হাসান নাজমুল
সায়ীদ আবুবকর বাংলা সাহিত্যের নব্বইয়ের দশকের প্রধান কবি। তিনি প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছেন। স্বাতন্ত্র্যবোধের কারণেই তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ পাঠককে প্রচ- আকর্ষণ করেছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ষোড়শ কাব্যগ্রন্থ ‘নরক নগরে’। ‘নরক নগরে’ বর্তমান সময়ের আয়নাসরূপ। ‘নরক নগর’ পাঠ করে একজন পাঠক তাঁরই প্রতিবিম্ব দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন বর্তমান সময়ের চিত্র। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের প্রতিচ্ছবিও দেখা যাবে এই কাব্যগ্রন্থে।
এ নগর যেন বার্ধক্য ও অসুখবিসুখে ভরা, যে-বার্ধক্য, অসুখবিসুখ প্রতিনিয়ত মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কবি মানুষের শাশ্বত জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরেছেন তাঁর ‘দুর্বিষহ’ কবিতায়। এ কবিতায় তিনি বলেছেন—
জীবনযন্ত্রণা আমি অষ্টযাম দেখেছি এখানে
মানুষের, পশুদের। বার্ধক্য ও অসুখবিসুখ
দুরন্ত পাঁকের মতো কিভাবে মৃত্যুর দিকে টানে;
কিভাবে বিবর্ণ হয় রূপসীর রোদভেজা মুখ;
কিভাবে কুঁচকে যায় ঝড়তোলা তুমুল তারুণ্য
পোড়া বেগুনের মতো; আর একটি রুগ্ন সারমেয়
আর্তকণ্ঠে কি-করুণ কেঁই কেঁই করে ডাকে, শূন্য
আকাশের দিকে মুখ করে! তবে মৃত্যুই কি শ্রেয়Ñ
এ নগর নরক নগর। এ নগর প্রেমহীন, ভালবাসাহীন এবং পবিত্রতাহীন। তাই তো কবি তাঁর ‘হে সবুজ শিমুলবালিকা’ কবিতায় বলেছেনÑ
প্রেমহীন এ নগর। নগরের নিটোল নটীরা
পেতে রাখে পথে পথে ইস্ত্রী করা শরীরের জাল।
কামনায় নেচে ওঠে পুঁজিবাদী মৎস্যদের শিরা;
লাফিয়ে লাফিয়ে তাতে ধরা পড়ে রুই ও বোয়াল।
এই নরক নগর মূলত কোনো সবুজ শিমুলবালিকার জন্য নয়। তাই তো কবি শিমুলবালিকাকে জিজ্ঞেস করেছেনÑ
তুমি কেন প্রেমময়ী হে সবুজ শিমুলবালিকা,
কুসুম ফোটাতে এলে রুক্ষ এই নরকনগরে?
