বই
ব ই ভা ব না
বইপাঠ, প্রকাশ ও বিক্রি নিয়ে কিছু কথা
বই এমন একটি পণ্য যার মূল্য দুইভাবে চুকাতে হয়। প্রথমত বইয়ের উৎপাদন খরচ মেটানোর মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত গভীর মমতায় বইটি পাঠ করে। সম্ভব হলে পঠিত বইয়ের উপর পাঠপ্রতিক্রিয়া জানিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই বিমুখ।
Printed Edition

সিদ্দিক আবু বকর
বই এমন একটি পণ্য যার মূল্য দুইভাবে চুকাতে হয়। প্রথমত বইয়ের উৎপাদন খরচ মেটানোর মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত গভীর মমতায় বইটি পাঠ করে। সম্ভব হলে পঠিত বইয়ের উপর পাঠপ্রতিক্রিয়া জানিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই বিমুখ। একটা ক্ষুদ্র অংশ আছে যারা বই প্রেমিক ও সিরিয়াস পাঠক। তারা কিন্তু বই পড়ে এবং সৌজন্য কপির তোয়াক্কা না করে কিনেই পড়ে। অই সব পাঠকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বেদনাদায়ক হলেও সত্য আমরা আশঙ্কাজনক হারে পাঠ বিমুখ। আর বই কিনে পাঠ? তার স্টাটাস্টিক্স আরও ভয়াবহ! আমার এই কথায় কেউ কেউ হয়তো কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু আলগা কষ্টের জলে তো আর নির্মম সত্য ধুয়ে ফেলা যায় না।
এই যে আমরা পাঠ্য বা একাডেমিক বইয়ের বাইরে বই পড়ি না বা পড়লেও কিনে পড়ার অভ্যাস আশানুরূপ গড়ে ওঠেনি, এটি কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য একটা ভয়াবহ ইন্টেলেকচুয়াল ডিজাস্টার। বই না পড়ার ফলে জ্ঞান-বুদ্ধি, জানা-শোনার পরিধি তো কমছেই তার সাথে কমছে মানুষের অকৃত্রিম আবেগ-বিবেক কিংবা নৈতিকতার রেসিও।
আপনি বলতে পারেন, শুধু একাডেমিক কেন সৃজনশীল আউট বইও তো পড়ি! অনলাইনে নিয়মিত পড়ি। হ্যাঁ অস্বীকার করছি না অনলাইনে পড়েন। অনলাইনে কী পড়েন? পিডিএফ পড়েন।
অধিকাংশ অনলাইন পড়ুয়া, সার্চবারে গিয়ে পিডিএফ পড়ার জন্য একশো টাকার বইয়ের জন্য পঞ্চাশ টাকার এমবি পোড়াতেও কুন্ঠিত হন না। কেউ কেউ অবশ্য ই-বুকে পে করেও পড়েন। ই-বুক প্লাটফর্মে যারা পড়েন তাদের অভ্যাসটা এপ্রিসিয়েবল। কিন্তু এই এপ্রিসিয়েশন পাওয়ার মতো আদমি যে হাতে গোনা আশা করি দ্বিমত করার উপায় নাই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমরা মাগনায় অভ্যস্ত। আরেকটু খোলাসা করে বললে, তিনশো টাকার ফ্রি আলকাতরা পেতে পাঁচশো টাকার লুঙ্গি নষ্ট করতেও বাধে না আমাদের। সব বাধা কেবল জ্ঞানের ও বিনোদনের আধার বই কেনার ক্ষেত্রে।
ভাবতে পারেন, আমি এক অখ্যাত অপরিচিত লেখক নিজের বই বিক্রি না হওয়ার বেদনা থেকে খিস্তিখেউড় করছি। আপনাদের অনুমান পুরোপুরি না হলেও খানিকটা সত্য বৈ কী! আমি তো অখ্যাত, অনেক বিখ্যাত জনের বইও কিন্তু অবিক্রিত থাকছে। এর জবাবে আপনারা কি বলবেন? প্রশ্নটা আপনাদের কাছে রাখলাম। আর অই যে ফ্রি-তে পিডিএফ পড়ার কথা বলছিলাম ওখানে কিন্তু বিখ্যাত জনের বই-ই বেশি খোঁজা হয় এবং পড়াও হয়। এবার বুঝুন, খ্যাতির বিড়ম্বনা কারে কয়!
