‘মৃত্যু বণিকের’ মহতি উদ্যোগ

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের নাম হচ্ছে নোবেল পুরস্কার। যারা এ পুরস্কার পান তাদেরকে বিশ্বে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ কারণে বিশ্বের অনেক নামি দামি মানুষের আকাক্সক্ষা থাকে এই পুরষ্কার টি লাভ করার জন্য।

১৯০১ সাল থেকে মানবতার কল্যাণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল ও অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন বা মানবকল্যাণমূলক অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের জন্য প্রদান করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে পুরস্কারটি মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছে। তবে যার নামে এই পুরস্কারটি দেয়া হচ্ছে সেই আল ফ্রেন্ড নোবেল কিন্তু জীবিত থাকাকালে পরিচিতি পেয়েছিলেন মানবতার দুশমন বা ‘মৃত্যুদূত’ হিসেবে। কেননা তিনি ডিনামাইড আবিষ্কার করেছিলেন যা ছিল সে সময় ব্যবহৃত বারুদের চেয়ে উচ্চ মাত্রার বিষ্ফোরক যা যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করা হতো। এ নিয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে।

আলফ্রেদ বের্নহার্ড নোবেল (জন্ম: ২১ অক্টোবর, ১৮৩৩ - মৃত্যু: ১০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬) ছিলেন একজন সুয়েডীয় রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা। ১৮৬৭ সালে ডিনামাইট আবিষ্কার করে নোবেল বিপুল সম্পদের মালিক হন। এছাড়াও তিনি ছিলেন বিখ্যাত ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোফোর্স এর মালিক। এক সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এ কারণে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মৃত্যুর বনিক’। একবার হলো কি, (১৮৮৮ সালে) আলফ্রেড নোবেল জীবিত থাকাকালেই তাঁর নামে ভুলবশত একটি মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘মৃত্যুর বণিকের মৃত্যু’।

আসলে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর বড় ভাই লুডভিগ নোবেলের। কিন্তু ফরাসি সংবাদপত্রগুলো ভেবেছিল আলফ্রেড নোবেল মারা গেছেন এবং এই শিরোনামে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়, যা পরবর্তীতে নোবেলকে গভীরভাবে বিচলিত করে। নিজের এই খারাপ পরিচিতি নিয়ে তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এই ঘটনার পর তিনি তাঁর বিশাল সম্পদ মানব কল্যাণে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে নোবেল পুরস্কার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রতিবছর ছয়টি ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য নোবেল স্মারক পুরস্কার দেয়া হয়। এ ক্ষত্রগুলো হলো - পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শান্তি। তবে ১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেভেরিগেস রিক্সব্যাঙ্কের সৌজন্যে অর্থনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।

চলতি বছর মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ধরা হয়েছে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা (ঝঊক)। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা (এক ক্রোনা সমান ১২.৯০ টাকা ধরে)। নোবেল পুরস্কার বিজয়ীকে মূলত তিনটি উপহার প্রদান করা হয়।

এগুলো হলো- স্বর্ণপদক, যা ১৮ ক্যারেট সবুজ সোনায় তৈরি এবং ২৪ ক্যারেট সোনায় প্রলেপিত পদক। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া একটি সম্মাননাপত্র সনদ ও অর্থ পুরস্কার হিসেবে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা, যা বিজয়ীকে দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে একাধিক বিজয়ী হলে তাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। আর নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা সাধারণত এই অর্থ পুরস্কার বিভিন্ন দাতব্য কাজে দান করেন, যা মানবতার কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এ বছর পদার্থ, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে তিন জন করে মোট নয় জন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়েছে। পদার্থ নোবেল পুরস্কার পাওয়া তিনজন বিজ্ঞানী হলেন: জন ক্লার্ক (যুক্তরাজ্য), মিশেল এইচ. ডেভোরেট এবং জন এম. মার্টিনিস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। তারা বৈদ্যুতিক সার্কিটে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং শক্তি পরিমাপ বা এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন-এর ওপর গবেষণার জন্য এই সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেছেন।

রসায়নে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড রবসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমর এম. ইয়াঘি। ধাতু-জৈব কাঠামোর উদ্ভাবনের জন্য তাদের মনোনীত করা হয়। ওমর এম. ইয়াঘি ফিলিস্তিন বংশোদ্ভুত মুসলিম বিজ্ঞানী।

চিকিৎসায় যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন ম্যারি ই. ব্রুনকো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচি। মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যপ্রণালী বিষয়ে গবেষণার জন্য দুই মার্কিন ও এক জাপানি গবেষক এই পুরস্কার পেলেন।

এছাড়া সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহরকাই এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো।