মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
১.১. লিটল ম্যাগাজিন: সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও আদর্শগত অবস্থান
লিটল ম্যাগাজিন হলো এমন সাময়িকী যা প্রচলিত বাণিজ্যিক সাহিত্যধারাকে প্রত্যাখ্যান করে শিল্প, সাহিত্য ও মননের ব্যতিক্রমধর্মী অভিব্যক্তিকে মুদ্রিত রূপ দেয়। এই প্রকাশনা সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ার চেষ্টা করে না; বরং শৈল্পিক ঔৎকর্ষ, নিরীক্ষা (experimentation) এবং গতানুগতিকতাকে অস্বীকার করার দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক প্রথা বা ‘এস্টাবলিশমেন্ট’-কে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং ‘অ্যাভাগার্ড’ (Avant-garde) চিন্তাধারার বাহন হিসেবে কাজ করা। এজরা পাউন্ড (EzraPound)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, যে ম্যাগাজিন লাভের দিকে যত বেশি গুরুত্ব দেয়, সেটি অপ্রচলিত বা পরীক্ষামূলক বিষয়বস্তু প্রকাশের ঝুঁকি তত কম নিতে পারে। ফলে, লিটল ম্যাগাজিন তার অবাণিজ্যিক চরিত্র রক্ষার মাধ্যমেই তার আদর্শিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ এবং আমেরিকায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়, যা ছিল প্রথাগত প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প-সাহিত্যিক চিন্তার বিরুদ্ধে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ। এই মাধ্যমটি মূলত সাহিত্যের “নার্সারি” হিসেবে কাজ করে, যেখানে লেখকেরা তাদের শৈল্পিক স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ওপর জোর দেন এবং মন্তব্য বা সমালোচনার চেয়ে শিল্পকেই অগ্রাধিকার দেন। বুদ্ধদেব বসু যেমনটি মন্তব্য করেছিলেন, বিশেষ কোনো সময়ে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে, একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে এরা আবির্ভূত হয় এবং সেইটুকু সম্পন্ন করেই বিদায় নেয়; এই কারণেই স্বল্পায়ু হওয়াই এদের ধর্ম। এই গতিপ্রকৃতি প্রমাণ করে যে লিটল ম্যাগাজিন হলো নতুন সাহিত্যিক আন্দোলনের জন্মস্থান, কোনো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য প্রদর্শনের স্থান নয়। এটি তার স্বাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিপরীত স্রোতে চলার কৌশল অবলম্বন করে।
১.২. ইউরোপে লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম: পুঁজিবাদ বিরোধী বিদ্রোহ ও নন্দনতাত্ত্বিক অনুসন্ধান (১৮৪০-১৯০০)
ইউরোপে লিটল ম্যাগাজিনের উদ্ভব ছিল মূলত নন্দনতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক নবজাগরণের ফল। প্রথম প্রভাবশালী উদাহরণ হিসেবে Ralph Waldo Emerson এবং Margaret Fuller সম্পাদিত The Dial (বোস্টন, ১৮৪০-৪৪) বিবেচিত হয়, যা ট্রান্সেন্ডেন্টালিজম দর্শনের মতো নতুন চিন্তার প্রতিপাদক ছিল। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডে প্রকাশিত The Savoy (১৮৯৬) সরাসরি ভিক্টোরিয়ান বস্তুবাদ (Victorian Materialism) এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে উদারপন্থী ও সাম্যবাদী লেখকদের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে।
এই শৈল্পিক বিদ্রোহের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল পূর্ববর্তী যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মোচনের মাধ্যমে। রেনেসাঁস যুগে সারভান্টেস তার Don Quixote এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়র তার Hamle নাটকের মাধ্যমে আখ্যানমূলক উদ্ভাবনে প্রাণবন্ত গতি তৈরি করেন। পরবর্তীকালে এনলাইটেনমেন্ট বা যুক্তিবাদের যুগে ভলতেয়ার ও রুশো ব্যঙ্গ এবং উপন্যাসের মতো ফর্ম ব্যবহার করে সামাজিক সমালোচনাকে সাহিত্যে স্থান দেন। রোমান্টিক যুগ জার্মান চেতনায় পুষ্ট গ্যেটের Faust এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার মধ্য দিয়ে জাতীয় সাহিত্যের উত্থানকে প্রতিফলিত করে। এই দার্শনিক ও শৈল্পিক পটভূমি অ্যাভাগার্ড সাহিত্যের জন্মভূমি তৈরি করেছিল। ১৮৯০-এর দশকে The Yellow Book, The Evergreen, The Savoy এবং The Pageant- এর মতো পত্রিকাগুলো ‘অ্যাভাগার্ড’ শিল্পীদেরকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়, যারা নন্দনতাত্ত্বিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করতেন।
