ড. বি এম শহীদুল ইসলাম

যুগে যুগে বিভিন্ন আন্দোলনে কবি-সাহিত্যিকগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানও এর ব্যতিক্রম ছিল না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের বড় একটা অংশ ছিল ইংরেজ খেদাও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। তিনি যখন বলেন ‘ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন’ তখন তিনি ভগবান বলতে যে অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজকেই ইঙ্গিত করেন, তা বোঝা যায়। ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল; শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল’-এখানে তোদের বলতে যে ইংরেজদের বুঝানো হচ্ছে, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। নজরুলের কবিতার শক্তি এখানেই আসন গেঁড়ে বসেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক রচিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সরব হয়েছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। ছড়া-কবিতায় তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব উচ্চারণ করে গেছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে। ‘ভাষার গান’ তাঁর এক অমর সৃষ্টি। সে ভাষার গান চিরদিন গায়কের কণ্ঠে গান হয়ে থাকবে স্মৃতির আবরণে।

১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ও লেখকগণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র কবিতা ছোট গল্প, উপন্যাস লিখেন। বাংলা সাহিত্যে যার অবদান অনস্বীকার্য। পঞ্চাশের দশকে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের কবি-সাহিত্যিকরা অমর সাহিত্য রচনা করে গেছেন ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব গোটা বাঙালি জাতিকে নাড়া দিয়ে গেছে গভীরভাবে। একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা হারিয়ে যেতে বসেছিল জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের হাতে। গুম-খুন, আয়নাঘর, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের নরকপুরীতে পরিণত হয়েছিল আমার প্রিয় বাংলাদেশ। ৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। বিজয়ের উল্লাস ধ্বনিত হয়ে ওঠে ঢাকাসহ গোটা দেশ। কারণ একটি অশুভ জগদ্দল পাথরের উৎপাটন। জুলাই বিপ্লব নিয়ে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা যেভাবে সরব হন, তা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

বিশিষ্ট কবি, দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার এর একটি বই ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট এটা প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটা অংশ জুলাই বিপ্লবে সে বই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সে বই পড়ে তারা দিক-নির্দেশনা পেয়েছে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে। রাষ্ট্রচিন্তা প্রকাশনী থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন: বাংলাদেশের গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে’ বইটি নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, এই গ্রন্থটির পেছনে আমার নিজের ক্ষতবিক্ষত হৃদপিন্ডের অনেক টুকরা জড়িত। তিনি বলেন, ভেবেছি, একাত্তরের শহীদদের প্রতি কিছু দায় কি শোধ করা গেল? আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি যে, বাহাত্তরে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠন করতে পারিনি, সেই কাজ আমাদের অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য এই গ্রন্থ।

জুলাই বিপ্লবে কবিদের মধ্যে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাহবুব হাসান, আবদুল হাই শিকদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মোশাররফ হোসেন খান, তমিজ উদদীন লোদী, জগলুল হায়দার, সায়ীদ আবুবকর, জাকির আবু জাফর, মনসুর আজিজ, সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব, নয়ন আহমেদ, রেদওয়ানুল হক, ফজলুল হক তুহিন, তাজ ইসলাম, হাসনাইন ইকবাল, রফিক লিটন, হাসান নাজমুল, ড. শহীদ ইবনুল মজিদ প্রমুখ।

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মতো দেশপ্রেমিক কবি, আসাদ বিন হাফিজের মতো কবিরা বেঁচে থাকলে হয়তো আরো অনেক কিছু যুক্ত হতো বাংলা কাব্য জগতে। ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে রংপুরের আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সমস্ত বাংলাদেশ অগ্নিগিরির মতো ফুঁসে ওঠে। এ সময় কবি সায়ীদ আবুবকরও ফুঁসে উঠেন কবিতায় তিনি লেখেন;-পুকুরের পানির মতো এ নিস্তরঙ্গ মৃত্যুর শহরে আচমকা এ-কি? জীবনের উন্মাদনা! যে ছিলো অচল, ছুটছে সে উল্কার গতিতে। যে ছিলো নিথর, উড়ছে সে ঈগলের অধীর ডানায়। কী হলো হঠাৎ......?

আমি হতবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি আদনান, ফারহান, শাকিল ও আবু সাইদের রক্তে লাল হয়ে ঈগলের মতো উড়ছে আকাশে আমাদের- প্রাণের পতাকা আর বিশ কোটি বাঙালি ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে, কে জানে কোথায়।

মাহবুব হাসান তাঁর ‘বোবা-কালা জনগণ’ কবিতায় বলেন;

জনগণ কি বোবা-কালা হয়ে গেছে?