এখানে আকাশে দ্যাখো ধোঁয়া ধোঁয়া আগুনের শিখা,
বাতাসে সীসার বিষ, প্রস্তর মাটির স্তরে স্তরে।
একজন প্রকৃত কবিই কেবল পাঠকের বোধগম্যের বিষয় নিয়ে ভাবেন। কবি সায়ীদ আবুবকর তার ব্যতিক্রম নন। তিনি সবসময় পাঠকের বোধগম্যের বিষয়টি মাথায় রাখেন। তাঁর ‘নরক নগরে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই সারল্যে ভরা। শব্দ ও ভাষায় সারল্য সৃষ্টি করে তিনি কবিতাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।
সেই সঙ্গে উপমা প্রয়োগের মাধ্যমে কবিতাকে করেছেন লোভনীয়— অতুলনীয়। ‘নরক নগর’ কবিতার বেশ কিছু পঙক্তিতে তিনি পূর্ণোপমা প্রয়োগ করেছেন। পঙক্তিগুলো পড়ে নেওয়া যাকÑ
এখানে সকালগুলো যক্ষার রোগীর মতো খকখক করে কাশে;
দুপুর হাঁপায়, যেন বয়োবৃদ্ধ হাঁপানির রোগী, দম যার
ডিমপাড়া মুরগীর মতো বসে আছে মুখের উপর;
সন্ধ্যা ডাইনোসরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে
হেলেদুলে ঢোকে নগরের সিংদরোজায়;
রাত্রি সারারাত জাহান্নামের ভিতর বসে যন্ত্রণায় করে ছটফট,
যার চিৎকারধ্বনি ধূসর ধোঁয়ার মতো উঠে যায় দূরের আকাশে;
কী করে মানুষ, হায়, এ-নরকে করে বসবাস—আমি ভাবি।
‘নরক নগরে’র কবিতাগুলো সহজ শব্দের মূল্যবান শিল্প। শহরে যারা ভদ্রপুরুষ কিংবা ভদ্রমহিলা অথচ দাম্ভিক, তাদেরকে তিনি ‘ভদ্রমহোদয়গণ ও ভদ্রমহিলারা’ কবিতায় এভাবে উল্লেখ করেছেনÑ
ভদ্রমহোদয়গণ স্যুট-টাই পরে
দম্ভ ভরে
চলে পথেঘাটে;
ঘাড় টানটান করে হাঁটে;
চেখের চশমা তুলে রাখে কপালের ‘পর,
দেখে মনে হয় হরিণের শিং;
পরিচিতজনদের সাথে যদি দেখা হয়,
মিষ্টি করে কয়, গুড মরনিং।
ভদ্রমহিলারা আনকোরা শাড়ি পরে, পায়ে পরে হিল,
ব্যাটারি লাগানো পুতুলের মতো চলে
আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে।
পথে যদি কেউ ‘ভালো আছেন তো?’
বলে ফ্যালে কথা হেন,
তারা বলে, ‘ভালো থাকবো না কেন?’
বলে কাচের চুড়ির মতো হাসে খিলখিল।
সে-হাসির সাথে তবলা বাজায় যেন
দু-পায়ের হিল।
আধুনিক জমানার নগ্নতার বিষয়টিও কবি সায়ীদ আবুবকরের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। মূলত নগ্নতাই একটি নগরকে নরক বানিয়ে ফেলে। বাসযোগ্য স্থানকে বসবাসের অনুপযোগী করে তোলে। সায়ীদ আবুবকর তাঁর ‘বস্ত্রবাদ’ কবিতায় নারীদের এভাবে জিজ্ঞেস করেছেনÑ
খুলতে খুলতে কত আর খুলবে পোশাক, মেয়ে?
যায় যে উন্মুক্ত হয়ে পলি পড়া যমুনার চর!
ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো কি-রকম আছে চেয়ে চেয়ে—
হারিয়ে সোনালি হায়া আর কত হবে দিগম্বর?
সায়ীদ আবুবকর একজন শক্তিশালী কবি। শক্তিশালী কবিরা ছন্দের বাইরে গিয়ে কবিতা লিখতে নারাজ। ‘নরক নগরে’র প্রায় সব কবিতায় তিনি ছন্দপ্রবাহ ধরে রেখেছেন। ‘বস্ত্রবাদ’ কবিতাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি পুরো কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ৮+১০ এর চালে লিখেছেন। লিখেছেন বিখ্যাত সব পঙক্তিÑ
আমরা নগ্নতা থেকে আসিনি কি ফিরে সভ্যতায়,
মহামূল্য মসলিনে দি নি ঢেকে তোমার শরীর?