প্রাথমিকভাবে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল নন্দনতাত্ত্বিক বা শৈল্পিক বিদ্রোহ হিসেবে (aesthetic avant-garde) । কিন্তু এই আন্দোলন দ্রুতই সমাজের রাজনৈতিক র্যাডিক্যাল চিন্তাধারার সঙ্গে মিশে যায়। শিল্প যখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে চায়, তখন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজের স্থিতাবস্থা এবং বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণকে প্রত্যাখ্যান করার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদ ও প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিদ্রোহের আশ্রয় গ্রহণ করে, যা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে তার শৈল্পিক স্বাধীনতার পথ ধরে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।
১.৩. আধুনিকতা ও লিটল ম্যাগাজিন: অ্যাভাগার্ডের উন্মোচন
বিশ শতকের গোড়ার দিকে লিটল ম্যাগাজিনগুলি আধুনিকতাবাদ (Modernism) আন্দোলনে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, যা মূলত লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরেই বাস্তবে রূপ নেয়। এ সময়ে প্রকাশিত Poetry: A Magazine of Verse (শিকাগো, ১৯১২) এবং Margaret Anderson-এর The Little Review (১৯১৪-২৯) ছিল অন্যতম প্রভাবশালী লিটল ম্যাগাজিন। আমেরিকান কবি ও সমালোচক এজরা পাউন্ড (Ezra Pound) এই আন্দোলনের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; তিনি Poetry এবং The Little Review উভয়ের ‘বিদেশি সংবাদদাতা’ হিসেবে কাজ করতেন। তার মতো ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণে লিটল ম্যাগাজিন বিশ্বব্যাপী একটি আন্তঃসীমান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগ তৈরি করে।
আকৃতি ও নিরীক্ষার দিক থেকেও লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। প্রথম দিকের ডাডা (Dada) পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে নারীবাদী, কুইয়ার এবং ডিজিটাল পাবলিশিং নেটওয়ার্ক পর্যন্ত এই মাধ্যমটি অ্যাভাগার্ডকে একটি অস্থায়ী ও ভিন্নধর্মী সম্প্রদায় হিসেবে বুঝতে সাহায্য করে। ষাটের দশকে মিমোগ্রাফ যন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে “mimeo revolution” নামে এক ধরনের পরিবর্তন আসে, যার ফলে প্রকাশনা খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। প্রযুক্তির এই উন্নয়ন প্রকাশনা খরচ কমিয়ে দেওয়ায় সাহিত্যকে আরও বিকেন্দ্রীভূত করে এবং এটি র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাছে পৌঁছানোর নতুন সুযোগ তৈরি করে। এই গতিপ্রকৃতি প্রমাণ করে যে লিটল ম্যাগাজিনের শৈল্পিক স্বাধীনতা ও পরীক্ষামূলক প্রকৃতি তার অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিপরীত স্রোতে চালিত হয়।
বিশ্বব্যাপী লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের বিস্তার ও আত্ম-পরিচয়ের রূপান্তর
২.১. লিটল ম্যাগাজিনের আন্তর্জাতিক পরিভ্রমণ: উপনিবেশ-উত্তর বিশ্বে এর গতিপথ
১৮৮০ সালের পর থেকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ইউরোপ ও আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়। যদিও এর মূল চর্চা ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকশিত হয়েছিল, তবে ফরাসি, জার্মান এবং ভারতীয় সাহিত্যেও এর প্রভাব দেখা যায়। উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রগুলিতে এর ভূমিকা ইউরোপের চেয়ে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। ইউরোপে যখন এই ম্যাগাজিনগুলি শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সাড়া দিয়েছিল, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফ্রিকাতে লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান ভূমিকা ছিল উপনিবেশবাদ এবং নব্য-উপনিবেশবাদের (neocolonization) বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করা। অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশবাদ ((post-colonization) ও উপনিবেশ-মুক্তির (decolonization) প্র্রধান বাহন হয়ে ওঠে।
