মুহাম্মদ নূরে আলম

বাসনা বিলাস মূলত আটটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলোতে লেখক মানুষের সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভেতরের বিভিন্ন মাত্রা, আবেগ, অনুভূতির সূক্ষ্ম ইশারা-আভাস তুলে ধরেছেন। যে ধরনের পরিবেশ বা কথা-পরিস্থিতিতে মানুষ পুরোটাই বলার সুযোগ পায় না, অনেক কিছু অনুভব করে, ইচ্ছে করে, কিন্তু বলতে পারে না- এমন জটিল বরাবরের কথোপকথন, অচেনা মনস্তাত্ত্বিক জায়গা এবং অব্যক্ত অনুভূতির দিকেই গল্পগুলো পরিচালিত। গল্পগুলোর ধরণ হট-গতি-পূর্ণ, ঝরঝরে; পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখে

মানব চরিত্রের বিশ্লেষণ: মাহবুব মোর্শেদ এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে মানবচরিত্রের বিভিন্ন স্তর ও অনুভূতিকে তুলে ধরেছেন। চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো এখানে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কল্পনায় স্থান পাওয়া, ভাবনায় ঠাঁই পাওয়া এমন গল্প যা হয়তো আগে কখনও অনুভব করা হয়নি, অথবা শ্রোতার স্মৃতিতে অচেনা যোগাযোগ তৈরি করবে। সাধারণভাবে যে কথাগুলো বলা হয় না বা বলা গেছে কিন্তু পুরোপুরি বোঝা হয়নি - সেসব কথার অর্ধেকটি পর্দার আড়ালে রেখে দেয়ার মতো ইশারা বা আভাস থাকবে। সাদামাটা, সাধারণ মানুষের জীবন, সম্পর্ক, ইতিবাচক-নেতিবাচক অনুভূতি এসবকে খুব সূক্ষ্মভাবে আঁকা হয়েছে।

রহস্য ও উন্মোচন: বইটি যেমন রহস্যময়, তেমনই রহস্যের গভীরতা উন্মোচন করে। পাঠক একটি রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করে, কিন্তু অনেক নতুন রহস্যের সম্মুখীন হয়। তার গল্পে থাকে বলা-না-বলার ইশারা-আভাস। সেই ইশারা থেকে পাঠক বাকিটুকু বুঝে নেন নিজের কল্পনা খাটিয়ে। মনে মনে পুরো ছবিটা এঁকে ফেলেন। মাহবুব মোর্শেদের পাঠকমাত্রই জানেন, তার ফিকশনের প্রিয় বিষয় মানবসম্পর্ক, সম্পর্কের ভেতরের নানান মাত্রা, রং ও রেখা। এ বইয়ের আটটি গল্পে তেমন অজস্র মাত্রা উঠে এসেছে। পড়তে পড়তে পাঠক অনুভব করবেন, এ যেন তারই গল্প অথবা এ রকম গল্প যেন তিনিও জানেন বা কোথাও শুনেছেন। তবু আমাদের সাহিত্যে এই বিষয়গুলো আজ অবধি অনালোচিত, অনাবিষ্কৃত ও অনাঘ্রাত রয়ে গেছে। কেন? তা জানতে আপনাকে পড়তে হবে গল্পগুলো।

অন্ধকার গ্রামীণ পটভূমি: গ্রন্থের গল্প গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত, যেখানে চরিত্ররা সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করে। অন্ধকার গ্রামীণ পথে টর্চবাতি জ্বালিয়ে পথ চলার মতো করে মানবচরিত্রের আনাচে-কানাচে চকিত আলোক প্রক্ষেপণ করে মুহূর্তে সরিয়ে নেন মাহবুব মোর্শেদ। যেন রহস্য ভেদ করেও অনেক রহস্য রেখে দিতে চান অনাবিষ্কৃত অবস্থায়।

