সৌরভ হাছান হিমেল
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই বাংলার জাতীয় সাহিত্য পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ জাতীয় কবি তকমা থাকা সত্ত্বেও নজরুলের গায়ে যে দারিদ্র্যের দাগ লেগে আছে, এই দারিদ্র্য, তার পেশাগত উথান-পতন, তার ধর্মীয় টানাপড়েন সব মিলিয়ে নজরুলকে আজও অনেক বিশ্লেষক সাহিত্যের আসল কেন্দ্র নয়, প্রান্ত থেকে পড়েন। প্রশ্ন হলো, কেন? একজন দরিদ্র, তথাকথিত প্রান্তিক পরিবারের সন্তান সাহিত্যের গভীরে যেতে পারে এই ভাবনাটা আমাদের আত্মঅহমে কোথায় যেন খটকা দেয় না তো? জলজ্যান্ত জাতীয় কবি হয়েও বেচারা নজরুলের গালে তিলের মতো লেগে থাকা দরিদ্রর পরিচয় থেকে তাকে কখনোই মুক্তি দেন নাই দুই বাংলার সাহিত্য বিশ্লেষকরা। তাদের প্রশ্ন হইলো নজরুলের মত গরীবের পোলা বিদ্রোহীর ম্যাটেরিয়ালগুলো পাইলো ক্যামনে? এই অনুসন্ধানিতা একেকজনের মুখ দিয়ে একেক ভাবে বেরিয়ে এসেছে। নজরুলের চারপাশের মানুষদের প্রভাব নিয়ে এত বিশ্লেষণ যে, মাঝে মাঝে মনে হয় নজরুল ছিলেন এক অচেতন শরীর, যাকে মুজাফফর আহমদ দেশপ্রেম শিখিয়েছেন, আলী আকবর প্রেম, বজলে করিম উর্দু ভাষা, আর গিরিবালা দেবী খাইয়ে-পড়িয়ে রেখেছেন। এমন সব তত্ত্ব হাজির হয়, যেখানে মনে হয় নজরুল যেন নিজে কিছু নন তিনি কেবলই এক বাহক, যাঁর ভেতর দিয়ে অন্যের প্রভাব বা চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরনের বিশ্লেষণ যেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে চায় নজরুলের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ছিল না, কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে বিদ্রোহী লিখল কে? যে কবিতা আজও বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে আছে, যে ভাষা এমন সাহস ও সৃজনশীলতায় বিস্ফারিত তা কি কেবল ধার করা ভাবনায় সম্ভব? নজরুল যদি বিভিন্ন উৎস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেনও, সেই অনুপ্রেরণাকে নিজের করে প্রকাশ করার যে ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছেন, সেটাই তো প্রকৃত সৃষ্টিশীলতা। মোহিতলাল, হুইটম্যান, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা তুলে ধরে যদি বলা হয় নজরুল কেবলই এক রন্ধনশিল্পী, যিনি নানা উপাদান মিশিয়ে পরিবেশন করেছেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে রন্ধন কি নিজেই এক সৃষ্টিশীলতা নয়? নজরুলের ব্যক্তিজীবনের প্রতি যে অসংখ্য ব্যাখ্যা ও মনস্তাত্ত্বিক কৌতূহল আমরা দেখি, তা কি একই মাত্রায় রবীন্দ্রনাথের বেলায় দেখা যায়? নজরুলের জামার রঙ, উর্দির ইতিহাস, প্রেমিকার চুলের কাঁটা পর্যন্ত গবেষিত হয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত বিপন্নতা নিয়ে তেমন চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় না কেন? কারণটা সহজ রবীন্দ্রনাথ শ্রেণিগতভাবে গ্রহণযোগ্য, নজরুল নয়।
সাহিত্যিক গভীরতা এই ধারণাটি কি আদৌ নিরপেক্ষ? সাহিত্যের ব্যপ্তি বা তাৎপর্য মাপার যে যন্ত্র আমাদের হাতে আছে, সেটি কি নিখুঁত? নাকি সেটি শ্রেণির কৌতুকাচ্ছাদনে ভরা? নজরুলের কবিতা বা গানের গভীরতা নিয়ে যত সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের বেলায় সেই একই প্রশ্ন কেন আসে না? রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের একঘেয়েমি, জীবনানন্দের বিষণ্নতা এসব কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে? একজন কবি পুরাণ নিয়ে কাজ করলে, আমরা