এই আন্তর্জাতিক বিস্তারে ‘ভ্রমণকারী সম্পাদক’ (Trav eling Editor)-এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এঁরা মহাদেশ এবং সাহিত্যিক অঙ্গনগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করতেন, যা কেবল নব্য সাহিত্যিকের জন্ম নয়, বরং উত্তর ও দক্ষিণের পত্রিকাগুলোর মধ্যে ক্ষমতার গতিপ্রকৃতি বুঝতেও সাহায্য করত। এই বিস্তার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ঐতিহাসিক অভিযোজন ক্ষমতাকে প্রমাণ করে, যা বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে সক্ষম ছিল।
২.২. বৈশ্বিক দক্ষিণ (Global South)-এ লিটল ম্যাগাজিন: জাতীয় ও আঞ্চলিক সাহিত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত
উত্তর আধুনিকতাবাদী লিটল ম্যাগাজিনগুলি বৈশ্বিক উত্তরে (Global North) বিশ্বজনীনতা বা ‘denationalized internationalism’-এর দিকে ঝুঁকলেও, বৈশ্বিক দক্ষিণ (Global South)-এ এর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ঔপনিবেশিক প্রভাব মুছে ফেলে নতুন জাতীয় পরিচয় (National Identity) এবং ভাষাভিত্তিক স্বকীয়তা নির্মাণ করা।
ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নিপীড়িত জাতিগুলোর কাছে এই প্রকাশনাগুলি বিচ্ছিন্ন না থেকে বরং এমন আন্তঃসীমান্ত সংযোগ তৈরি করে যা আগে কখনো বিদ্যমান ছিল না। কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো ((Ngũgĩ wa Thiong’)-এর মতো চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করেন যে, ঔপনিবেশিক শক্তি কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণই করে না, বরং ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের মনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই তাদের মতে, ভাষার মুক্তি ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি উপনিবেশকের ভাষা ইংরেজি ত্যাগ করে মাতৃভাষা গিকুয়ু-তে লেখা শুরু করেন, যা বৈশ্বিক দক্ষিণে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষার প্রতীক। উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রগুলিতে লিটল ম্যাগাজিন তাই একটি শৈল্পিক প্ল্যাটফর্মের চেয়ে বেশি, এটি সাংস্কৃতিক স্থিতাবস্থা ভেঙে জাতিসত্তা ও ভাষার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
২.৩. শিল্প, সাহিত্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের প্রভাব
লিটল ম্যাগাজিনগুলি কেবল নব্য লেখক ও কবিদের লালন করে না, বরং এটি সমাজের জ্ঞান ও মননশীলতার স্তর উন্নত করতেও ভূমিকা রাখে। এদের মাধ্যমে সমাজের চলমান ধারার বিপরীতে ভিন্নধর্মী চিন্তা ও মতামতগুলি জনসমক্ষে আসে।
বিশ্বব্যাপী নাটকের ক্ষেত্রেও লিটল ম্যাগাজিন প্রভাবিত চিন্তার বিস্তার ঘটেছে। Bertolt Brecht-এর Alien-ation (যেখানে থিয়েটার একই সঙ্গে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যম) এবং Augusto Boal-এর Image Theatre (যা সমাজের সমস্যার সমাধানে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে) লিটল ম্যাগাজিনের অ্যাভাগার্ড ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। Brecht বিশ্বাস করতেন যে থিয়েটার কেবল বিনোদন নয়, বরং শিক্ষার মাধ্যম, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সচেতন হতে পারে। ইড়ধষ-এর পদ্ধতির মূলমন্ত্র ছিল থিয়েটারকে জনগণের মাধ্যমে এবং জনগণের জন্য তৈরি করা, যেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য দর্শকেরা সরাসরি অভিনয় প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
এই প্রকাশনাগুলি প্রায়শই গভীর দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক বিতর্ক শুরু করে। যেমন, বিংশ শতাব্দীতে ইমানুয়েল কান্টের ‘নিউ এস্থেটিকস’ (New Aesthetics) বা প্লেটো ও অ্যারিস্টটল-এর শিল্পতত্ত্বের imitation/delight and instruction) মতো জটিল তাত্ত্বিক আলোচনা লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় উঠে আসে। এভাবে লিটল ম্যাগাজিনগুলি তাত্ত্বিক ধারণাগুলিকে সরাসরি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করার কাজটি করে।
ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের উন্মেষ
