খোরশেদ মুকুল

রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-নির্যাতন-নিষ্পেষণ-শোষণ-হত্যা-ঘুম-খুন যখন মাত্রা অতিক্রম করে, বৈষম্য যখন সীমা পার করে দেয়, উন্নয়ন যখন শুধু দলীয় নেতার উন্নয়ন হয়, মেগা প্রজেক্ট বলতে যখন প্রশাসন ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার বুঝায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যখন বিরোধী মত দমন করা হয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যখন বিদেশি কালচার আমদানি হয়ে যায়, বন্ধুত্বের নামে যখন আধিপত্যবাদকে লালন-পালন করা হয়, জঙ্গী দমনের নামে যখন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হত্যার উৎসব পালন করা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটার নাম দিয়ে যখন দলীয় ক্যাডার নিয়োগ দেয়া হয়, নির্বাচনের নামে যখন প্রহসন করা হয়, মিডিয়ার স্বাধীনতা মানে যখন দল ও নেতার স্তুতি গাওয়ানো বুঝায়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মানে যখন ঋণের বোঝা আর টাকা পাচারের মাধ্যম হয়, বাকস্বাধীনতার নামে যখন ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে, সুপারিশের নামে ঘুষের লেনদেন বেড়ে যায়, প্রশাসন যখন দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালন করে; এককথায় দেশ যখন রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে তখন দেশকে রাষ্ট্রের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করতে একদল জানবাজ লোক তৈরি হয়ে যায়। যারা স্বপ্ন দেখে স্বাধীনতার, যারা লড়াই করে মুক্তির জন্য। এই সঙ্ঘবদ্ধ লোকের জন্য প্রয়োজন ফলার মতো তীক্ষè ভাষা, যা জালিমের মসনদ কাঁপিয়ে দেবে। সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, যাতে নড়ে যায় জালিমের মসনদ। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যায় বিশাল পরিবর্তন। কেউ কেউ তাকে বলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে জুলাই বিপ্লব কিংবা কেউবা আবার দ্বিতীয় স্বাধীনতা। তবে যে যাই বলুক, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিজয়ে নব্য ফেরআউনের একান্ত উত্তরসূরি ছাড়া সবাই খুশি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে জনগণ। মনে হচ্ছে দেশের উপর থেকে সরে গেছে শকুনের হিংস্র থাবা, কালো মেঘের আস্তরণ।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন নিতান্ত ছত্রিশ দিনের আন্দোলন বললে কিছুটা ভুল হবে। এই আন্দোলনের গ্রাউন্ড লুকায়িত আছে দীর্ঘ পনেরো বছরের অপশাসনের মধ্যে। কিন্তু ২০১৮ সালে জন্ম নেয়া কোটা আন্দোলন ২০২৪ সালে ফিনিক্স পাখি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। ছাত্র-সমাজ নতুন রূপে রুখে দাঁড়ায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে। “বাংলাদেশ কোটা সংস্কার আন্দোলন” অগ্রগামী হয়ে গঠন করে “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামের প্লাটফর্ম। প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন থাকলেও সরকারের দমন-পীড়নে সেটি রূপ নেয় অসহযোগ আন্দোলনে। যুক্ত হয় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। দলীয় এবং প্রশাসনিক সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করেও আন্দোলন বানচাল করতে পারেনি লেডি হিটলার খ্যাত শেখ হাসিনা। ব্যর্থ হয় সকল গোয়েন্দা সংস্থা। বিজয় আসে দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী জনতার। পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দালিলিক স্বাক্ষী কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সংগঠক ও সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম মাসুম রচিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বইটি।

পুরো বইটিকে লেখক ৩৫টি অনুচ্ছেদে ভাগ করলেও মূলত বইটিকে ৫ ভাগে বিভক্ত বলা যায়। যেমন : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, আন্দোলনের রোজনামচা, স্লোগান-গান-কবিতা-গ্রাফিতির শক্তি, প্রভাবক হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ ও ইতিহাস সংরক্ষণ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ১৯৭২ সালে কোটা প্রথার প্রবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও দুর্নীতির অভিযোগের ফিরিস্তি টানেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে ২০২৪ সালে এসে কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনে রূপ নেয় তারও ধারাবাহিকতা আলোচনা করেন লেখক। আন্দোলনের রোজনামচা লিখতে গিয়ে লেখক ১ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা করেন। সেখানে কোথায় কীভাবে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কর্মসূচি কী কী ছিল কিংবা আন্দোলন পরিচালনার নির্দেশনাসমূহও লিপিবদ্ধ করেন তিনি। সারা দেশের সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যাল ও মাদ্রাসার ভূমিকাও উঠে আসে লেখায়। বাদ যায়নি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কথা। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ও ঘটনাগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করেছেন। যেমনÑ আবু সাঈদের শাহাদাত, ৯ দফার ঘোষণা, ১ দফা থেকে অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি। নজরুলের গান ও কবিতা বিপ্লবের অনুপ্রেরণা, স্লোগান নয়, যেন শব্দবোমা, জেন-জি এবং গ্রাফিতি প্রভৃতি শিরোনামের লেখায় আন্দোলনে যেসব গান, কবিতা, স্লোগান অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তা আলোচনা করা হয়েছে। আন্দোলন কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাই রিকশাওয়ালা থেকে অধ্যাপক, নাট্যশিল্পী থেকে র‌্যাপার, মুক্তিযোদ্ধা থেকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক থেকে কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী থেকে দিনমজুর, রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ভূমিকাও অতুলনীয়। এছাড়া এই আন্দোলনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো অংশগ্রহণ ছিল আমাদের মা-বোনদের। সেলিব্রিটি ও সাধারণ মানুষ একাকার হয়েছে এই আন্দোলনে। এই দিকটাও ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। সর্বশেষ ইতিহাস সংরক্ষণ বলতে বুঝিয়েছি, শহিদ ও আহত মানুষের সংখ্যা ও তালিকা প্রস্তুত, সমন্বয়কদের নামের তালিকা, প্রায় সমস্ত স্লোগান সংরক্ষণ এবং অন্তর্বর্তী সরকার পরিচিতি। বলা যায় একনজরে আন্দোলনে জানতে হলে বইটি দারুণ সহায়ক হবে বলে মনে হয়।

তবে ছোট্ট একটা নোকতা না দিলেই নয়। কিছু কিছু বর্ণনার ক্ষেত্রে হয়তো ধারাবাহিকতার প্যাটার্ন অক্ষুণœ রাখতে গিয়ে গতকাল কিংবা নির্দিষ্ট দিনের নাম উল্লেখ করেন লেখক। এতে করে মূল আলোচনা কিছুটা খাপছাড়া হয়ে যায়। কারণ পাঠক কোনো সাপেক্ষে আগামীকাল-গতকাল মিলাবে কিংবা দিনটাই বা কত তারিখের। যাই হোক আন্দোলন পরবর্তী সময়ে খুব অল্পদিনের মধ্যেই ১৯২ পৃষ্ঠার ডাউস বইটি প্রকাশিত হয়। তাই হয়তো কিছুটা সম্পাদনা ত্রুটি থেকে গেছে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে বিষয়টি লক্ষ্য রাখবেন লেখক ও প্রকাশক।

মিজানুর রহমান শামীমের নান্দনিক প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেন শব্দশিল্প প্রকাশন। দাম রাখা হয় চারশত আশি টাকা।