মোহাম্মদ নকিব

ফিকশনের বাড়-বাড়ন্তের এই সময়ে ছোটগল্প কি গুরুত্ব হারাচ্ছে এমন প্রশ্ন উঠে আসছে। ফিকশন বলতে আমি নভেল বা উপন্যাস বুঝাচ্ছি। ছোটগল্পের পঠন পাঠন কমে যাচ্ছে, লেখাও হচ্ছে কম। বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত অধিকাংশ ছোটগল্পের মধ্যেই ছোটগল্পের চারিত্র্যটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সীমাবদ্ধ স্থানে সীমিত শব্দে প্রকাশিত এসব গল্প পাঠকের মন ভরাতে পারছে না। গল্পকারকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বাধা যায় কি না সে প্রশ্নও আছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। মুজতাহিদ ফারুকীর গল্পগ্রন্থ বিরান মসজিদের ইমাম এর গল্পগুলো সেই ব্যতিক্রমী গল্পগুলোর অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। কারণ তিনি এই বইয়ে স্থান পাওয়া কোন গল্পেই সেই সীমারেখা মানেননি। একেকটার আকার একেক রকম। সম্প্রতি প্রকাশিত এই বইটি প্রকাশ করেছে অনশ্বর প্রকাশনা সংস্থা। গ্রন্থে প্রকাশিত ৫ টি গল্প হচ্ছে ক্লোন, প্রস্তুতিপর্ব, ক্রসফায়ার, পোকা ও নাম গল্প বিরান মসজিদের ইমাম। এই গল্পগুলোর কোন কোনটি সাধারণ আকৃতির, কোনটি বেশ দীর্ঘ।

মুজতাহিদ ফারুকী দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। কবিতা ও গল্পের ভুবনে তার স্বচ্ছন্দ চলাফেরা। ‘ঝুলে আছে’ নামে তার একটি গল্পগ্রন্থ বেশ নাম করেছে। তার জন্ম ১৯৫৯ সালে জামালপুরে। তিনি তার গল্পে বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের চিত্র হাজির করেছেন। এই গ্রন্থের গল্পগুলোতেও তেমনটাই দেখা যায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৯ টি। কবিতা লিখলেও গল্পে তিনি নিবিষ্ট, তিনখানা উপন্যাসও লিখেছেন। প্রকাশকের কথায় উঠে এসেছে তার লেখালেখির চারিত্র্যটি। এতে বলা হয়েছে, ‘মুজতাহিদ ফারুকীর গল্পের উপজীব্য প্রধানত গ্রামের সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার, প্রথা প্রচলন, বাকভঙ্গি ইত্যাদি। --- তার গল্পে যেটি ইউনিক তা হলো, একটি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের ইতিবাচক উপস্থাপন।’ বলা যেতে পারে এ বক্তব্য যথার্থই।

ফারুকী রাজনীতি সচেতন। জীবনবোধ সম্পর্কে তার ধারণা বা অর্জন তার প্রকাশ ঘটেছে প্রকাশিত গল্পগুলোতে। এগুলোতে এক দিকে উঠে এসেছে ১৯৭১ এ গ্রামের এক বিবাহিত তরুণের মুক্তিযুদ্ধে যাবার আকুতি ও চেষ্টা। প্রস্তুতিপর্ব গল্পে শুক্কুর আলীর সেই চেষ্টা শেষে সফল হয়। সে যায় আর লেখকের ভাষায়-- জ্যেৎস্নাধোয়া সারা বাংলাদেশ আদিগন্ত বিছিয়ে আছে শুধু তারই অপেক্ষায়। (পৃ-২১)

ক্লোন গল্পে এক চেহারার আরেকটি কন্যার কাহিনি। চান মিয়ার মেয়ে মৃত পায়েলের সঙ্গে আরেক গ্রামের এক মেয়ের চেহায় অবিকল মিল। শেষ পর্যন্ত দেখতে গিয়ে থমকে যায় পিতা চান মিয়া। এটাকে ক্লোন বলে বলাবলি করে অনেকেই। তবে চেহারায় মিলের ব্যাপরাটা সাধারণ একথা গল্পকার উল্লেখ করেছেন। তারপরও অসাধারণ হয়ে উঠেছে গল্পটি।

ক্রস ফায়ার গল্পে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের এক কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে। গল্পের কথক নিজেই শিকার এই কঠিন পরিস্থিতির। তার বর্ণনায় আনুপুক্সক্ষ উঠে এসেছে বলা চলে।

‘পোকা’ গল্পে উঠে এসেছে গৃহায়ণ খাতে দুর্নীতির চিত্র। বিপুল ঋণ দিয়ে বড় কর্তারা ফাঁসে না ফেঁসে যায় অফিসার শফিক। এ যেন হালজামানার চিত্র।

বিরান মজজিদের ইমাম গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রামের এক মসজিদের ইমাম কাম মুয়াজ্জিন মৌলবী বাসেত। গ্রামের সাধারণ মানুষ তার কথাকে খুব মূল্য দেয়। বৃষ্টি হবে বলে তিনি এমনিতে একদিন ঘোষণা দেয়ার পর তিন মাসের খরার পর সত্যি সত্যি বৃষ্টি নেমে আসে। একথা চাউর হতে তার প্রসার বাড়ে। কিন্তু সাংসারিক জীবনে তিনি অসন্তুষ্ট। সন্তানাদি না থাকায় স্ত্রী রাহেলা এক সময় তাকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে যায়। গল্পের শেষে একটু অতিপ্রাকৃত ঘটনার ঘনঘটা দেখা দেয়। এভাবেই শেষ হয় গল্পটি। আয়তনের দিক থেকে এটাকে নভেলা বলা যেতে পারে। মসজিদের ইমামের জীবনের নানা দিক এতে উঠে এসেছে। কমিটির লোকরা তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করলেও বাসেত খুব বেশি তাদের ডাকে সাড়া দেননি। তিনি নিয়মনীতির মধ্যেই থাকার চেষ্টা করেছেন। গল্পটিতে ফারুকী গ্রামীণ জগতের ভিন্ন একটি চেহারা দেখাতে চেয়েছেন। পাঠকই বিচার করবেন তিনি কতটা সফল।

ভাষা ব্যবহারে ফারুকী চরিত্রানুগ থেকেছেন। গ্রামীণ শব্দগুলো অবিকলরূপে উঠে এসেছে। তিনি পরিশীলিত ভাষা প্রয়োগের চেষ্টা করেননি। এটা পাঠকের ভালো লাগবে বলে মনে হয়।

বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রব এষ। ছাপা বাঁধাই ভালো। ৮০ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম ৩৫০ টাকা, যা একটু বেশিই মনে হয়। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।

বিরান মসজিদের ইমাম

মুজতাহিদ ফারুকী

প্রকাশক : অনশ্বর, ১১, বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০

প্রকাশকাল: জুন ২০২৫

প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ , পৃÑ৮০,

মূল্য- ৩৫০ টাকা