৩.১. ভারতীয় প্রেক্ষাপটে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সূচনা ও প্রাথমিক প্রতিকূলতা
ভারতে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন বিশ শতকের প্রথম দিকে শুরু হলেও এটি ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে বাংলা, তামিল, মারাঠি, হিন্দি, মালয়ালাম এবং গুজরাটি ভাষার মতো বহু আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই আন্দোলন কেবল সাহিত্যিক প্রবণতা নয়, বরং একটি বহুভাষিক প্রকল্প হিসেবে কাজ করেছিল। মারাঠি সাহিত্যে Ashok Shahane-এর নেতৃত্বে এটি বেগবান হয়, এবং Dilip Chitre, Arun Kolatkar- এর মতো লেখকেরা পরিচিতি পান। গুজরাটি দলিত সাহিত্য (Dalit literature) এবং নারী সাহিত্যের বিবর্তনও এই আন্দোলনের মাধ্যমে ঘটে, যা প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে জাতীয় মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
ভারতীয় লেখক ও সম্পাদকদের একটি বড় সংগ্রাম ছিল ঔপনিবেশিক ভাষার (ইংরেজি) আধিপত্য ভাঙার মাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে ক্ষমতায়িত করা। অনেক ভারতীয় মডার্নিস্ট কবি, যেমন Arvind Krishna Mehrotra ইংরেজি ভাষার প্রকাশক ও পাঠকদের উদাসীনতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক ভাষার লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে নিজেদের স্বকীয় সাহিত্য ও জাতীয় আত্মপরিচয় নির্মাণের জন্য জরুরি করে তোলে। কলকাতায় স্থাপিত লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র (১৯৭৮ সাল থেকে সন্দীপ দত্ত পরিচালিত) এই আন্দোলনের সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৩.২. বঙ্গীয় সমাজে লিটল ম্যাগাজিন: বঙ্গদর্শন থেকে সবুজপত্র
বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২) বা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১)-এর মতো পত্রিকাগুলি পূর্বে প্রচলিত থাকলেও, এগুলি মূলত প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের বাহক ছিল।
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪)-কে যথার্থ অর্থে বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। সবুজপত্র গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল, যা বিজ্ঞাপনবিহীন, মননশীল এবং চিন্তনঋদ্ধ একটি পত্রিকা। এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো চলিত গদ্যের (Cholito Godzo) প্রবর্তন করা, যা সমকালের গদ্যরীতির বদল ঘটায়। এই পত্রিকার প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রতিষ্ঠিত লেখকেরও গদ্যরীতি পরিবর্তিত হয়েছিল।
সবুজপত্র-এর মতো লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে বাংলায় এমন এক সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটে, যেখানে নন্দনতাত্ত্বিক স্বাধীনতা রাজনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার ভিত্তি রচনা করে।
৩.৩. কল্লোল যুগ (১৯২৩) এবং রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত সাহিত্য রচনার আকাক্সক্ষা
সবুজপত্র-এর দেখানো পথে ১৯২০-এর দশকে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন পূর্ণ গতি পায়। কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭) এবং পূর্বাশা (১৯৩২)-এর মতো পত্রিকাগুলো এই প্রবাহকে বেগবান করে। এই পত্রিকাগুলির লেখকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করা। তাদের সংগ্রামটি ছিল মূলত “প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক পুরাতন তন্ত্রের” (literary ancien regime) বিরুদ্ধে।
৩.৪ ‘শিখা’ ও ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজর প্রতিনিধিত্ব:
“শিখা” ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র। ১৯২৬ সালে ঢাকায় গঠিত এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজের মধ্যে জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল সাহিত্যিক আন্দোলনকে উৎসাহ দেওয়া। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই ১৯২৭ সালের ৮ এপ্রিল (চৈত্র ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) “শিখা”র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার শিরোনামে ছাপা হতো একটি মূলমন্ত্র: “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”
