বিল্লাল মাহমুদ মানিক

১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর শব্দের নিপুণ কারিগর কবি হেলাল হাফিজ নেত্রকোণা জেলার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বার নাম কবি খোরশেদ আলী তালুকদার এবং আম্মার নাম কোকিলা খাতুন। তাঁর প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’-র ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্বসাহিত্যে কবিতার জগতে এক বিস্ময়কর ঘটনা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে। এর প্রায় ২৬ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয় সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় একটি কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-র দুটি পঙক্তি হল -

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

ঊনিশশত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ঊনিশশত একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামের সময় এই পঙক্তি দুটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় দায়িত্বপালনকারী কবি হেলাল হাফিজ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, দ্রোহ, দেশপ্রেম, বিরহসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি বিভিন্ন আঙ্গিকে চমৎকার সব উপমায় বাংলা কবিতাকে সাজিয়েছেন। দুঃখের সহোদর কবি হেলাল হাফিজের প্রিয় একটি শব্দ ‘নিপুণ’। তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ‘নিপুণ’ বা ‘সুনিপুণ’ শব্দটিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন।

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের ৫৬ টি কবিতার মধ্যে সর্বপ্রথম ‘বেদনা বোনের মতো’ কবিতায় ‘নিপুণ’ শব্দের বাহারী ব্যবহারে মুগ্ধ হয় নিবিড় পাঠক। বেদনার আজন্ম সঙ্গী কবি একান্ত নিজের মতো করে দক্ষ শব্দচাষীর মতো ‘নিপুণ’ শব্দকে ব্যবহার করেছেন।

‘কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল

ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,

নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই

এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায়

বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়

যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো।’

‘ইচ্ছে ছিলো’ কবিতায় ‘সুনিপুণ’ শব্দের ব্যঞ্জনায় আন্দোলিত হয় কাব্যিক পাঠকের হৃদয়। এ কবিতায় প্রেমিক কবি নিজে রাজা হয়ে তাঁর প্রেমিকাকে সম্রাজ্ঞী করে প্রেমের সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছেন সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো।

‘ইচ্ছে ছিলো সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো, তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।’

‘উপসংহার’ কবিতার ৩ টি পঙক্তির যোগসূত্র স্থাপন করেছে সুদক্ষ ‘নিপুণ’ শব্দটি। ব্লটিং পেপারের মতো ক্ষতরস শুষে নিতে সিদ্ধহস্ত কবি বলেছেন -

‘আমার যতো শুভ্রতা সব দেবো,

আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার

সব কালিমা, সকল ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো।’

‘সম্প্রদান’ কবিতায় কষ্টের অতল সমুদ্রে সহাস্য ‘নিপুণ’ শব্দকে খোঁজে পাওয়া যায়।

‘আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে

নিদারুণ নম্র খননে

কী নিপুণ ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।’

‘কবুতর’ কবিতায় ‘নিপুণ’ শব্দের উপস্থিতি বাড়িয়েছে পাঠকের মনে শৈল্পিক আকর্ষণ।

‘নিপুণ সন্ধান করো

পাখির চঞ্চুতে চোখে কোমল পালকে

আমার বিস্তার আর বিন্যাসের কারুকাজ পাবে,

কী আমার আকাঙ্ক্ষিত গঠন প্রণালী আর

আমার কী রাজনীতি কবুতর জানে।’

‘কে’ কবিতায় ‘নিপুণ’ শব্দের উপস্থাপনায় রয়েছে কবির দারুণ মুন্সিয়ানা।

‘এতো প্রতিকূলতায় গতি পায় নিষ্ঠাবান প্রেমিক শ্রমিক,

আমি এক সে রকম পথিকের প্রতিকৃতি নির্ভুল দেখেছি।

ইদানীং চারদিকে সমস্বরে এক প্রশ্ন, - কে? কে? কে?

বেরিয়ে যে আসে সে তো এই পথে এইভাবে আসে, নিপুণ ভঙ্গিতে।’

‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থের ‘স্রোতস্বিনী ভালোবাসা’ কবিতায় ‘নিপুণ’ শব্দের ঝঙ্কারে আন্দোলিত হয় কবিতা-প্রেমিকের মন।

সুদক্ষ প্রণয়ের খেলায় সৃষ্টিলগ্ন থেকে চলছে পৃথিবী, আর এভাবেই চলবে কেয়ামত পর্যন্ত।

‘ আম্মা আব্বা

আব্বা আম্মা,

এমনি করে ভালোবাসা অযুত লক্ষ বছর ধরে

খেলছে নিপুণ ভবের খেলা,

সবাই যেণ প্রণয় পাখি, বুকের ভেতর প্রেমের মেলা।’