বই নিয়ে কিছু তিক্ত ও বেদনার ইতিহাস বিবৃত করতে চাই। আচ্ছা আপনাদের মনে এই প্রশ্ন কি কখনো আসে, পাব্লিক তো বইবিমুখ। আর কিনে পড়ার ক্ষেত্রে তো সেই অবস্থা আরও ভয়াবহ। তারপরও এতো এতো বই, এতো এতো প্রকাশনী তো বছর বছর বেড়েই চলেছে! এর মাজেজা কি? আর বই যদি পাব্লিক না-ই কিনে, বইমেলায় এতো এতো স্টলেরই পসরা কী করে বসে? অনেক দামি প্রশ্ন করেছেন বটে। আসুন তাহলে এর গূঢ় রহস্য আপনাদের জানাই। কোন রাখ-ঢাক নয় পানির লাহান পরিষ্কার করে দেব।
এতো বই, এতো প্রকাশক আর এতো বইয়ের স্টলের মাজেজা হচ্ছে “মুরগী লেখক”। শুধু মুরগী লেখক না লেখকরাই এর মূলে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো না তো! আসুন আরেকটু ক্লিয়ার করি। তার আগে ক্লিয়ার করি মুরগী লেখক কি? মুরগী লেখক হচ্ছেন আমার মতন যারা আর কী! জীবনের অভিজ্ঞতা কালির আচরে কিংবা এন্ড্রয়েডের বাটনে তৈরির প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে লেখাটিকে প্রসব করার তাড়নায় দিক-বিদিক ছুটোছুটি করা নিরীহ লেখক মহোদয়। এই ছুটোছুটি বন্ধের দাওয়াই হাতে বসে থাকে বেশ কিছু ভূঁইফোঁড় থেকে শুরু করে অনেক প্রথিতযশা প্রকাশনী। তারা লেখকের প্রসব বেদনা খালাসে ত্রাতার(?) ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়! ব্যস দর কষাকষিতে চূড়ান্ত হয় লেখকের টাকায় বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত। মুরগী (লেখক) ধান খাবে না কুড়া খাবে এ সিদ্ধান্ত দর কষাকষির টেবিলেই চূড়ান্ত হয়। এখানে কন্ডিশন দুইটা। কন্ডিশন এক- বই প্রকাশের সব খরচ লেখকের। প্রকাশক এখানে স্রেফ মাধ্যম। কন্ডিশন দুই- প্রকাশক বই প্রকাশ করবেন যার সিংহভাগ কিনে নেবেন আবার লেখকই। দ্বিতীয় কন্ডিশন সবাইকে দেয়া হয় না। এটা পরিচিত অথবা লেখক অঙ্গনে ইতোমধ্যে পরিচিতজন এই কন্ডিশনে আসতে পারেন। আর মুরগী লেখকদের জন্য প্রথম কন্ডিশন কিন্তু বাধ্যতামূলক। লেখক বা মুরগী লেখকরাই এতো এতো প্রকাশক ও বইয়ের স্রষ্টা। এক সময় লেখক ঘুরতো প্রকাশকের দরজায় আর এখন তার উলটো। প্রকাশক খুঁজে বেড়ান লেখক।
আমি কথা শুরু করে ছিলাম বইয়ের পাঠক ও বই বিক্রি নিয়ে। মাঝখানে লেখক প্রকাশক ধারণাটার উদ্রেক করলাম এই কারণে যে, আপনারা যাতে লেখকের শ্রম ঘাম অর্থের বিনিময়ে সৃষ্ট বইয়ের রহস্যটা বুঝতে পারেন। আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনি একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে কখনোই লেখকের বইটি সৌজন্যে পড়ার ইচ্ছা পোষণ করবেন না। সে লেখক হোক আপনার আত্মীয় কিংবা পরিচিতজন। প্লিজ তার বইটি প্রথমত পড়ুন। দ্বিতীয়ত কিনে পড়ুন। তৃতীয়ত একাধিক কপি কিনুন। লেখককে অন্যের সামনে তুলে ধরতে সম্ভব হলে মার্কেটিংও করুন। আপনার পরিচিতজনরা বই কিনতে না চাইলে আপনার কেনা অতিরিক্ত কপিটি তাকে গিফট করুন। দেখবেন এক সময় সেও কিনে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
আমার আলোচনায় বই, লেখক ও প্রকাশক বিষয়ে একটি বৃহৎ দিক উঠে এসেছে। এর বাইরে আরও একটা ক্ষুদ্র দিকও আছে। যেখানে প্রকাশক লেখকের বইয়ে অর্থ শ্রম মেধা লগ্নি করেন কিন্তু তার সংখ্যা হাতে গোনা।
পরিশেষে বলব, আসুন বই পড়ি। অন্যকে বই উপহার দেই। অতি অবশ্যই কিনে পড়ি ও কিনে উপহার দেই।