“শিখা” মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন আবুল হুসেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেন, চতুর্থ সংখ্যার সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ এবং পঞ্চম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন আবুল ফজল। তবে আর্থিক ও প্রকাশনাগত দায়িত্ব প্রায় পুরোটা সময়ই বহন করেন আবুল হুসেন। ১৯৩২ সালে তিনি ঢাকা ত্যাগ করলে “শিখা”র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, তবুও “শিখা” পত্রিকা সমকালীন সমাজ ও সাহিত্যজগতে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ এবং আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মুসলিম সমাজের ভেতরে এক নতুন চিন্তার ধারা ও আলোচনার ক্ষেত্র উন্মোচন করে।
এই নব্য লেখক গোষ্ঠী ইউরোপীয় আধুনিকতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনেন। তারা বাস্তবজীবন, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে প্রথমবারের মতো তাদের রচনার প্রধান উপাদান করেন।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা (১৯৩৫) পত্রিকাটি এই সময়ের বিদ্রোহের একটি শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ ছিল। কল্লোল যুগের মাধ্যমে মনোবিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার ওপর জোর দেওয়া শুরু হয়, যা ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণার আমদানি ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। লিটল ম্যাগাজিন এখানে সাংস্কৃতিক স্থিতাবস্থা ভাঙার একটি “প্রকল্পনা” হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবস্থান ও অবদান
৪.১. ১৯৪৭-উত্তর পূর্ব বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন: ভাষা আন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার উত্থান
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন কেবল সাহিত্যচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি জাতীয় আত্মপরিচয় নির্মাণের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। জন্মলগ্ন থেকেই এটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ, উদার, ন্যায্যতা এবং অর্থনৈতিক সমতা ভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনার উত্থানে সহায়ক হয়। মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ও সুচরিতা চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত সীমান্ত (চট্টগ্রাম, ১৯৪৭-৫২) পত্রিকাটির নাম ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এটি প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিন শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক ছিল।
ষাট ও সত্তর দশকে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। ষাটের দশকের শেষের দিকে লিটল ম্যাগাজিনগুলি সমাজতন্ত্র এবং ছয় দফা কর্মসুচি (SixPoint Programme) নিয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, যা বামপন্থী আন্দোলন এবং মার্কসবাদী দর্শনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে স্বাধীনতার পর দৈনিক পত্রিকাগুলো সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ধারা কিছুটা হলেও দুর্বল হয়। তা সত্ত্বেও, সত্তর দশকে মুখপত্র (১৯৭২), মফিদুল হক সম্পাদিত গণসাহিত্য (১৯৭২), এবং আবিদ আজাদের কবি (১৯৭৫)-এর মতো পত্রিকাগুলি মুক্তচিন্তার মাধ্যমে সাহিত্যধারাকে গতিশীল রাখে।
৪.২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৭১) ও লিটল ম্যাগাজিনের বিপ্লবী স্বর