খোসার মধ্যেই কলা শান্তি ও সৌন্দর্য খুঁজে পায়,
ডাবের ভিতরে পানি হয়ে যায় বেহেস্তের ক্ষীর।
একজন জাত কবির দৃষ্টি ঢুকে পড়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তো একজন ভিক্ষুকও সায়ীদ আবুবকরের কবিতায় পরিণত হয়েছে। তিনি ‘আজব ভিক্ষুক’ কবিতায় বলেছেন—
আজব ভিক্ষুক এক দেখি ফুটপাতেÑ
লোকজন ভিক্ষা দিলে নেয় না সে হাতে,
সামনে বাড়িয়ে দেয় একখানা থাল,
লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে তার গাল।
সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা একজন কবির হৃদয়কে আন্দোলিত করে। রক্ত-মৃত্যু-খুন, শাসকগোষ্ঠীর অটরোসিটি একজন প্রকৃত কবিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কালে কালে ঘটে যাওয়া বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানে একজন জাত কবি হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে কবি সায়ীদ আবুবকরও প্রচ- প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। তাঁর ‘নরক নগরে’ ঠাঁই পেয়েছে গণঅভ্যুত্থানের একগুচ্ছ কবিতা। গণঅভ্যুত্থানের ‘লাল জুলাইয়ের গান’ কবিতার কয়েক পঙক্তি পড়ে নেওয়া যাক—
রাজপথে লক্ষ লক্ষ লোক, বন্দুকের নলের সামনে পেতে দেছে যারা বক্ষ;
সিংহের মতো দাঁড়িয়েছে রুখে ফারহান, শাকিল ও আবু সাইদের রক্তে ভেজা দেশ;
বেপরোয়া লক্ষ লক্ষ লোক, একটি হৃদয় এবং তাদের একটাই শুধু লক্ষ্য:
দূর হ, হে দুঃশাসন, হে শকুন, হে দজ্জাল, হে নির্লজ্জ রেমেসেস!
জীবন ও যৌবনের কবি সায়ীদ আবুবকর। তাঁর কাছে জরাজীর্ণতার কোনো ঠাঁই নেই। জুলাই বিপ্লবের ‘ঝরা পাতার নৃত্য’ কবিতায় তিনি বলেছেনÑ
পুকুরের পানির মতো এ নিস্তরঙ্গ মৃত্যুর শহরে আচমকা এ-কি
জীবনের উন্মাদনা! যে ছিলো অচল, ছুটছে সে উল্কার গতিতে।
যে ছিলো নিথর, উড়ছে সে ঈগলের অধীর ডানায়। কী হলো হঠাৎ
এই ভূতের শহরে, বয়সের ভারে নুব্জ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা ফিরে পেয়ে
হারানো যৌবন, ছুটছে ক্ষিপ্রবেগে যেন ষাঁড়; তরুণ ও তরুণীরা যেন ঝড়,
সায়ীদ আবুবকর আসন্ন প্রজন্মের জন্য লিখেছেন ‘পাঁচই আগস্টনামা’। ‘নরক নগরে’র এই ‘পাঁচই আগস্টনামা’ পড়ে আসন্ন প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা শিখবে কীভাবে হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়, মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে আদায় করতে হয় অধিকার। কবির ভাষায়Ñ
সুবে সাদেকের আগেই ঝড়ের মতো দিগ্বিদিক ভাঙতে ভাঙতে
ছুটে আসতে লাগলো অগ্নিমিছিল, মৃত্যুর ঝা-া নিয়ে হাতে আর
বুকে বেঁধে সফেদ কাফন। তাদের বিক্ষুব্ধ চোখেমুখে রয়েল বেঙ্গল
টাইগারের ক্রোধের আগুন, হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা তারা
ফিরিয়ে না নিয়ে ফিরবে না আর ঘরে।
কবি সায়ীদ আবুবকর ‘নরক নগরে’র প্রতিটি কবিতায় চমক সৃষ্টি করেছেন। সারল্যের টানে এ কাব্যগ্রন্থের কবিতা পাঠ করতে করতে একজন পাঠক তাঁর নিজস্ব নগর, দেশ, দেশের মানুষ, শাসক ও শোষণ সম্পর্কে সংবিৎ ফিরে পেয়ে আচমকা সচেতন হয়ে ওঠেন। সারল্য, স্বাতন্ত্র্য এবং কবিতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ ‘নরক নগরে’ কাব্যগ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ বইটি প্রকাশ করেছে। প্রচ্ছদ করেছেন রাজিব রায়। মূল্য ২০০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।