আমি ভাবছি মানুষের সহ্য ক্ষমতা

বা প্রতিবাদের গৌরব কি মিথ?

চৌদিকে সন্ত্রাস ওঁৎ পেতে আছে চিতার চৌকিতে

রাজনৈতিক ছত্রপতির ছায়ার ভেতরে!

তারা ভুলে গেছে

মিছিলের মানে, স্লোগানের মর্ম-ধর্ম,

প্রতিবাদের শব্দগুলো কি গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেছে?

আবদুল হাই শিকদার তাঁর ‘শহীদ আবু সাইদ’ কবিতায় বলেন:

সাঈদ সাঈদ বলে ডেকে ডেকে পাড়া মাত করি ,

(৬-এর পাতায় দেখুন)

(৭-এর পাতার পর)

ও পুত্র, বাপ আমার, ফিরে আয় ফ্যাসিবাদ উৎখাত করি।

সমস্ত বাংলা আজ সাইদ সাইদ

সাঈদের রক্ত আনে রাহু মুক্ত ঈদ।

তমিজ উদ্দীন লোদীর ‘ফেটে পড়ুক আশার গরিমা’ কবিতা থেকে;

এতো এতো আলো কোথায় ছিল

আলোর পাখিরা নিয়ে এলো আলো

ঘোরতর অন্ধকারে জ্বলে ওঠা , ফিনিক দেয়া আলো

ক্রমশ বিস্তৃত হলো।

জাকির আবু জাফর তাঁর ‘দীপ্ত বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেন;

স্বৈরাচারীর জগদ্দল আজ শেষ

নতুন স্বপ্নে হাসছে বাংলাদেশ।।

সংকট আর সংগ্রামে দৃঢ় বল

অনড় অটল বিশ্বাসে উচ্ছ্বল।

আত্মগর্বা উচ্চকণ্ঠ-রব

মানেনি কখনো, মানবে না পরাভব।

বীর-বীরত্বে বিস্ময় অনিঃশেষ

হাজার যুগের মুক্ত বাংলাদেশ।

ফজলুল হক তুহিনের ভাষায়;

সব ভুলে আবু সাঈদের হাত দুটি

হয়ে গেছে দোয়েলের ডানা- অলৌকিক ডানার উড়াল

বুক তার বাংলাদেশের রক্তাক্ত পতাকা!

কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক মোহাম্মদ রোমেল এর কাব্য “ অধরা শহীদি মিছিল “ (২০২৫) এর উল্লেখ করতে চাই। উদয় হাসানের মূল্যায়নে উক্ত কাব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে;

“এ কাব্যগ্রন্থের ভেতর যাপিত জীবন থেকে উঠে আসা বাংলার ভাবসম্পদের পাটাতনে দাঁড়িয়ে একটা এন্টিকলোনিয়াল গণ সাহিত্যের ভাব ও ভাষাকে রপ্ত আত্মস্থ এবং বিচিত্রভাবে প্রয়োগ করবার সজ্ঞান প্রয়াস ধরা পড়ে। ফ্যাসিবাদের নৃশংস স্মৃতির ফসিল এ কাব্য।

গাজী গিয়াস উদ্দিন এর “আবু সাঈদ” কবিতার ভাষ্য ছিল;

আবু সাঈদ জন্মায় না যুগে যুগে, ওর খুনে- মননে ছিল বোধ, শানিত চেতনা ; ওকে কেউই চিনত না ; মহাবীর আবু সাঈদ মৃত্যুঞ্জয়ী।

এসময় একের পর এক ‘দ্রোহের কবিতা’ সংকলন প্রকাশিত হতে দেখা যায়। জুলাই বিপ্লব নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে থাকে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন। এর মধ্যে সীমান্ত আকরামের ‘দ্রোহের কবিতা’ সংকলনটি উল্লেখযোগ্য। বাংলা একাডেমি জুলাই বিপ্লবের কবিতা ও ছোটগল্প নিয়ে আলাদা আলাদা সংকলন করার পরিকল্পনা নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

জুলাই বিপ্লবে ঊষর মরুতে ক্লান্ত বিদ্রোহীদের প্রশান্তময় নিমের ছায়ার মতো কাজ করে সাহিত্য। যোদ্ধাদের ক্লান্তদেহ শীতল জলের ছিটায় সতেজ করে তোলে কবিতা গান, তথা শিল্প-সাহিত্য।