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে প্রকাশিত পত্রিকাগুলিতে স্বাধীনতার অনুষঙ্গ নতুন আঙ্গিকে দেখা দেয়। তবে এই সময়ের লিটল ম্যাগাজিন লেখকদের প্রধান সংগ্রাম ছিল সাহিত্যিক ancient regime-এর বিরুদ্ধে, যারা কৃত্রিম প্রথা ও রীতি চাপিয়ে দিয়েছিল। এই আন্দোলনটি লেখক ও শিল্পের নিজস্ব মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা এই বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন যে, আপোসহীন মনোভাব ও ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষা করা একজন লেখকের মৌলিক অঙ্গীকার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা ছিল কেবল সাহিত্যিক বিদ্রোহ নয়, বরং “মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশে”র মাধ্যমে রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত লোকায়ত (১৯৮২) পত্রিকাটির লেখকরা স্পষ্টতই “অন্যায়মুক্ত, অভাবমুক্ত নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে” চেয়েছিলেন। স্বৈরাচার ও রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে যখন মুক্তচিন্তা চর্চার অভাব দেখা যায়, তখন লিটল ম্যাগাজিনগুলিই সেই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। যারা মূলধারার সঙ্গে আপোস করেননি, তারা নিজেদের “সম্পূর্ণ লিটল-ম্যাগ লেখক” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। এভাবে লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের ক্ষেত্র নয়, বরং জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করে।
৪.৩. স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং আশির দশকের মননশীল ছোটকাগজ
আশির দশকে চিন্তার গভীরতা কিছুটা কমতে শুরু করলেও, এই সময়ে লোকায়ত (১৯৮২) তার মূল লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে। খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ (১৯৮৫) কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্যের মাধ্যমে মৌলিকত্ব ও মনন নিয়ে সমৃদ্ধ ছিল। নব্বইয়ের দশক ছিল বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের “প্রকৃত পুষ্প প্রস্ফুটন” (florescence) কাল। এ সময় প্রান্ত (Pranta), নদী (Nodi), নারী (Nri), মন্ত্র (Mantra), নির্মাতা (Nirantar) (যা নারায়ণগঞ্জ থেকে বের হতো) এবং বগুড়া থেকে প্রকাশিত বিপ্রতীক (Bipratik) -এর মতো পত্রিকাগুলো আন্দোলনকে ঢাকা-কেন্দ্রিকতার বাইরেও বিস্তার ঘটায়।
তবে এই সময়ে আন্দোলনকে একাধিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। মুদ্রণ ব্যয় বৃদ্ধি, বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির দুরূহতা এবং মানসম্পন্ন লেখা প্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত শ্রম ও সততার অভাব লিটল ম্যাগাজিনগুলির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
৪.৪. জাতীয় আত্ম-পরিচয় শিক্ষা ও সমাজ বিনির্মাণে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সমাজের বৃহৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করতে ব্যর্থ হলেও, এগুলো ব্যক্তি-উদ্যোগে তরুণদের মেধা-বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাগুলো “মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশে”র মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করে। যদিও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এর ব্যাপক চর্চা দেখা যায়, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর বৃহত্তর প্রভাব সীমিত ছিল, যা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে লিটল ম্যাগাজিনের সক্ষমতা তার “মুক্তবুদ্ধি” ও “স্বতন্ত্র বৈক্তিক স্বর” তৈরি করার মধ্যে নিহিত। তবে এর ব্যর্থতা হলো, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ও বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারা, ফলে মননশীল চিন্তাধারা প্রান্তিক প্ল্যাটফর্মে আটকে থাকে এবং জাতীয় আত্মপরিচয় বিনির্মাণে চিন্তার প্রভাব সীমিত হয়।
৪.৫: লিটল ম্যাগাজিন ও সৃজনশীল দার্শনিক আন্দোলন: “কালি ও কলম”, “শব্দঘর”, ও “নতুন এক দিগন্ত”
