রয়েছে।
হাসান আলীমের অনুবাদে রয়েছে শুদ্ধ উচ্চারণ, ছন্দের সুর এবং তাফসিরভিত্তিক বিশ্লেষণের ছাপ। তিনি শুধু কবিতার মতো ছন্দে শব্দ বসাননি, বরং প্রতিটি লাইনে কুরআনের ব্যাখ্যার দিকটিও মাথায় রেখেছেন। এজন্যই তাঁর কাব্যানুবাদ কেবল সাহিত্য নয়, একইসঙ্গে তা দ্বীনি শিক্ষার মাধ্যমও।
কাব্যানুবাদের বড় একটা চ্যালেঞ্জ হলো—কিভাবে ধর্মীয় পবিত্রতা বজায় রেখে সাহিত্যের রূপ দেওয়া যায়। কারণ কুরআন কোনো সাধারণ সাহিত্য নয়। এটি আল্লাহর বাণী। এই বাণীকে সাহিত্যে রূপান্তরের সময় ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা, বিশুদ্ধতা, ব্যাখ্যাগত সতর্কতা সব কিছুর প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। হাসান আলীম এই দায়িত্বপূর্ণ কাজটি যথেষ্ট যত্ন ও আন্তরিকতার সঙ্গে করেছেন।
তাঁর অনুবাদে দেখা যায়, শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই এটি সহজে পড়তে ও বুঝতে পারে। এজন্য তাঁর কাব্যানুবাদ শুধু শিক্ষিত পাঠকের নয়, বরং মসজিদ-মাদ্রাসার ছাত্র, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ সবার জন্য উপযোগী।
আমপারা কাব্যানুবাদ করার পেছনে একটি বড় উদ্দেশ্য হলো মানুষ যাতে নামাজে যে সূরাগুলো পড়ে, সেগুলোর অর্থ ও মর্ম বুঝতে পারে। শুধু মুখস্থ করে নয়, বরং উপলব্ধি করে নামাযে মনোসংযোগ বাড়ানো সম্ভব হয় এই অনুবাদের মাধ্যমে। এই শিক্ষাগত ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে হাসান আলীমের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্য অনেক অনুবাদক কোরআনের ভাষাকে সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, কেউ কেউ ভাষাগত অলংকারে ডুবেছেন। কিন্তু হাসান আলীম তাঁর কাজকে একটি দায়িত্ব ও আমানত হিসেবে নিয়েছেন। তিনি কাব্যিক রূপে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার কাজকে নিছক সাহিত্যচর্চা নয়, বরং একটি দ্বীনি খিদমত হিসেবে দেখেছেন।
সর্বোপরি, বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য এমন একটি অনুবাদ সত্যিই দরকার ছিল, যা সহজবোধ্য, কাব্যময় এবং যথার্থ। এ কাজের মাধ্যমে হাসান আলীম একদিকে সাহিত্য সাধনা করেছেন, অপরদিকে দ্বীনের সেবা করেছেন।
আমি কিছু উদাহরণ সহ আলোচনা করছি।
কুরআন: শেষ অধ্যায়” হলো এক অভিনব সাহিত্যিক উপস্থাপনা, যেখানে ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের শেষ পারার সূরাগুলিকে কাব্যিক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটির মাধ্যমে লেখক ইসলামি চেতনাকে সাধারণ পাঠকের নিকট ছন্দে ও রচনাশৈলীতে সহজবোধ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, “সূরা আল ফালাক: বিভাজন (আলো ও আঁধারের)” কাব্যিক অনুবাদে আলো ও অন্ধকার, মুক্তি ও বিভাজনের বিষয়টি প্রতীকীভাবে এসেছে। এখানে কবি আধার থেকে মুক্তির আকুতি প্রকাশ করেছেন এবং এক স্রষ্টার প্রতি নিরাপত্তা ও দয়া কামনা করেছেন। এই সূরার ছায়াতেই লেখা হয়েছে “আল নাস” এবং “আল ফালাক”-এর থিম অনুযায়ী আধুনিক কবিতার মতোই অলঙ্কার ও ছন্দের সাহায্যে দ্বৈততার (আলো-আঁধার, ভাল-মন্দ) দার্শনিক ব্যাখ্যা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
“সূরা আল কদর: মহিমান্বিত রাত” সূরাটিতে লাইলাতুল কদরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। কাব্যিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এই রাতটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য মহান প্রভুর পক্ষ থেকে এক বিশেষ দান। কবি এটিকে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং আধ্যাত্মিক জাগরণের একটি নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
“সূরা আল ফাতিহা: প্রার্থনা” অংশটি কুরআনের সারসংক্ষেপরূপে পরিচিত। কবি এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি, করুণা, বিচার ও সঠিক পথের প্রতি আকর্ষণের কথা ছন্দে ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করেছেন। মূলত এটি মানবজীবনের সর্বস্তরের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।
অন্যদিকে, “সূরা আল ইখলাস: বিশুদ্ধতা” সূরাটি তাওহীদের সারমর্ম বহন করে। কবির রচনায় এখানে আল্লাহর একত্ববাদ, ও অতুলনীয়তা অত্যন্ত গভীর ও ভাবগম্ভীর ছন্দে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, “তিনি তো অভাব হীন চির অম্লান” এই পঙক্তিতে স্রষ্টার অতুল মহিমা ও নির্ভরতাহীন সত্তার পরিচয় মেলে।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, এটি ধর্মীয় ভাবনাকে সাহিত্যের রূপ দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ ও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেছে। এতে একদিকে যেমন ধর্মীয় শিক্ষা রয়েছে, অন্যদিকে সাহিত্যরসও বিদ্যমান।
সংক্ষেপে, “কাব্যে কুরআন: শেষ অধ্যায়” একটি ধর্মীয় ভাবনাকে কবিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিনব প্রয়াস। এটি শুধু ধর্মপ্রাণ পাঠকই নয়, সাহিত্যপ্রেমীদের কাছেও মূল্যবান হয়ে
“কাব্যে কুরআন শেষ অধ্যায়” এর প্রকাশক হলেন জাহিদুর রহমান, বইটি ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে আমিনাহ প্রকাশনা থেকে। বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।