পাঠকের অভিজ্ঞতা: বইটি পড়ার সময় পাঠক যেন মানবচরিত্রের অন্ধকার পথে টর্চবাতি জ্বালিয়ে এগিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়। এই বইয়ে সবচেয়ে বেশি যে শিক্ষণীয় ছিল তা হলো স্যাপিওসেক্সুয়াল। গল্প পড়ে এর অর্থ বের করতে না পারলেও কয়েকটি বাক্যে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। যা আমার লেখার শুরুতেই বলেছি। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে দেশের বলা যায় ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ পক্ষের লোকজন ছিল। আমরা এক হয়ে দেশটা গড়ার জন্যই ফ্যাসিস্টদের বিতাড়িত করেছিলাম। বাসনাবিলাসেরর সেই স্যাপিওসেক্সুয়াল গল্পের লাইনের মতো পক্ষের লোকজন যদি আমরা দেশ গড়ায় মনোযোগী হতাম। আমাদের দেশ গত এক বছরে পাল্টায় যেত। লেখক মাহবুব মোর্শেদের সেই গল্পের মতো অভ্যুত্থানের আমরা সেই মানুষগুলো যদি চিপসের প্যাকেট যেখানে সেখানে না ফেলতাম। দেশটা হতো প্লাস্টিকমুক্ত। দেশটা হতো সুন্দর, পরিপাটি। যে জিনিসটা রিসাইক্লিং করা যায় তা যদি নতুন না কিনে রিসাইক্লিং করে ব্যবহার করতাম। অর্থও বাঁচত পরিবেশও সুন্দর হতো। আমরা যদি দেশ গড়ার আলোকে ফুটপাত দখল করা ছেড়ে দিতাম (বরং এখন ফুটপাত এক লাইনের বদলে ৩ লাইন হয়েছে)। মোটর সাইকেল যদি ফুটপাতে না উঠাতাম। আমাদের নিজের কাজগুলো আমরা যদি সঠিকভাবে করতাম। আহা কত সুন্দর দেশ হতো।

গল্পগুলোর বিশ্লেষণ: মোট আটটি গল্পের সংকলন এই বই। প্রথম গল্প ঘ্রাণ। দ্বিতীয় গল্প সোলমেট। আরেকটি গল্প জাম্বুরা। নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেসব চিত্রকল্প নিয়ে ভাবছেন, ভাবতে থাকুন। পড়ে দেখুন। লেখক আপনাকে হতাশ করবেন না। যে গল্পের শিরোনাম বুশরা, সেটা একটা স্পেশাল গল্প বলতেই হবে। শেষ মুহূর্তের নাটকীয় মোড় এবং মোচড়, চমকে দেবে। মানুষ তো এমনই। ইকতিয়ারের জন্মদিন গল্পে লেখক আমাদের সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের নিয়ে যেভাবে ঢোল বাজিয়েছেন, তাতে তার তারিফ করতেই হয়। খেলো করে ছেড়েছেন। আর শেষ গল্প স্যাপিওসেক্সুয়াল। মহৎ এক শিল্পীকে ঘিরে এই গল্প। আর শিল্পের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলার গল্প এটি।

মাহবুব মোর্শেদ এড়িয়ে যাওয়ার মানুষ নন। সাহস করে এগিয়ে যাওয়ার মানুষ। হিপোক্রেসির চর্চা তার গল্পে নেই। যেমন চলছে, যেমনটা সাধারণত হয়, যেমনটা হয়ে চলেছে, সেসব তেমন করেই উপস্থাপন করেন। এরকম মুখ খোলা কথা মার্কেজের উপন্যাসে আমরা হারামেশায় পাই। মাহবুব মোর্শেদের বাসনা বিলাস পড়ে ভিন্ন কিছু পড়বার আনন্দ পেয়েছি। সে আনন্দ এসেছে লেখকের কলমের ক্ষমতার গুণেই।

বই: বাসনা বিলাস

লেখক: মাহবুব মোর্শেদ

প্রকাশক: আদর্শ, প্রথম প্রকাশ: ২০২৫,

প্রথম সংস্করণ

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১২

মূল্য: ৩০০ টাকা।