একজন সাহসী প্রাবন্ধিকের চোখে জুলাই বিপ্লবের অগ্নি কাব্যিক চিত্র;

আজন্ম বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’। দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সিংহাসন নড়বড়ে করে শান্ত হয়ে গেলেন রণসঙ্গীতের এই বুলবুলি। হয়ে গেলেন আমৃত্যু নির্বাক। ২০২৪ , জুলাই মাস: বিষের বাঁশি হাতে জেগে উঠলেন নজরুল। প্রকম্পিত বাংলার রাজধানী ঢাকা; আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তাঁর বিদ্রোহী তোলে আবার নতুন ঝংকার-

“মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেদিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।”

মুক্তির নেশায় মাথায় পতাকা বেঁধে বিপ্লবীদের কণ্ঠে বাজিয়ে দিলেন-

“কারার ঐ লৌহকপাট

ভেঙে ফেল কর-রে লোপাট

লাথি মার ভাঙরে তালা

যতসব বন্দিশালা আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা

ফেল উপাড়ি”

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ছড়িয়ে পড়া সুরের মূর্ছনা স্পর্শ করে ফ্যাসিস্ট মুক্তি আন্দোলনে নিমগ্ন প্রতিটি মানুষকে। সকল ধর্ম-মত-আদর্শ একাকার হয়ে পুরো বাংলায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় একটি স্লোগান: ‘ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ চাই’। কী ভয়াবহ আন্দোলন:

রক্তের সাথে মিশেছে রক্ত! শিশুর রক্ত, যুবকের রক্ত, ছাত্রের রক্ত, ছাত্রীর রক্ত, মুসলিমের রক্ত, হিন্দুর রক্ত, রিক্সাওয়ালার রক্ত, পথচারীর রক্ত, অভিজাতবাসীর রক্ত, বস্তিবাসীর রক্ত। রক্তত্যাগের কী এক অভিন্নতা!! ঈগলের মতো দুহাত ছড়িয়ে......।

গীতিকার ইথুন বাবু ফ্যাসিবাদীদের রক্তচোখ উপেক্ষা করে মৌসুমী চৌধুরীর গলায় তুলে দিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠহার;

“দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা

কিছু বললে ধরছো চেপে সব জনগণের গলা।”

এভাবে শিল্প-সাহিত্য উদ্বুদ্ধ প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এরই মধ্যে ভেসে আরেক সৌম্য সুর-

“মুক্তির মন্দির সোপান তলে

কত প্রাণ হলো বলিদান

লেখা আছে অশ্রুজলে...”

বিপ্লবোত্তর দেশব্যাপী গ্রাফিতিতে প্রকাশ পেয়েছে আন্দোলনের সচিত্র প্রতিবেদন। তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগানে দেশের নানা রকমের অসংগতি তুলে ধরেছে নবস্বপ্নের শিল্পীরা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ফুটে উঠেছে গ্রাফিতিগুলোতে। এসব গ্রাফিতি দেখে উজ্জীবিত হয়ে পথচারীরা। একটা গ্রাফিতি ছিল , “চিরকাল বসন্তের বাহিরেও কিছু ফুল ফোটে।” কবি হাসান রুবায়াত লিখে রেখেছিলেন কোথাও, কিন্তু তরুণরা তা তুলে ধরলেন যা জুলাই বিপ্লবের মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

জাতিসংঘের অধিবেশনে স্বাপ্নিক প্রাণপুরুষ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রাফিতি আঁকা আর্টবুক জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের হাতে তুলে দেন। এসব আর্টবুকের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব সচিত্র প্রতিবেদন হয়ে দেশ হতে দেশে পৌঁছে যায়।

লেখক আবু জাফর সাঈদের ভাষায়; প্রয়াত, বর্তমান এবং সময়ের প্রয়োজনে আবির্ভূত হওয়া অনেক কবির কবিতা, শিল্পীর গান জুলাই বিপ্লবকে সফল করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বিপ্লবীদের শিরায় শিরায় উষ্ণ রক্তের ফোয়ার সৃষ্টি করেছিল এসব শিল্প-সাহিত্য। বিপ্লবীদের সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সৃষ্টিশীল এই মানুষগুলো। তবে স্বৈরাচারী জগদ্দল পাথরকে সরানোর জন্য আর কোনো দিন বাংলার মানুষের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত যেন না হয় সেটিই জাতির প্রত্যাশা।