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে লিটল ম্যাগাজিন সবসময়ই বিকল্প সৃজনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ ধারক। মূলধারার প্রচলিত ধারা থেকে সরে গিয়ে নবীন ভাবনা, পরীক্ষামূলক সাহিত্য ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি করেছে এ ধরনের পত্রিকা। “কালি ও কলম” মূলত সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রশ্নে নতুন আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এর দার্শনিক ভূমিকা ছিল সাহিত্যকে কেবল সৃজনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতির চেতনা ও শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা। অন্যদিকে, “শব্দঘর” তুলনামূলকভাবে আধুনিক ও তরুণ প্রজন্মকেন্দ্রিক একটি লিটল ম্যাগাজিন, যেখানে নতুন লেখক, কবি ও চিন্তাশীলদের জন্য একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠে। এর দার্শনিক অবস্থান হলো ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সাহিত্যের ভেতর থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন ঘটানো। “নতুন এক দিগন্ত” আবার একেবারেই ভিন্ন মাত্রার প্রতিনিধিত্ব করেছে; এটি নতুন দৃষ্টিকোণ, ভিন্ন আঙ্গিক ও পরীক্ষামূলক সাহিত্যরীতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এর দার্শনিক অবস্থান ছিল প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন সম্ভাবনার সন্ধান করা।
এই লিটল ম্যাগাজিনগুলো সম্মিলিতভাবে মূলত একটি আন্দোলন রচনা করেছেÑসাহিত্যকে আধুনিক, বৈচিত্র্যময় ও মুক্তধারার দিকে নিয়ে যাওয়ার আন্দোলন। এরা মূলধারার সাহিত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং পাঠককে নতুনভাবে ভাবতে ও অনুভব করতে শিখিয়েছে। সেই অর্থে, “কালি ও কলম”, “শব্দঘর” ও “নতুন এক দিগন্ত” Ñতিনটি পত্রিকাই লিটল ম্যাগাজিন চেতনার মধ্যে দিয়ে বাঙালি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং সৃজনশীল মুক্তচিন্তার এক ধারাবাহিক দার্শনিক আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করেছে।
৪.৬ লিটল ম্যাগাজিন: বিকল্প ধারা ও সৃজনশীল স্বাতন্ত্র্য- “প্রেক্ষণ” ও “নতুন এক মাত্রা”
লিটল ম্যাগাজিন মূলধারার বাণিজ্যিক প্রকাশনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক ধরনের বিকল্প সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। “প্রেক্ষণ” ছিল এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা, যা এখন আর চালু নেই। এটি বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে। প্রেক্ষণ নতুন সাহিত্যধারা, শিল্প ও চিন্তার অনুশীলনকে সাহসীভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এক অর্থে, এটি ছিল মুসলিম আধুনিকতাবাদী ও প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের প্রেক্ষাগৃহ, যেখানে তরুণ লেখক ও চিন্তাবিদেরা নতুন ভাষা ও শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
অন্যদিকে, “নতুন এক মাত্রা” এখনও সক্রিয় থেকে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি শুধু সাহিত্য নয়, শিল্পচর্চা ও সমকালীন সংস্কৃতিকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছে। তাত্ত্বিকভাবে এর ভূমিকা হলো সাহিত্যের ভেতর সামাজিক বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে একত্রে নিয়ে আসা। এটি পাঠকের সামনে প্রশ্ন তোলে, কেবল সাহিত্য রচনা নয়, বরং সংস্কৃতির গভীরতর অর্থ খুঁজে বের করারও প্রয়োজন রয়েছে।
প্রেক্ষণ যেখানে মূলত সাহিত্য-ভাষার ভেতরে নতুনত্ব সৃষ্টিতে জোর দিয়েছিল, সেখানে নতুন এক মাত্রা ভিন্ন পথে চলেছেÑএটি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক সমন্বয় ঘটিয়ে একটি জটিল অথচ উন্মুক্ত পরিসর তৈরি করছে। ফলে প্রেক্ষণ ও নতুন এক মাত্রা একই ধারার উত্তরাধিকারী হলেও, তাদের দার্শনিক অবস্থান ভিন্ন। প্রেক্ষণ ছিল পরীক্ষামূলক সাহিত্য আন্দোলনের সাহসী মুখ, আর নতুন এক মাত্রা হচ্ছে সমকালীন সাংস্কৃতিক দর্শনের এক চলমান চর্চাক্ষেত্র।
‘তাইরান’: সমকালীন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের করণীয়
৫.১. ‘তাইরান’-এর সম্পাদকীয় দর্শন ও অঙ্গীকার: মুক্তমনা, স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ও বিশ্বসাহিত্যের সাঁতার
‘তাইরান’ সমকালীন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা পুরাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন যুগের মুক্তচিন্তার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। সম্পাদকীয় মতে, তাইরান হলো “সাহিত্য আকাশে উড়ে বেড়ানো মুক্তমনা এক নতুন ছোট কাগজ”, যা “বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ব সাহিত্যের বিশাল সমুদ্রে সাঁতার দিয়েছে।” এর প্রকাশভঙ্গি একবিংশ শতাব্দীর প্রতীকী রূপকে তুলে ধরেÑবর্ণনার বর্ণিল রঙ নিয়ে শিল্পীর তুলির বহুমাত্রিক আঁচড়ে এটি অলীক হতে হতে হঠাৎ জ্বলে ওঠা সমসাময়িক জীবনের জীবন্ত ছবি।
