মুসলিম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো খিলাফত ব্যবস্থার উত্থান এবং পতন। সর্বশেষ ইসলামি খিলাফত, যার মূল কেন্দ্র ছিল তুরস্ক, ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু এই খিলাফতের পতন কেন ঘটেছিল?
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরিণতি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের একটি বৃহৎ অংশ অংশগ্রহণ করেছিল, এবং এই যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য (যেটি মুসলিম উম্মাহর সর্বশেষ খিলাফত ছিল) পরাজিত হয়। যুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যটি সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা শক্তিরা তা আরো দুর্বল করে তোলে। মুঘল, উসমানীয় সাম্রাজ্যসহ অনেক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে দেওয়া হয় বা তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়।
২. জাতীয়তাবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উত্থান
মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, যা মুসলিম খিলাফতের ঐক্যকে ভেঙে দেয়। মুসলিম শাসকরা তখন আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং নয়া রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে, যার ফলে ঐতিহ্যবাহী খিলাফতের কাঠামোকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়।
৩. পশ্চিমা শক্তির হস্তক্ষেপ
বিশেষত ব্রিটিশ এবং ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত ধরে মুসলিম বিশ্বের উপর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তারা খিলাফতকে একটি বাধা হিসেবে দেখত এবং বিভিন্নভাবে এর পতন ঘটানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এর ফলে খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা শক্তির পক্ষে এটি ভেঙে দেওয়ার উপযুক্ত সময় হয়ে ওঠে।
৪. আতাতুর্কের সংস্কার
মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আটাতুর্কের সংস্কার, যা আধুনিক তুরস্ক গঠনের পথ প্রশস্ত করে, তার মধ্যে খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার ঘোষণা ছিল অন্যতম। ১৯২৪ সালে এই ঘোষণা এসে পৌঁছায়, এবং তুরস্কের সংসদ খিলাফত বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
৫. অভ্যন্তরীণ সংকট এবং দুর্বল শাসন
অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকরা দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার শিকার হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল, যা খিলাফতকে আরও দুর্বল করে তুলেছিল। শাসকরা যথাযথ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যার ফলে মুসলিম বিশ্বে ঐক্যহীনতা সৃষ্টি হয়।
মুসলিম উম্মাহর সর্বশেষ ইসলামি খিলাফতটির বিলুপ্তি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং এটি মুসলিম বিশ্বের ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং ঐক্যের প্রতীক ছিল। এর পতন বিশ্ব ইতিহাসে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, যেখানে মুসলিম বিশ্ব আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছিল। তবে, আজও খিলাফতের স্মৃতি অনেক মুসলমানের হৃদয়ে জীবন্ত এবং এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা চলে।