আশা করি তিনি যেন সেখান থেকে এমন কিছু ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনেন, যা আমাদের চেনা জগৎকে নতুনভাবে দেখায়। এই প্রত্যাশা কি সবার ক্ষেত্রে সমান? নজরুল যদি দুর্বাসা মুনির নাম ব্যবহার করেন কিন্তু কোনো নতুন গল্প না বলেন, তাতেই বলা হয় এখানে গভীরতা নেই। অথচ অন্য কবিদের বেলায় এমন ভাসাভাসা উল্লেখই হয়ে ওঠে রূপক বা দার্শনিক ব্যাখ্যার অংশ। তাহলে কি ব্যাখ্যার মানদণ্ডও কবির নাম ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে পাল্টায়? অনেকেই বলেছেন নজরুলের শ্যামা সংগীত নাকি অন্তর্জাত অনুভব থেকে আসেনি বরং কালীর মানত পূরণ হওয়ার একধরনের কুসংস্কার থেকেই এসেছে। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস, ভক্তি বা মানতের অভিজ্ঞতা কি শুধু কুসংস্কারেই মাপে যায়? যদি সেই মানতের ভিতরে থাকে এক গভীর বেদনাবোধ, এক অন্তরঙ্গ মানসিক সংলাপ, তাহলে সেটা কি আমাদের বোধের বাইরের কোনো সত্য নয়? নজরুলের ধর্মভাবনা যদি তার উপলব্ধির ভাষায় প্রকাশ পায় ধর্মই যদি তার আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যম হয় তবে সেটাকেই কি আমরা অগভীর বলে ফেলে দিতে পারি? ছেলের মৃত্যুর পর নজরুলের ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়াকে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা মনে করেছেন। তার সেকুলার ইমেজে সেটা একটা দাগ এমন বিশ্লেষণও পাওয়া যায়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে আত্মিক ভরসার আশ্রয় খোঁজা কি অস্বাভাবিক কিছু? শোক মানুষের চিন্তাকে গভীর করে, প্রশ্ন জাগায়, আবার কখনও শূন্যতায় ঠেলে দেয়। সেই শূন্যতা পূরণের জন্য ধর্ম, ভক্তি, প্রার্থনার দিকে ঝুঁকে পড়া তো মানবিক প্রবণতা। জীবনানন্দ হোক বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন। তাদের ক্ষেত্রে আমরা সহানুভূতির চোখে দেখি, কিন্তু নজরুলের ক্ষেত্রে সেটা কটাক্ষের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কেন? কারণ কি শুধু এই যে নজরুল ছিলেন শ্রেণিগতভাবে নিন্ম স্তরের মানুষ?
তুরস্কের কামাল পাশা আর আনোয়ার পাশা দুই পক্ষের রাজনীতিক।
নজরুল দুজনকেই কবিতা উৎসর্গ করেছেন, তাই তাকে রাজনীতি না বোঝা নির্বোধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী নজরুলকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভুলে যান যে তার মূল আকর্ষণ ছিল সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী চেতনার প্রতি। নজরুল ছিলেন না সরলরৈখিক ভাবনার মানুষ; তার ভাবনায় ছিল আবেগ, তীব্রতা, আর গভীর মানবিক বোধ। এই জটিলতা অনেকের চোখে দুর্বলতা হয়ে দেখা দেয়, কিন্তু আসলে সেটাই ছিল নজরুলের শক্তি, একজন প্রকৃত কবির শক্তি, যিনি সময় ও আদর্শের সীমানা অতিক্রম করে ভাবতে জানতেন। নজরুলের সাহিত্য নয়, তার আত্মঅভিযাত্রা, তার শ্রেণিচ্যুতি এসবই আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজকে বিব্রত করে। আমরা নিজেদের বিব্রতবোধ আড়াল করতে গিয়ে, বিশ্লেষণের নামে নজরুলকে খণ্ডিত করি। নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে বোঝাতে চাই “নজরুল আসলে কিছুই ঠিকমতো বুঝতেন না, কেবল নকল করতেন, কপাল ভালো ছিল বলেই টিকে গেছেন, আর নানা পক্ষের তোষামোদ পেতেন।“ কিন্তু এভাবে কি আমরা নিজেরাই এক সীমিত ও সংকীর্ণ মানদণ্ডে তার গভীরতাকে বিচার করে ফেলি না? এই প্রবন্ধ তাই জিজ্ঞাসা তোলে গভীরতার অভাব কি সত্যিই নজরুলের, না আমাদের নিজের চোখের?