এই পত্রিকার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অর্থনৈতিক ও আদর্শিক স্বাধীনতা। সম্পাদকীয় পরিষদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে তাইরান-এর ব্যয় নির্বাহ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী, একক ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিসমষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে না। এটি সম্পাদনা পরিষদের উদ্যোগে সংগৃহীত বিজ্ঞাপন থেকে পরিচালিত হয়। সম্পাদক দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “হাত পাতিনি আমরা। হাত পেতে স্বকীয়তার প্রশ্ন তোলার সুযোগও করে দিতে চাই না।” এই “শিরদাঁড়া সোজা রাখা”র অঙ্গীকার এটিকে মূলধারার আপসকামী সাহিত্যিক প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখে। উপরন্তু, সম্পাদক তার নিজের মেয়ের নামে পত্রিকার নামকরণ করে ব্যক্তিগত এবং আন্তরিক অঙ্গীকারের গভীরতা প্রমাণ করেছেন।
তাইরান তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার পিছনে না ছুটে, বরং সোশ্যাল মিডিয়ার “তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার বাইরে থিতু হওয়া প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়” থাকে। তাদের লক্ষ্য হলো “ভাঁটিবাংলার সাহিত্য ফসল পাঠকের ঘরে পৌঁছে দিতে, সুদক্ষ কৃষকের ভূমিকা পালন করা” এবং “সবুজের ফাউন্টেন” আঁকিবুঁকি করা। এই স্বতন্ত্র অঙ্গীকার এবং মুক্তচিন্তার প্রকাশভঙ্গি তাইরান-এর আদর্শিক স্বাধীনতা এবং নমনীয়তার ভিত্তি তৈরি করে।
৫.২. ‘তাইরান’-এর বিষয়বস্তু ও মননশীলতার গভীরতা: সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শনের আন্তঃসম্পর্ক
তাইরান-এর প্রকাশিত পাঁচটি সংখ্যা (নভেম্বর ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫) গভীর মননশীলতা এবং বিষয় বৈচিত্রে্যর পরিচয় দেয়। পত্রিকাটি কেবল সাহিত্য প্রকাশে মনোযোগী নয়, বরং এটিকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
১. দর্শন ও তাত্ত্বিক ভিত্তি: তাইরান দর্শনের জটিল বিষয়গুলিকে তার পাতায় স্থান দিয়েছে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের শিল্পতত্ত্ব, ইমানুয়েল কান্টের ‘নিউ এস্থেটিকস’ নিয়ে বিশ্লেষণ। এছাড়াও, হাইডেগার (Heidegger) ও কিয়ের্কেগার্ড (Kierkegaard)-এর অস্তিত্ববাদ এবং মিশেল ফুকো (Foucoult) এর ক্ষমতা-জ্ঞান বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে পত্রিকাটি তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর জোর দেয়।
২. ইতিহাস ও জাতীয় আত্ম-পরিচয়: পত্রিকাটি বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়কে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করার একটি বৃহত্তর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এখানে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস (দারাশিকোহ, খানজাদা বেগম), বাংলার গৌরব ঈসা খাঁ, পলাশীর বিপর্যয় এবং ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর রায়নন্দিনী-এর মতো বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষত ফারসি সাহিত্য (খৈয়াম, হাফিজ, রুমি) এবং নজরুল ও ইকবালের মতো ব্যক্তিত্বের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে ‘তাইরান’ বাংলা সাহিত্যের ‘ভাঁটি অঞ্চলের’ সংস্কৃতির সঙ্গে বৃহত্তর ইসলামি জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ধারাকে পুনঃসংযুক্ত করার প্রচেষ্টা দেখিয়েছে।
৩. সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংবেদনশীলতা: পত্রিকাটি অত্যন্ত সমকালীন রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে হস্তক্ষেপ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক “জুলাই স্মারক ও দার্শনিক প্রেক্ষিত” নিয়ে গভীর আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিটল ম্যাগাজিনের ঐতিহ্যগত নৈতিক প্রতিরোধের ভূমিকা তুলে ধরে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)